একবার ভাবুন তো- অনেক বড় আর ব্যস্ত বিমানবন্দরে গাড়ি পার্কিংয়ের ঝামেলায় আপনার ফ্লাইটটাই মিস হয়ে গেলো। তখন কেমন লাগবে আপনার? এমন যদি হতো- আপনি গাড়ি থেকে নেমেই চাবিটা নিয়ে ফ্লাইট ধরতে রওনা দিলেন। আর কোনো রোবট এসে আপনার গাড়িটাকে সযত্নে পার্ক করে রেখে দিলো। আবার যেদিন সেই বিমানবন্দরে ফিরে আসলেন সেদিন গাড়িটাকে সময়মতো আপনার সামনে হাজির করলো। এরকম হলে ভালোই হতো। গাড়ি পার্কিংয়ের ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া যেত।
তবে এবার আর ভাবনায় নয়। বাস্তবে এমনটিই হতে যাচ্ছে। রোবট ভ্যালেট আপনার গাড়ি পার্কিংয়ের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে। এ বছরের আগস্ট মাস থেকেই লন্ডনের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাটউইক বিমানবন্দরে মিলতে পারে এ সেবা। ক্রাউলি বরো কাউন্সিলে বিমানবন্দরটির দাখিলকৃত একটি আবেদন অনুসারে, বিমানবন্দরটি গাড়ি পার্কিংয়ের এই সেবা নিয়ে তিন মাসের একটি পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা করেছে। আশা করা হচ্ছে এই পদ্ধতিতে বিমানবন্দরটি কম জায়গায় অনেক বেশি গাড়ি পার্ক করতে সক্ষম হবে।
নতুন এই রোবট তৈরি করেছে ফ্রান্সের কোম্পানি ‘স্ট্যানলি রোবোটিকস’। স্ট্যানলির ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, এর আগেও ফ্রান্সের চার্লস ডি গলে এবং লিওন বিমানবন্দরে এই রোবট ভিত্তিক গাড়ি পার্কিং সেবার পরীক্ষা চালিয়েছে কোম্পানিটি। পার্কিং রোবট ভ্যালেটটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্ট্যান’। পুরো ব্যাপারটি বুঝার সুবিধার্থে চলুন জেনে নিই রোবট ভ্যালেট পার্কিং এবং স্ট্যান সম্পর্কে বিস্তারিত।
রোবট ভ্যালেট পার্কিং
রোবট ভ্যালেট পার্কিং হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যেখানে একটি রোবট আপনার গাড়িকে নির্দিষ্ট স্থানে পার্ক করে রাখবে। আবার আপনার প্রদানকৃত তথ্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে আপনার জন্য গাড়িটি হাজির করে দেবে।
পুরো ব্যাপারটিই করবে রোবট। এখানে কোনো মানুষের দরকার পড়বে না। আর গাড়িটির চাবি থাকবে আপনারই কাছে। ফলে রোবট ছাড়া আর কেউ আপনার গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পাবে না। যতক্ষণ না আপনি আপনার গাড়িটির হাতে পাচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত গাড়িটির নিরাপত্তার দায়িত্বও নেবে রোবট।
স্ট্যান
রোবট ভ্যালেট পার্কিং পদ্ধতি বাস্তবে প্রয়োগের জন্য ফ্রান্সের স্ট্যানলি রোবোটিকস কোম্পানি যে রোবটটি বানিয়েছে তারই নাম দেওয়া হয়েছে স্ট্যান। এর পুরোটিই ইলেক্ট্রিক এবং স্বয়ংক্রিয়। এটিই মূলত একটি রোবটিক গাড়ি। তবে এই রোবটিক গাড়িটি স্বনিয়ন্ত্রিত। কোনো চালক ছাড়াই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্য গাড়িগুলো পার্ক করে রোবটটি। নির্মাতাদের মতে, এটি কখনোই নষ্ট হবে না। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য এটিই পৃথিবীর প্রথম রোবট। এটি অনেকটা ফর্কলিফটের মতো। প্রথমে রোবটটির বহনকারী অংশটুকু অন্য গাড়ির নিচ দিয়ে গাড়ি এই প্রবেশ করিয়ে দেয়। তারপর গাড়িটিকে উচু করে রওনা দেয় নির্দিষ্ট পার্কিং এরিয়ায় রাখার জন্য।
যেভাবে কাজ করে রোবট ভ্যালেট (স্ট্যান)
স্ট্যান রোবটটি খুবই সহজ এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে পুরো প্রক্রিয়াটি করে থাকে। বিমানবন্দরের যাত্রীরা কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই গাড়ি পার্ক করতে পারেন এ রোবটের সাহায্যে। পুরো প্রক্রিয়াটিতে একবার চোখ বুলানো যাক।
১. নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে হবে গাড়ি
পার্কিং এরিয়ার সবচেয়ে সহজতম জায়গায় গাড়ি রাখার জন্য অনেকগুলো বক্স সাজানো থাকবে। সেই বক্সের ভেতর গাড়িটি রাখতে হবে। সেখানে গাড়ি রেখে নিজের মালামাল নিয়ে আপনি প্লেনের উদ্দেশ্যে চলে যাবেন। গাড়ি পার্কিংয়ের এ সেবায় রোবট আপনার গাড়ির চাবি চাইবে না। আপনার চাবি আপনার কাছেই থাকবে।
২. গাড়ি রাখার তথ্যটি পৌঁছে দিতে হবে রোবটের কাছে
এবার আপনি যে গাড়িটি পার্ক করার জন্য বক্সে রেখেছেন সেটি নিশ্চিত করতে হবে এবং তথ্যটি অনলাইনে জানিয়ে দিতে হবে রোবটকে। এজন্য টার্মিনালে আপনার ফ্লাইটের তথ্য প্রদানের পাশাপাশি পার্কিয়ের তথ্যটিও নিশ্চিত করতে হবে। মাত্র কয়েকটি ক্লিকেই নিশ্চিত করতে পারবেন এ তথ্য। কিউআর কোডের মাধ্যমে পুরো ব্যাপারটি করতে পারবেন চোখের পলকেই। কনফার্মেশন করলেই আপনার গাড়িটি সুরক্ষিত হয়ে যাবে। যে কেউ চাইলেই আর আপনার গাড়িটিকে কোনো দিকে নিয়ে যেতে পারবে না। রোবট ভ্যালেট না আসা পর্যন্ত আপনার গাড়ি পূর্ণ নিরাপত্তায় থাকবে বক্সের ভেতর।
৩. রোবট আসবে গাড়িটিকে নিতে
এ পর্যায়ে রোবট চলে আসবে আপনার গাড়ির কাছে। রোবটটি পুরোটাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলবে। এজন্য কোনো চালকের প্রয়োজন পড়বে না। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যাবহার করে রোবটটি আপনার টার্মিনালে প্রদানকৃত তথ্য অনুযায়ী আপনার গাড়ির কাছে চলে যাবে। রোবট পৌঁছানোমাত্র বক্সের গেটটি খুলে যাবে। এরপর রোবটটির পেছনের অংশ অর্থাৎ গাড়ি বহনকারী অংশটি গাড়ির নিচ দিয়ে স্লাইড করে ঢুকে যাবে। রোবটের উপর গাড়িটি বসে গেলে রোবটটি রওনা দেবে উত্তম জায়গায় গাড়িটি পার্ক করে রাখার জন্য।
৪. সুরক্ষিত স্থানে পার্ক হয়ে যাবে গাড়ি
সহজতম পথ ব্যবহার করে রোবটটি আপনার গাড়িকে নিরাপদ জায়গায় পার্ক করে রেখে দেবে। পার্কিং এরিয়ার ভেতর কোনো মানুষ ঢুকতে পারবে না। শুধুমাত্র রোবট ভ্যালেটই ঢুকতে পারবে। এর ফলে গাড়ি হারিয়ে যাওয়ার যেমন ভয় নেই, তেমনি ভয় নেই গাড়ির কোনো অংশ ক্ষতি হওয়ার। কারণ রোবট তার বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে অন্য কোনো গাড়ির সাথে স্পর্শ না করিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পার্ক করবে।
৫. ফেরার সময় গাড়ি থাকবে আপনার জন্য প্রস্তুত
এই সেবাটি ফ্লাইটের তথ্যের সাথে সংযুক্ত থাকবে। ফলে রোবট জানে আপনি কবে কখন ফিরবেন। সে অনুযায়ী আপনার জন্য নির্দিষ্ট বক্সে গাড়িটিকে পৌঁছে দেবে রোবট। ফলে ফেরার পর পর এত বড় পার্কিং এরিয়ায় গাড়ি খুঁজতে হবে না আপনাকে। আপনি শুধু নির্দিষ্ট বক্সে যাবেন, আপনার গাড়িটি নেবেন এবং কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই আপনার গন্তব্যে ছুটবেন।
পুরো ব্যাপারটি কত সহজে ঘটবে তা বুঝতে এই ভিডিওটি সহযোগিতা করতে পারে।
পুরো প্রক্রিয়াটি এতই সহজ যে, কোনো রকম ঝামেলাই হবে না এ পদ্ধতিতে। কয়েক সেকেন্ড বা মিনিটের মধ্যেই পুরো ব্যাপারটি ঘটবে। ডিজিটাল এ সেবায় রোবট আপনার গতিময় জীবনকে করে তুলবে অনেক সহজ।
সুবিধা ও উপকারিতা
এ পদ্ধতিতে গাড়ি পার্ক করার জন্য আলাদা করে আর ড্রাইভার লাগবে না। শুধু নির্দিষ্ট বক্সে গাড়িটি রেখে টার্মিনালে ডাটা ইনপুট দিলেই বাকি কাজ করে দিবে রোবট। রোবটটি আপনার চাবিও চাইবে না। এর ফলে সময় বেঁচে যাবে অনেক। প্লেন মিস হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে। গাড়ি পার্ক করে ফ্লাইট ধরতে গেলে অনেক সময় ফ্লাইট মিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেহেতু গাড়িটি সহজতম স্থানে বক্সে রাখলেই বাকি কাজ রোবটের দায়িত্ব। তাই সময় অপচয় হয়ে ফ্লাইট মিস হওয়ার সম্ভাবনা এক্ষেত্রে কম।
পার্কিংয়ের জন্য যেহেতেু রোবট ভ্যালেটটি গাড়িকে উচু করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যায়, তাই গাড়ির গেট খোলার দরকার পড়ে না। আর এজন্যই গাড়ি পার্কিং করার সময় গেট খোলার জন্য আলাদাভাবে বেশি করে জায়গা ফাঁকা রাখার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে একটি গাড়ি আরেকটি গাড়ির খুব কাছাকাছি রাখা যায়। এতে কম জায়গায় অনেক গাড়ি রাখা সম্ভব হয়। রোবট ছাড়া গাড়ি পার্কি করলে যেখানে ৬ হাজার গাড়ি রাখা যেত, ভ্যালেট পার্কিং পদ্ধতিতে সেখানে সাড়ে ৮ হাজার গাড়ি রাখা সম্ভব হবে। ফলে দিন দিন যাত্রী এবং গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও আগের গাড়ি পার্কিং এরিয়ার মধ্যেই আরো বেশি গাড়ি পার্ক করা সম্ভব হবে।
ফেরার সময় গাড়ি খুঁজে পাওয়া একটি ঝামেলার কাজ। সেই সাথে সবচেয়ে ঝামেলার হচ্ছে এত গাড়ির মধ্য থেকে নিজের গাড়িটিকে বের করে আনা। যেহেতু রোবটটি আপনার গাড়িকে আপনার জন্য নির্ধারিত স্থানে হাজির করে দেবে, সেহেতু গাড়ি ঠিকমতো হাতে পাওয়ার দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। একইসাথে সঠিক সময়ে গাড়ি পাওয়ার নিশ্চয়তাও দেবে এই রোবট। ব্যক্তিগতভাবে গাড়ি বের করে আনতে কিংবা ড্রাইভারের মাধ্যমে আনতে যে ঝামেলা হওয়ার কথা সে ঝামেলার অবসান ঘটাবে এ রোবটটি।
নিজে গাড়ি পার্কিং করতে গেলে এত গাড়ির ভিড়ে অন্য গাড়ির সাথে লেগে গিয়ে সাধের গাড়িটির কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কাজটি রোবট করে দিলে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কোনো ভয়ই থাকবে না।
ভ্যালেট পার্কিং পদ্ধতিতে রোবট আপনার গাড়িকে একেবারেই সংরক্ষিত এলাকায় নিয়ে রাখবে। চাবিটিও থাকবে আপনার কাছে। ফলে গাড়ি নিয়ে দুশ্চিন্তা বাদ দিলেও চলবে। আর পার্কিং এরিয়াটি সংরক্ষিত হওয়ার কারণে কোনো অতিরিক্তি পুলিশ বা গার্ডের দরকার পড়বে না। এতে অতিরিক্তি লোক নিয়োগ করতে হবে না বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে। আর পার্কিং এরিয়ার ভেতরে জনসাধারণের প্রবেশও নিষেধ থাকবে। পুরো প্রক্রিয়াটিই করবে রোবট এবং পুরোটিই হবে স্বচ্ছ ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে।