রেজিনাল্ড ফেসেন্ডেন: আমাদের পরিচিত বেতার যন্ত্রের উদ্ভাবক

শিরোনামটা দেখে কেউ কেউ হয়তো একটু অবাক হতে পারেন। বেতারের কথা বললেই যেখানে আমাদের মনে গুগলিয়েমো মার্কনি, জগদীশচন্দ্র বসুর মতো নাম ভেসে ওঠে সেখানে এই রেজিনাল্ড ফেসেন্ডেন আবার কোথা থেকে আসলো? কিন্তু সত্যিটা হলো, যে বেতার যন্ত্র আমরা চিনি, যা মানুষের কথা, গান কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠান নিয়ে আসে আমাদের কাছে সে বেতার যন্ত্রের উদ্ভাবক এই ভদ্রলোকই

মার্কনির উদ্ভাবন তারবিহীন যোগাযোগের ক্ষেত্রে। সামগ্রিকভাবে সকল তারবিহীন যোগাযোগকে বেতার বা রেডিও বলা হয়। মার্কনি মানুষের কণ্ঠস্বর কিংবা গান পাঠাননি বরং ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল পাঠিয়েছেন যা মোর্স কোডের মাধ্যমে তথ্য বহন করে। ফেসেন্ডেনের উদ্ভাবনকে মার্কনির উন্নত সংস্করণ বলা যায়। তিনি কোনো তার ছাড়া মানুষের কণ্ঠস্বর পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার এ অসাধারণ উদ্ভাবনের গল্পই বলা হবে এখানে। 

এডিসনের গবেষণাগারে ফেসেন্ডেন; Image Source: washingtonpost.com

রেজিনাল্ড ফেসেন্ডেন জন্মেছিলেন কানাডায়। শৈশব থেকেই তড়িৎচুম্বকের জগৎ তাকে আকর্ষণ করেছে। যদিও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথাগতভাবে কোনো ডিগ্রী নিতে পারেননি, তবুও বিদ্যুৎ বিষয়ে তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ছিল অসামান্য। ১৮৮৬ সালের দিকে জুনিয়র টেকনিশিয়ান হিসেবে এডিসনের গবেষণাগারে যোগ দিয়েছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তার দক্ষতার ফলে খুব সহজেই নজর কেড়েছিলেন এডিসনের। গবেষণাগারের রুটিনমাফিক কাজের বাইরেও একটি বিষয়ে রীতিমতো আসক্ত ছিলেন, তার ছাড়াই মানুষের কণ্ঠস্বর ও সঙ্গীত সম্প্রচারের চিন্তা পেয়ে বসেছিল তাকে।

কিন্তু এডিসনকে তিনি এ বিষয়ে সম্মত করাতে পারেননি। এডিসন তো বলেই দিয়েছিলেন, এমন কিছু প্রযুক্তিগতভাবে অসম্ভব পর্যায়ের। এডিসনের কাছ থেকে কোনো সম্ভাবনা না দেখতে পেয়ে সেখানের চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। এরপর আরো বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন, ওয়েশিংটনহাউসে এ.সি জেনারেটর নিয়ে কাজ করেন, দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন, কয়েক বছরের জন্য যোগ দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া অধিদপ্তরেও।

কিন্তু তিনি যেখানে যে চাকরিই করেন না কেন, তার মাথায় ঐ একই পরিকল্পনা ঘুরছিল। তার ছাড়া মানুষের কন্ঠ ও সঙ্গীত কীভাবে সম্প্রচার করা যায়? এ নিয়ে নিজে নিজে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশেষে ১৯০৩ সালের দিকে এসে তিনি এ সিস্টেমের একটি মোটামুটি ধারণা দাঁড় করাতে সক্ষম হন। আপনার হয়তো মনে হতে পারে যে, মার্কনি তার বেতার সিগন্যাল পাঠাতে পারলে, অডিও সিগন্যাল পাঠাতে কী সমস্যা ছিল? অডিও সিগন্যালে সমস্যা হতো কারণ রেডিও ওয়েভের তুলনায় এর কম্পাঙ্ক বা ফ্রিকুয়েন্সি অনেক কম। অডিও সিগন্যালের কম্পাঙ্ক (০-২০ কিলোহার্জ), যেখানে রেডিও ওয়েভের কম্পাঙ্ক ৩০০ গিগাহার্জ পর্যন্ত হতে পারে।

হ্যাম রেডিওর এন্টেনা; Image Source: youtube/VK5SW

কম্পাঙ্ক কম হওয়ায় এসব সিগন্যালের শক্তিও কম থাকে, ফলে খুব বেশি দূরে পাঠানো সম্ভব হয় না। তাছাড়া কম্পাঙ্ক কম মানে এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি। তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সাথে এ তরঙ্গকে গ্রহণ (রিসিভ) করার জন্য প্রয়োজনীয় এন্টেনার একটি সম্পর্ক আছে। এন্টেনার দৈর্ঘ্য সাধারণত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অর্ধেক হয়ে থাকে, তাই তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি হলে বিশাল এক এন্টেনার প্রয়োজন হয়। যেমন বিশ কিলোহার্জ কম্পাঙ্কের একটি তরঙ্গের জন্য প্রয়োজন হবে প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ এন্টেনার। এরকম এন্টেনা একদমই বাস্তবসম্মত নয়। 

এ সমস্যা দূর করার জন্য তিনি একটি চমৎকার পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হলেন, যাকে আমরা এখন মডুলেশন হিসেবে জানি। তিনি পরিকল্পনা করলেন, নিম্ন কম্পাঙ্কের অডিও সিগন্যালকে উচ্চ কম্পাঙ্কের তরঙ্গের (ক্যারিয়ার ওয়েভ) সাথে একীভূত করে পাঠাবেন এবং পরবর্তীতে তরঙ্গকে গ্রহণ করার পর অডিও সিগন্যালকে আলাদা করে নেয়া হবে। উপমা হিসেবে বলা যায়, ধরুন আপনি একটি চিরকুটকে (অডিও) দূরে কারো কাছে পাঠাবেন, কিন্তু হালকা কাগজের চিরকুটকে তো দূরে ছোঁড়া যাবে না। তাই আপনি একটি ইটের কণা (ক্যারিয়ার) নিলেন এবং এতে চিরকুটটি বেঁধে ছুড়ে মারলেন। এরপর যিনি চিরকুটটি পেলেন, তিনি ইটের কনা থেকে কাগজটি আলাদা করে নিলেন।

ফেসেন্ডেন এভাবে বেতারযন্ত্রের ডিজাইন করলেন। এখন প্রয়োজন পড়লো উচ্চ কম্পাঙ্কের তরঙ্গের। ফেসেন্ডেনের পরিকল্পনাটি চমৎকার হলেও, তিনি কাজটা একটু আগে করে ফেলেছিলেন। তখনো ট্রায়োড উদ্ভাবিত হয়নি। মানুষ তখন তরঙ্গ উৎপন্নের জন্য মার্কনির ‘স্পার্ক-গ্যাপ’ প্রযুক্তি ব্যবহার করতো। কিন্তু এভাবে উৎপন্ন তরঙ্গ ফেসেন্ডেনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যারিয়ার ওয়েভের চাহিদা মেটাতে অক্ষম ছিল, কারণ এর কম্পাঙ্ক স্থির থাকতো না। ফেসেন্ডেন তো আর হতাশ হয়ে বসে থাকার পাত্র নন, তিনি অন্য পন্থা খুঁজতে শুরু করলেন।

ক্যারিয়ার ও অডিও সিগন্যালকে একীভূত করা; Image Source: electronicspost.com

ক্যারিয়ার ওয়েভ উৎপন্নের জন্য তিনি অল্টারনেটর ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অল্টারনেটর হচ্ছে একধরনের জেনারেটর যা যান্ত্রিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করে এবং আউটপুট হিসেবে এ.সি কারেন্ট প্রদান করে। অল্টারনেটর ব্যবহার করে উৎপন্ন তরঙ্গ তার প্রয়োজনের বেশিরভাগই মেটাতে সক্ষম হয়। এটি উচ্চ ক্ষমতার, স্থির কম্পাঙ্কের তরঙ্গ উৎপন্ন করে। কেবল একটি দুর্বলতা ছিল, এর কম্পাঙ্ক ছিল প্রয়োজনের তুলনায় কম।

কিন্তু কী আর করার! তিনি অল্টারনেটরের ওপরেই বাজি ধরলেন। বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে একটি অল্টারনেটর বানিয়ে নিলেন, যা ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ও ৯০ কিলোহার্জ কম্পাঙ্কের তরঙ্গ উৎপন্ন করতে সক্ষম। এ অল্টারনেটর ব্যবহার করে মোটামুটিভাবে হলেও মানুষের কণ্ঠস্বর পাঠানোর সক্ষমতা আসলো। এবার সে সিগন্যালকে গ্রহণ করার পালা। সে সময়ে রিসিভার হিসেবে ‘কোহেরার’ ব্যবহার করা হতো, কিন্তু এটি তেমন উন্নত মানের ছিল না। গ্যালেনা ডায়োড বা ভ্যাকুয়াম ডায়োড ব্যবহার করে যে উন্নত রিসিভার তৈরি করা হয়েছিল তাও তখন পাওয়া যেত না।

এ সমস্যা দূর করতে ফেসেন্ডেন ব্যারেটার উদ্ভাবন করেন। এটি একধরনের থার্মাল ডিভাইস। যখন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ এতে আসতো তখন এর তাপমাত্রা পরিবর্তন হতো, তাপমাত্রা পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তন আসতো এর রেজিস্ট্যান্সেও আর রেজিস্ট্যান্সের পরিবর্তনকে চিহ্নিত করেই এটি তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের আবির্ভাবকে শনাক্ত করতে পারতো। ব্যারেটারও যে খুব উন্নত কিছু ছিল তাও নয়, তবে কাজ চলতো। সব মিলিয়ে এ পর্যায়ে এসে মোটামুটি চলার মতো একটি সিস্টেম তৈরি হয় ফেসেন্ডেনের।

ফেসেন্ডেনের অল্টারনেটর; Image Source: wikimedia commons

রেডিও নিয়ে এসব কাজ ছাড়াও এদিকে তিনি একটি ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি কোম্পানি শুরু করেছিলেন। তখন ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফির ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য চলছিলো মার্কনির, তার সাথে প্রতিযোগিতা করতেই নেমেছিলেন ফেসেন্ডেন। ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফির কোম্পানিতে রুটিনমাফিক কাজ চালালেও তিনি অধিকাংশ সময় পড়ে থাকতেন তার ঐ পৃথিবীর প্রথম রেডিও ব্রডকাস্টিং এর স্বপ্ন নিয়ে।

প্রয়োজনীয় ডিভাইসগুলো উদ্ভাবিত হওয়ার পর তিনি এবার এর জন্য পূর্ণাঙ্গ একটি সিস্টেম তৈরি করলেন। তার অল্টারনেটর দিয়ে উৎপন্ন করলেন ক্যারিয়ার ওয়েভ। কার্বন মাইক্রোফোনে কিছুটা পরিবর্তন করে ক্যারিয়ার ওয়েভের সাথে অডিও সিগন্যালের মডুলেশনের ব্যবস্থা করলেন আর ব্যারেটার দিয়ে তৈরি করলেন রিসিভার। এরকম বেশ কয়েকটি রিসিভার স্থাপন করলেন বিভিন্ন জাহাজে।

অতঃপর আসলো তার কাঙ্ক্ষিত দিন, ১৯০৬ সালের বড়দিনের সন্ধ্যা। ফেসেন্ডেন পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম রেডিও ব্রডকাস্ট করলেন। ম্যাসাচুয়েটস এর একটি ছোট্ট বার্জ থেকে তিনি সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানালেন এবং একটি ফোনোগ্রাফ থেকে জর্জ হ্যান্ডেলের ‘লার্গো’ সঙ্গীতটি বাজাতে থাকলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন না আদৌ তার এ সঙ্গীত জাহাজের মানুষের শুনতে পাচ্ছে কি না। তবু তিনি তার প্রোগ্রাম চালিয়ে গেলেন। তিনি নিজেও ক্রিস্টমাস ক্যারল ওহ হোলি নাইটের সুর তুলেছিলেন ভায়োলিনে। তার এ প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি, প্রায় দুইশ মাইল দূর পর্যন্ত মানুষ তার প্রোগ্রাম শুনতে পেরেছিল সেদিন।

জাহাজের সবাই অবাক হয়েছিল রেডিওর জাদু দেখে আর এদিকে সফল হয়েছিল ফেসেন্ডের বহুদিন ধরে লালিত স্বপ্ন। কিন্তু এ স্বপ্ন সফল হলেও একটি আফসোস রয়ে গিয়েছিল, যা আগেই বলেছিলাম- তিনি বড্ড বেশি তাড়াতাড়ি এ কাজটি করেছেন। তার রেডিও সিস্টেম বেশি ব্যয়বহুল। বেশ ঝক্কি ঝামেলার হয়েছিল। এর জন্য দরকার ছিল ক্যারিয়ার ওয়েভ তৈরির সহজ কোনো উপায়, যা ট্রায়োডের কল্যাণে এর কয়েক বছর পরেই সম্ভব হয়েছিল। তাছাড়া তিনি প্রকৌশলী হিসেবে যতটা অসাধারণ ছিলেন ব্যবসায়ী হিসেবে যেন ততটাই দুর্বল ছিলেন।

কাজে ব্যস্ত রেজিনাল্ড ফেসেন্ডেন; Image Source:  Bettmann/CORBIS

যদিও তিনি এমন কিছু উদ্ভাবন করে ফেলেছিলেন যা এডিসনও ভেবেছিলেন অসম্ভব। কিন্তু তার এ বিশাল উদ্ভাবনের কথা লোকে জানতেই পারেনি। জনগণকে জানানো বা আত্ম-প্রচার করতে না পারায় তিনি তার এ উদ্ভাবন দিয়ে ব্যবসা করতে পারেননি। তাছাড়া ঐ সিস্টেমের দুর্বলতা তো ছিলই। তবে প্রযুক্তিগত দিক থেকে চিন্তা করলে এটি ছিল এক বিশাল অর্জন। তিনিই প্রথম সম্পূর্ণ একটি রেডিও ব্রডকাস্টিং সিস্টেমের নকশা করেছেন এবং বাস্তবিকভাবেও যে এটি সম্ভব তা প্রমাণ করে গেছেন। তার সে সিস্টেমের উন্নত সংস্করণের ফসল আমরা এখনো উপভোগ করি।

তথ্যসূত্র

Conquering the Electron by Derek Cheung, Eric Brach, page (127-130)

ফিচার ইমেজ- wallpaperstock.net

Related Articles

Exit mobile version