পণ্য বিক্রি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রচারণা, প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভোক্তা/ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ প্রথম এবং প্রধান কাজ হিসেবে অগ্রাধিকার পায়। কেননা প্রাথমিক অবস্থায় একজন ভোক্তা কী ধরণের পণ্যের ব্যাপারে আগ্রহী, কিংবা একজন ভোটার কোন দলকে সমর্থন করে, তা জানতে পারলে পণ্যের বিজ্ঞাপন বা ঐ ভোটারের কাছে নির্বাচনী প্রচারণার ব্যাপারটি বেশ সহজ হয়ে যায়।
এছাড়াও অনলাইন ভিত্তিক নিউজ মিডিয়া, ভিডিও কন্টেন্ট মিডিয়া সহ সরাসরি পণ্য বিক্রি করে, এমন প্রতিষ্ঠানগুলো সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। এসব দিক বিবেচনায় সাধারণ মানুষের তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে প্রায় প্রত্যেকটি অনলাইন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানই আগ্রহী। আর এই তথ্য সংগ্রহের প্রায়োগিক পন্থাই বর্তমানে ‘ওয়েব ট্র্যাকিং’ হিসেবে পরিচিত।
ওয়েব ট্র্যাকিং বর্তমানে বেশ প্রচলিত একটি ধারণা। অধিকাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীই জানে, তাদের ইন্টারনেট ভিত্তিক কর্মকাণ্ডগুলোতে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চোখ রাখে এবং প্রয়োজনে ব্যবহারকারীর প্রত্যেকটি পদক্ষেপ ট্র্যাক করার ক্ষমতাও যে তাদের রয়েছে, সে ব্যাপারেও সবাই ওয়াকিবহাল। ফেসবুক-ক্যামব্রিজ অ্যানালাইটিকা ডাটা স্ক্যান্ডালের পর সবার কাছে এটাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ব্যবহারকারীর তথ্য বিক্রি করে মিলিয়ন ডলার রোজগারের সুযোগ কোম্পানিগুলোর রয়েছে।
এছাড়াও ই-কমার্স ভিত্তিক পণ্য ক্রয়-বিক্রয় সুবিধা সবার মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে, সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে প্রতিযোগিতা। আর এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু ভোক্তাদের পছন্দ, অপছন্দের উপর ভিত্তি করে সোশ্যাল মিডিয়া সহ ইন্টারনেট ভিত্তিক বিভিন্ন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে, সেহেতু বলাই যায়, যে প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যবহারকারীর বেশি তথ্য থাকবে, সে প্রতিষ্ঠানই তাদের পণ্যগুলো ব্যবহারকারীর কাছে সবচাইতে দ্রুত এবং ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারবে এবং প্রতিযোগিতার দৌড়ে এগিয়ে থাকবে। অর্থাৎ সাধারণ ব্যবহারকারীদের তথ্যগুলো আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ মনে হলেও, প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এসবের উপযুক্ত মূল্য রয়েছে।
ওয়েব ট্র্যাকিং নিয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা থাকলেও এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অনেকেই ওয়াকিবহাল না। আর যেহেতু ট্র্যাকারদের কাছ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া টেকনিক্যালি বেশ ঝামেলার ব্যাপার, সেহেতু অনেকেই পুরো ব্যাপারটি এড়িয়ে যায়। কিন্তু ভাবুন একবার, আপনার প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ডে অপরিচিত একজন চোখ রাখছে। আপনার ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রয়োজনে ব্লাকমেলিং সহ নানা অনৈতিক কাজে সেগুলোকে ব্যবহার করছে। এমনকি টেকনোলোজির এই দুনিয়ায় আপনি খুব সহজেই পরিচয় জালিয়াতির শিকার হতে পারেন।
এছাড়াও বর্তমানে ভিসা, ব্যাংকিং সহ নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়মিত ইন্টারনেটের ব্যবহার আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার সাথে সরাসরি জড়িয়ে আছে। এ ধরনের কাজে ব্যবহার করা তথ্যগুলো, যেমন- পাসওয়ার্ড, ব্যাংক ট্রাঞ্জেকশনে ব্যবহার করা কোড, বাসার ঠিকানা সহ প্রায় অধিকাংশই বেশ সংবেদনশীল। যেগুলো কোনো অসৎ লোকের কাছে পড়ামাত্রই আপনি সব হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারেন, হারিয়ে ফেলতে পারেন নিজের আসল পরিচয়। আর যেহেতু এ ধরনের কাজগুলো পুরোপুরি ওয়েব ব্রাউজিংয়ের মাধ্যমে সম্পাদন করার প্রয়োজন হয়, সেহেতু আপনার তথ্যগুলো খুব সহজেই ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আওতায় চলে যেতে পারে।
দিন যত যাচ্ছে, ওয়েব প্রযুক্তির উৎকর্ষতা তত বাড়ছে। পাশাপাশি আমার/আপনার তথ্য সরবরাহের কাজে ব্যবহৃত প্রযুক্তিরও উন্নতি ঘটছে। অর্থাৎ কেউ চাইলেই পুরোপুরি ওয়েব ট্র্যাকিং এড়িয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু যেহেতু ওয়েব ট্র্যাকিং প্রযুক্তি কুকিজ, ফ্ল্যাশ কুকিজ, সার্ভার লগ, ব্রাউজার ফিঙ্গার-প্রিন্ট এবং ওয়েব ব্যাকনসের মতো কিছু নির্দিষ্ট টার্মের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়, সেহেতু এগুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা আপনাকে অনেকাংশেই ট্র্যাকারদের কুনজর থেকে নিজেদের গোপনীয়তা রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
কুকিজ
কুকিজ হচ্ছে কিছু ছোট ছোট টেক্সট ফাইল, যেগুলো ব্রাউজারের মাধ্যমে তৈরি হয় এবং ব্যবহারকারীর ডিভাইসে সংরক্ষিত থাকে। কোনো নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট ভিজিট করার জন্য ব্যবহারকারী যখন ব্রাউজারের মাধ্যমে ঐ ওয়েবসাইটের HTTP সার্ভারে রিকোয়েস্ট পাঠায়, তখন ওয়েবসাইটটি ব্যবহারকারীর চাওয়া কন্টেন্টগুলোর সাথে সাথে তাদের ইচ্ছেমতো কিছু কুকিজ ব্রাউজারের উদ্দেশ্যে পাঠায়। ব্রাউজার তখন সেগুলো ক্যাশ মেমোরিতে সংরক্ষণ করে এবং সংরক্ষিত কুকিজের একটি কপি ঐ ওয়েবসাইটের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়।
পুরো প্রক্রিয়াটিতে মূলত নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটের জন্য ব্রাউজার ব্যবহারকারীর ডাটাগুলোকে ভবিষ্যতে সহজে ব্যবহারের জন্য রেখে দেয়। অর্থাৎ, ব্যবহারকারী ঐ ওয়েবসাইটের সাথে যত বেশি সংযুক্ত হবে, তত বেশি ওয়েবসাইটটি ব্যবহারকারীর কার্যকলাপ সম্পর্কে জানবে এবং কুকিজ আকারে ব্রাউজারের ক্যাশ মেমোরি কার্যকলাপগুলোর ডাটা সংরক্ষণের সাথে সাথে নিজেদের কাছেও একটি সংস্করণ রেখে দেবে। এছাড়াও নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে সহজেই লগইন করার জন্য ইউজার আইডি, পাসওয়ার্ড সংরক্ষণের কাজটিও মূলত কুকিজ সেকশনে হয়ে থাকে।
আরো সহজ করে বলতে গেলে, আপনি যখন অ্যামাজনের মতো ই-কমার্স সাইটগুলো ভিজিট করেন, তখন সেটি আপনার ব্রাউজারে একটি কুকিজ সেকশন তৈরি করে। ওয়েবসাইটটিতে আপনি কী খুঁজছেন, কোন পণ্যগুলো বেশি সময় ধরে দেখছেন, পছন্দের লিস্টে কোনগুলোকে যুক্ত করছেন, পণ্যগুলোর দামই বা কেমন সহ নানা ধরনের ডাটা সেই কুকিজ সেকশনে সংরক্ষিত থাকে। আপনি যখন অন্য কোনো সময় আবার আমাজনের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করবেন, তখন সেটি ব্রাউজারে সংরক্ষিত কুকিজগুলোকে নিজেদের সার্ভারে নিয়ে বিচ্ছিন্ন সব তথ্যের ক্ষুদ্রাংশগুলোকে একটি নির্দিষ্ট ক্রমে সাজিয়ে, আপনি কী ধরনের পণ্যের ব্যাপারে আগ্রহী সেটি চিহ্নিত করবে এবং সে অনুযায়ী পণ্য দেখাবে।
আমাজনের মতো অন্যান্য ই-কমার্স সাইটগুলো একই পন্থায় সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কুকিজের ব্যবহার করে থাকে। অন্যদিকে ইউটিউব, ইন্সট্রাগ্রাম, ফেসবুক সহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিনামূল্যে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো একইভাবে ব্যবহারকারীর ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে এবং তথ্যগুলোকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে।
এ ধরনের কুকিজ সংগ্রহের ব্যাপারটি মূলত ফার্স্ট-পার্টি কুকিজ হিসেবে পরিচিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের কুকিজ সংগ্রহের ব্যাপারটি সেবার মান বৃদ্ধির জন্য হয়ে থাকে। প্রায় অধিকাংশ জনপ্রিয় ওয়েবসাইটে ফার্স্ট-পার্টি কুকিজ প্রথম থেকেই চালু থাকে; অর্থাৎ আপনি ওয়েবসাইটটি ভিজিট করার সাথে সাথে কুকিজ সেকশনে আপনার কার্যকলাপ সম্পর্কে তথ্য জমা হতে থাকে। অপরদিকে, কিছু কিছু ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীর ইচ্ছা, অনিচ্ছা অনুযায়ী কুকিজ সংগ্রহ করে; অর্থা ওয়েবসাইটগুলো বিভিন্ন পপ-আপ এবং অ্যালার্টের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর কাছ থেকে কী ধরনের তথ্যগুলো কুকিজ হিসেবে সংগ্রহ করছে, সেটি জানিয়ে দেয়। এমনকি, প্রয়োজনে ব্যবহারকারীকে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে ঐ ওয়েবসাইটটির জন্য কুকিজ অপশন চালু করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, থার্ড-পার্টি কুকিজ নিয়ে।
ফার্স্ট-পার্টি বনাম থার্ড-পার্টি কুকিজ
ধরুন, আপনি nytimes.com নিউজ পোর্টালটি ভিজিট করেছেন। এখন ব্রাউজারের কুকিজ সেকশনে যদি nytimes.com এর জন্যই কুকিজ সংগ্রহ হয়, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটি ফার্স্ট-পার্টি কুকিজের আওতায় রয়েছে। অপরদিকে, আপনি nytimes.com ভিজিট করেছেন। কিন্তু কোনো একটি পপ-আপ অ্যাড কিংবা অন্য কোনভাবে ঐ ওয়েবসাইটটি free-news.com কে রেফার করলো এবং সেই সাথে free-news.com এর জন্য নতুন একটি কুকিজ সেকশনও তৈরি হয়ে গেল আপনার ব্রাউজারের ক্যাশ মেমোরিতে। সেক্ষেত্রে আপনার ডাটাগুলো থার্ড-পার্টি কুকিজের আওতায় চলে গেছে। অর্থাৎ, আপনার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরেকজন আপনার পছন্দ, অপছন্দ, যাবতীয় অনলাইন ভিত্তিক কর্মকাণ্ডগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।
এক্ষেত্রে আপনি একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। প্রথমত, আপনার সব রকমের ব্রাউজিং ডাটা অবিশ্বস্ত কোনো সংগ্রাহকের কাছে চলে যাবে। সেক্ষেত্রে, আপনি জানবেনও না, ঐ সংগ্রাহক আপনার ডাটাগুলো দিয়ে কী ধরনের অনৈতিক কাজ করছে। দ্বিতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন ব্যাংকিং বা এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইটে প্রবেশের জন্য ব্যবহৃত ইউজার আইডি, পাসওয়ার্ড যদি কুকিজ আকারে ব্রাউজারে সংরক্ষিত থাকে; অর্থাৎ আপনি যদি নির্দিষ্ট সাইটগুলো থেকে লগ-আউট না করে থাকেন, কিংবা কোনো লগইন সেশনের পরে পূর্বের কুকিজগুলো ডিলিট না করেন, তাহলে সেগুলোও থার্ড-পার্টি কুকিজ সংগ্রাহকদের সংগ্রহে চলে যেতে পারে।
ব্রাউজার ফিঙ্গার-প্রিন্টিং, কুকিজের চাইতেও ভয়াবহ
চাইলেই কোনো নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটের জন্য কুকিজ বন্ধ করে রাখা যায়, নানা উপায়ে এড়িয়ে যাওয়া যায়। এছাড়া থার্ড-পার্টি কুকিজ ছাড়া নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার তেমন কারণও নেই। কিন্তু ব্রাউজার ফিঙ্গার-প্রিন্টিং এক্ষেত্রে বেশ ভয়াবহ। ওয়েব ট্র্যাকিংয়ের এই পদ্ধতিতে ট্র্যাকাররা নির্দিষ্ট কিছু স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করে, যেগুলোর সাহায্যে আপনার স্মার্টফোন, ল্যাপটপ অথবা যেসব ডিভাইস দিয়ে ইন্টারনেট ব্রাউজ করছেন, সেই ডিভাইসটির সব রকমের তথ্য ট্র্যাকারদের কাছে চলে যাবে।
ডিভাইসের মডেল, ব্রাউজারে ব্যবহৃত এক্সটেনশন, প্লাগ-ইন, অবস্থান, ভাষা, টাইমজোন, ডিভাইসের স্ক্রিন-রেজুলেশন, ইন্সটল করা ফন্ট সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ট্র্যাকাররা হাতিয়ে নিতে পারবে। এই পদ্ধতি এতটাই শক্তিশালী যে, কোনো ব্যক্তি যদি একের অধিক ডিভাইস ব্যবহার করে, আর সেগুলো যদি একই জায়গায় রাখা হয়, কিংবা একই নেটওয়ার্কের আওতায় থাকে, তাহলেও একটির সাহায্যে অন্যটির ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করাও ট্র্যাকারদের জন্য সহজ হয়ে যায়।
সরাসরি একজন ব্যবহারকারীকে ট্র্যাক করা কি সম্ভব?
হ্যাঁ। আর সবচাইতে রোমাঞ্চকর ব্যাপার হচ্ছে, এজন্য সার্ভিস প্রোভাইডারদের কুকিজ কিংবা ব্রাউজার ফিঙ্গার-প্রিন্টিং এর মতো টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। আপনি যখন কোনো ওয়েবসাইট ভিজিট করেন, তখন সরাসরি ওয়েবসাইটের সার্ভারে রিকোয়েস্ট পাঠান। আর প্রোভাইডাররা তাদের সার্ভার লগে আসা রিকোয়েস্টগুলো বিস্তারিত দেখেই আপনার আইপি এড্রেস, ডিভাইসের লোকেশন, ডিভাইসের নাম জেনে নিতে পারে। তবে কুকিজ, ব্রাউজার ফিঙ্গার-প্রিন্টিং এর মতো ব্যাপারগুলো আপনার ব্যাপারে তাদের আরো বেশি তথ্য জোগান দেয়।
প্রতিষ্ঠানগুলো কতজন ব্যবহারকারী তাদের ওয়েবসাইট ব্যবহার করলো, তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা মূলত দেখে, ব্যবহারকারীরা কীভাবে তাদের ওয়েবসাইটের সাথে ইন্টারঅ্যাক্ট করছে, কত সময় ধরে ব্যবহার করছে, কোন কোন পেজ, ফিচার, প্রোডাক্টগুলোতে বেশি সময় দিচ্ছে, প্রথমবার ব্যবহারের পর আবার ফিরে আসছে কি না, আসলেও কত সময় পর, কতবার আসলো; এমনকি, ওয়েবসাইটে করা সার্চগুলোতে কী ধরনের কি-ওয়ার্ড ব্যবহার করা হচ্ছে, সেদিকেও কোম্পানিগুলো নজর রাখে। পরবর্তীতে এসকল তথ্যের উপর ভিত্তি করেই প্রোডাক্ট, কন্টেন্ট, ইউজার ইন্টারফেস, ব্যবহৃত টেকনোলোজিগুলোতে পরিবর্তন আনে।
যে উপায়ে নিজের গোপনীয়তা রক্ষা করবেন
পূর্বেই বলা হয়েছে, কন্টেন্ট মার্কেটিং থেকে শুরু করে ভোক্তাদের কাছে সঠিক পণ্যের বিজ্ঞাপন পৌঁছে দেওয়া সহ সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কোম্পানিগুলো ব্যবহারকারীর তথ্যগুলোর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল থাকার চেষ্টা করে। ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ সহ নানা রকম তথ্য বিক্রির মাধ্যমেও বিশাল অংকের অর্থ উপার্জনেও তারা পিছু পা হয় না। এছাড়া থার্ড-পার্টি ওয়েব ট্র্যাকারদের ব্যাপারে যেহেতু কোন ব্যবহারকারীই ওয়াকিবহাল না, সেহেতু তাদের কাছে ব্যক্তিগত অতি ক্ষুদ্র তথ্য যাওয়াও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। আর ওয়েব ট্র্যাকিং থেকে পুরোপুরি পরিত্রাণ পাওয়ারও সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে থার্ড-পার্টি কুকিজ সংগ্রাহক, ব্রাউজার ফিঙ্গার-প্রিন্টিং সহ অবিশ্বস্ত ওয়েব ট্র্যাকারদের হাত থেকে নিজের গোপনীয়তা রক্ষা করা যায়।
আপনি যদি গুগল ক্রোম অথবা মজিলা ব্যবহারকারী হয়ে থাকেন, তাহলে Adblock Plus এক্সটেনশনটি ব্যবহার করতে পারেন। এটি ব্যানার, পপ-আপ বিজ্ঞাপনের মতো থার্ড-পার্টি কুকিজ সংগ্রহ করে এমন ওয়েবসাইটগুলো ব্লক করে দেয়। সাথে সাথে ম্যালওয়ার, ট্র্যাকিং-স্ক্রিপ্টগুলো খুঁজে বের করে ব্লক করে দিতেও পারদর্শী।
উপরোক্ত কাজের জন্য Ghostery-ও বেশ জনপ্রিয়। এটি মূলত ব্যবহারকারীর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে। অর্থাৎ, এক্সটেনশনটি প্রাথমিক অবস্থায় বিপদজনক ওয়েবসাইট, অ্যাডগুলোকে চিহ্নিত করবে। এরপর কোন ওয়েবসাইট, ওয়েব-অ্যাপ কাজ করবে, কোনটি করবে না সেটি ব্যবহারকারীর নির্দেশে উপর ভিত্তি করে সম্পাদন করবে।
Do Not Track এক্সটেনশনটিও বেশ কাজের। এটি অ্যাডব্লক প্লাস, গোস্টেরির মতো কাজ করলেও, ইচ্ছাকৃতভাবে থার্ড-পার্টি কোনো অ্যাপের সাথে ডাটা বিনিময় করতে গেলেও বাধা প্রদান করবে। অর্থাৎ, আপনি যদি কোনো একটি ওয়েবসাইটে আপনার ফেসবুক, গুগল প্লাসের মাধ্যমে লগইন করতে চান, অথবা কোনো কন্টেন্ট মিডিয়া প্লাটফর্ম থেকে যদি অন্য কোনো সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম, যেমন: ফেসবুক, টুইটারে শেয়ার বাটন দ্বারা কিছু শেয়ার করতে চান, তাহলে সেক্ষেত্রে এক্সটেনশনটি বাধা প্রদান করবে।
গুগল ক্রোম, মজিলা ফায়ার ফক্স বেশ জনপ্রিয় হলেও অনেকেই ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার, মাইক্রোসফট এজ, ভিভালডি, অপেরা, সাফারির মতো ওয়েব ব্রাউজার ব্যবহার করে থাকে। এছাড়াও বর্তমানে স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্রাউজিংও বেশ জনপ্রিয়। এক্ষেত্রে, প্রত্যেকটি ব্রাউজিং সেশনের পরে সোশ্যাল মিডিয়া সহ গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইটগুলো থেকে লগ-আউট করেও নিরাপদ থাকা যায়। তাছাড়া, ব্রাউজিং ডাটাগুলো, যেমন: ব্রাউজিং হিস্টোরি, কুকিজ, ক্যাশ মেমোরিতে সংরক্ষিত ডাটাগুলো মুছে ফেলেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
বর্তমানে প্রায় প্রত্যেকটি ব্রাউজারেই ‘ইনকগনিটো মুড’ বা ‘ব্রাউজার ইন প্রাইভেট মুড’ রয়েছে। ব্রাউজারগুলোর এই সেবাটি ব্যবহারের ফলে কুকিজ, ব্রাউজিং ডাটা, ক্যাশ সংরক্ষণ থেকে ব্রাউজারকে বিরত রাখে। সুতরাং, কোনো রকমের ডাটা ম্যানুয়ালি মুছে ফেলার ঝামেলা এড়ানো যায়। আর নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হওয়ার সাথে নিজের পরিচয় পুরোপুরি লুকিয়ে ফেলার জন্য টর ব্রাউজার তো আছেই!
ফিচার ছবি: consumerreports.org