মানুষ আসলে কবে থেকে বইয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান এই প্রাণীটিকে একসময় ঠিকই জ্ঞানচর্চা শুরু করতে হতো। এখান থেকেই মানুষের মাঝে জ্ঞান আর বিদ্যা সংগ্রহ করার তাগিদ তৈরি হয়। আর এই তাগিদ থেকেই আসলে বইয়ের উদ্ভব ঘটেছে। মানবজাতির উৎকর্ষ সাধনে বই নামক এই বস্তুটি একেবারে শুরু থেকে ভূমিকা রেখে আসছে। কিন্তু বইয়ের কথা চিন্তা করলেই আমাদের মাথায় যে বস্তুটির ছবি ভেসে ওঠে তা কিন্তু অতীতে ঠিক এমন ছিল না।
বই পড়া ও লেখালেখি একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রাচীনকালের পন্ডিতগণ সাধারণ মানুষের কাছে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দিতে বই ব্যবহার করতেন ঠিকই, তবে এই বই তৈরি হতো মাটির ফলক দিয়ে। মাটির ফলকে খচিত লেখা থেকেই বইয়ের প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয়। চীনে বাঁশের তৈরি একধরনের শিটের উপর লেখার প্রচলন ছিল। এছাড়া মোমের তৈরি ফলকেও কোথাও কোথাও লেখা হতো। তবে বইয়ের রচনায় প্রথম বড় ধরনের পরিবর্তন আসে প্যাপিরাস আসার পর।
প্যাপিরাস হলো একটি গাছ যা থেকে প্রথম আধুনিক কাগজের সূত্রপাত ঘটে। এটি আসার পর থেকে ফলকের বদলে কাগজেই লেখালেখি চলতে থাকে। তৈরি হতে থাকে হস্তলিখিত বই আর বিভিন্ন ধরনের স্ক্রোল (পাকানো কাগজ, যা নকশা, চিঠি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতো)। কাগজের সাথে সাথে লেখনি হিসেবে নানা ধরনের কলমেরও উদ্ভব ঘটতে থাকে। বিভিন্ন ধরনের কাগজে লেখার জন্য বিভিন্ন রকমের কলম ছিল। তবে বড় বড় বইয়ের ক্ষেত্রে হাতে লেখা ছিল অনেক কষ্টসাধ্য ও ব্যয়সাপেক্ষ একটি ব্যাপার।
ছাপাখানা আবিষ্কার হওয়ার পর তা বইয়ের প্রকাশনায় আমূল পরিবর্তন আনে। একই বইয়ের বিভিন্ন কপি বানানো সহজ হয়ে যায়। বই ছাড়াও সংবাদপত্র ও নানা দলিল দস্তাবেজ তৈরিতে এটি একটি মাইলফলক সৃষ্টি করে। একই সময়ে এর সাথে যুক্ত হয় টাইপরাইটারের আগমন, যা লেখকদের কষ্টকেও অনেকাংশে লাঘব করতে সক্ষম হয়।
এই গেল বইয়ের বিবর্তনের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। একটি বিষয় এখানে লক্ষ্য করা যায় যে, মানুষ যত আধুনিক হয়েছে, তার সাথে সাথে বইয়েও সেই আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। কাগজে ছাপানো বই আমরা এখনও ব্যবহার করি। কম্পিউটারে টাইপ করা অক্ষর, আধুনিক মসৃণ কাগজ ও শক্ত মলাটে বাঁধানো বই আমাদের প্রত্যেকের ঘরেই শোভা পায়। জ্ঞানের ভান্ডার এই বইগুলো নিয়ে তৈরি হয়েছে বড় বড় পাঠাগার ও বইয়ের দোকান।
এখন আসল প্রশ্নে আসা যাক। আর তা হলো, ছাপানো এই বইগুলো আর কতদিন আমাদের মাঝে টিকে থাকবে?
প্রশ্নটা আসলে অনেক যৌক্তিক। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সকল ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। একে একরকম ডিজিটাল বিপ্লব বলা যেতে পারে। আর এই বিপ্লবের ছোঁয়া লেগেছে বই পড়ার ক্ষেত্রেও। আগে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠককে একটি নির্দিষ্ট সময় বের করতে হতো কাঙ্ক্ষিত বইটি কেনার জন্য। নিজ এলাকা কিংবা দূরবর্তী কোনো বইয়ের দোকানে গিয়ে সে তার পছন্দের বইটি কিনে আনতো। এখনো যে এমনটি হয় না তা নয়। তবে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। একটি উপন্যাস এখন কেবল কাগজের পাতায়ই সীমাবদ্ধ নয়। বইয়েরও এখন ডিজিটাল সংস্করণ চলে এসেছে। আর এই ডিজিটাল সংস্করণকে বলা হয় ইলেকট্রনিক বুক বা সংক্ষেপে ই-বুক।
পিটার জেমস ব্রিটেনের একজন জনপ্রিয় লেখক। ১৯৯৩ সালে তিনি দুটি ফ্লপি ডিস্কে তার “হোস্ট” উপন্যাসটি প্রকাশ করেন। তৎকালীন সময়ে বইয়ের পাতার বদলে কম্পিউটারে উপন্যাস পড়ার কথা কেউ চিন্তাও করতো না। তাই তার বইয়ের এই ইলেকট্রনিক সংস্করণ তখন তীব্র নিন্দার শিকার হয়। একজন সাংবাদিক তো একটি আস্ত কম্পিউটার আর জেনারেটর নিয়ে সমুদ্র সৈকতে এসে বই পড়তে বসে পড়েন। আসলে এই সাংবাদিকের উদ্দেশ্য ছিল কম্পিউটারে বই পড়া আসলে কতটা অযৌক্তিক তা মানুষের কাছে তুলে ধরা। পিটার জেমসকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,
আমি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পত্রিকার একেবারে প্রথম পাতার খবরে ছিলাম। উপন্যাসকে মেরে ফেলার দায়ে আমাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।
তিনি এটাও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, মানুষ যখন থেকে ই-বুক পড়ার সময় সাধারণ বইয়ের মতো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে, তখন থেকেই এর জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করবে। দীর্ঘ দুই যুগ পর তার এই ভবিষদ্বাণী ঠিকই সত্য হতে চলেছে।
মাত্র কয়েক মেগাবাইটের ফ্লপি ডিস্ক আর আকারে বড় ব্যক্তিগত কম্পিউটার ই-বুককে জনপ্রিয় করে তুলতে পারেনি। কিন্তু প্রযুক্তিও ফ্লপি ডিস্ক আর বড় ডেস্কটপ কম্পিউটারের মাঝে আটকে ছিল না। ই-বুককে জনপ্রিয় করার জন্য প্রথম যে যন্ত্র বাজারে আসে, তা হলো আমাজনের কিন্ডল ই-বুক রিডার। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর আমাজন এটি প্রথম বাজারজাত করে। বাজারে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তি দেওয়ার মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই সবক’টি কিন্ডল বিক্রি হয়ে যায়।
কিন্ডলের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। এই বাড়তি জনপ্রিয়তা বইয়ের প্রকাশকদের মাঝে একধরনের আশঙ্কা তৈরি করতে থাকে। আমাজন বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার কাছে তাদের বইগুলোর ডিজিটার সংস্করণ তৈরির প্রস্তাব নিয়ে যায়। প্রকাশকগণ আমাজনের এই প্রস্তাবে রাজি না হলেও এতে আমাজনের খুব একটা ক্ষতি হয়নি। ডিজিটাল বই বিক্রির জন্য তাদের মাথায় লাভ লোকসানের কোনো চিন্তা ছিল না। বইয়ের মতো প্রোডাক্টের “লাইফটাইম কাস্টমার ভ্যালু” বজায় থাকে বলে তারা সস্তায় ই-বুক বাজারজাত করতে থাকে।
২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ই-বুকের বিক্রি আকাশচুম্বী হয়ে দাঁড়ায়। মাত্র দুই বছরের মাথায় বিক্রি বৃদ্ধির হার বেড়ে হয় প্রায় ১,২৬০ শতাংশ। একই সময়ে ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে অ্যাপল তাদের নতুন ডিভাইস আইপ্যাড বাজারজাত করতে শুরু করে। সেই সাথে তারা ই-বুক বিক্রি করার জন্য অ্যাপল বুকস নামে নতুন এক অ্যাপ্লিকেশনও বের করে । এভাবে ডিজিটাল স্ক্রিনের পাঠক সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বইয়ের মোট পাঠক সংখ্যার ২০ শতাংশ জায়গা ই-বুক পাঠকেরা দখল করে নেয়। আমেরিকার পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১৩ সালের এক জরিপ অনুযায়ী প্রতি দশজন আমেরিকান পাঠকদের মাঝে তিনজন কোনো না কোনো ই-বুক রিডার ব্যবহার করেন।
স্মার্টফোন মানুষের কাছে সহজলভ্য হওয়ার পর ই-বুকের ব্যবহার আরো তরান্বিত হয়। এছাড়া ইন্টারনেটে ই-বুকের পাইরেসির সংখ্যাও তুলনামূলক হারে বেড়ে যায়। কোনো অর্থ ব্যয় করা ছাড়া সহজে মানুষের হাতে ডিজিটাল ফরম্যাটের বই পৌঁছে যেতে থাকে।
এখন তাহলে সেই পুরনো প্রশ্নেই আসা যাক। ই-বুক সত্যি সত্যি ছাপানো বইকে প্রতিস্থাপন করবে কি না। উত্তরটা আসলে তেমন সহজ নয়। এজন্য বেশ কিছু দিক বিবেচনা করতে হবে।
ই-বুকের বিক্রি তুলনামূলক হারে বৃদ্ধি পেলেও তা পুরোপুরি বাজার দখল করতে পারেনি। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো ই-বুক বিক্রির হার একটু কমে যায়। তবে প্রতিনিয়ত এর গ্রহণযোগ্যতা ঠিকই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে ই-বুকের বহনযোগ্যতা। কয়েক হাজার ছাপানো বই রাখার জন্য একটা বড় হলঘরের সমান জায়গার প্রয়োজন হয়। আর সমপরিমাণ ই-বুক সংগ্রহ করে রাখার জন্য কেবল একটি ছোট মেমোরি কার্ড হলেই চলে। আইপ্যাডের দাম বেশি হলেও ট্যাবলেট পিসি ও কিন্ডলের দাম এখন মধ্যম আয়ের একজন পাঠকের হাতের নাগালে। তাই যার নিজস্ব একটা বড় পাঠাগারে অনেক বই সংগ্রহ করে রাখার মতো সামর্থ্য নেই, সে খুব সহজে পকেটের মধ্যেই একটা পাঠাগার নিয়ে ঘুরতে পারে। এখন স্মার্টফোনের আকার বই পড়ার জন্য যথেষ্ট বড় হওয়ায় ফোন ছাড়া আলাদা কোনো যন্ত্রেরও তেমন দরকার পড়ে না। যেকোনো কাজের ফাঁকে সময় বের করে বই পড়া এতে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে।
ছাপানো বইয়ের বিপক্ষে আসলে অনেক কথা বলা যায়। বই বানানোর জন্য গাছ কাঁটার প্রয়োজন পড়ে। ই-বুকের তুলনায় বিশাল জায়গা জুড়ে ছাপানো বই সংরক্ষণ করতে হয়। তাছাড়া পরিবহন ও রক্ষণাবেক্ষণের পেছনেও সময় ও অর্থ দিতে হয়। ই-বুকের ক্ষেত্রে আসলে এতো সবের দরকার হয় না। তাই একদিক দিয়ে বিবেচনা করলে ই-বুক কিন্তু ছাপানো বইয়ের থেকে অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব।
সব কিছুর মাঝে স্বাচ্ছন্দ্য বলে একটা ব্যাপার আছে। ডিজিটাল পর্দার বদলে অনেকে বইয়ের পাতায় লেখা পড়তেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আঙ্গুল দিয়ে ফোনের পর্দা সোয়াইপ করে পৃষ্ঠা পরিবর্তন, আর কড়কড়ে নতুন বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানোর মাঝে অনেকে দ্বিতীয়টিকেই বেশি প্রাধান্য দেবে। তাছাড়া বিভিন্ন গবেষণা মোতাবেক মোবাইল পর্দায় পাঠের তুলনায় বইয়ের পাতার পাঠ মানুষের মস্তিষ্কে বেশি স্থায়ী হয়। একজন পাঠকের কাছে নতুন বইয়ের পৃষ্ঠার গন্ধ অনেকগুলো সহজলভ্য ই-বুকের তুলনায় বেশি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। মসৃণ হার্ডকভার কিংবা পেপারব্যাক কভারের বই এবং একটি পরিপূর্ণ বইয়ের তাক একজন বইয়ের পোকা মানুষের কাছে বিরাট কিছু। এ কারণেই ই-বুক এখনো প্রিন্ট করা বইয়ের বাজারকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি।
বিশ্লেষকদের মতে, একসময় ঠিকই কাগজের বই আর থাকবে না। তবে সেই দিন আসতে অনেক দেরী। অন্তত আরো এক শতাব্দী ছাপানো বইয়ের অস্তিত্ব টিকে থাকবে। এরপর বইয়ের সংখ্যা কমে আসবে ঠিকই। তবে অবস্থাটা এমন হবে না যে, ঐ প্রজন্মের ছোট একটা বাচ্চা মলাট বাঁধানো বইয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে। মায়ের আঁচল টান দিয়ে জিজ্ঞেস করবে, “মা, ওটা কী জিনিস?”
প্রযুক্তির বিবর্তনের সাথে সাথে নানা পুরনো জিনিসের বিলুপ্তি ঘটতে থাকে। বেশ কয়েক বছর আগে, কোডাক নামের ক্যামেরার ফিল্ম বানানোর একটি কোম্পানি ছিল। একসময় এই কোম্পানিটি সারা বিশ্বে একচেটিয়া ব্যবসা করেছে। ডিজিটাল ক্যামেরা বাজারে আসার পর এই কোম্পানির ফিল্ম বানানোর ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। অনেক প্রযুক্তি আবার ঠিকই নিজের বিকল্প ব্যবহার খুঁজে নেয়। এই যেমন ধরুন রেডিওর কথা। টেলিভিশন আবিষ্কৃত হওয়ার পর অনেকে ভেবে নেয়, রেডিও বুঝি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আসলে কিন্তু তা হয়নি। রেডিও এখনো সদর্পে টিকে আছে। মানুষ গাড়িতে ও ফোনে এখনো রেডিও শুনে থাকে। বড় বড় রেডিও স্টেশন এখনো নানা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে যাচ্ছে।
ছাপানো বই কি আদৌ বিলুপ্ত বিলুপ্ত হবে? নাকি ই-বুকের সাথে সহাবস্থান বজায় রাখবে? এটি আসলে সময়ই বলে দেবে। ব্যাপারটি পুরোপুরি পাঠকের রুচি আর প্রযুক্তির উৎকর্ষের উপর নির্ভরশীল। ঠিক যেমনটি বলেছিলেন ব্রিটিশ লেখক পিটার জেমস।