আপনি, আমি, আমরা সবাই প্রতিদিন কম-বেশি ডিজিটাল কোনো মাধ্যমে লিখছি। ঘরের কোনো কম্পিউটারে হোক অথবা হাতের প্রিয় স্মার্টফোনে। মেইল, কোনো ডকুমেন্ট অথবা ফেসবুকে কোনো কমেন্ট বা স্ট্যাটাস দিতে আমরা প্রতিদিনই লিখছি।
স্মার্টফোন অথবা ট্যাবলেট কম্পিউটারে কোনো কিছু লিখতে সাধারণত অনস্ক্রিন কিবোর্ড ব্যবহৃত হয়। আর অনস্ক্রিন কীবোর্ডের দৌড়ে পিছিয়ে নেই চিরচেনা তিন প্রযুক্তিপণ্য প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট, গুগল এবং অ্যাপল। বিকল্প প্রযুক্তিপণ্যের দৌড়ে এই তিন বড় প্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগিতা যেমন অতীতেও ছিল, ঠিক তেমনি আমাদের আঙুলের ডগার নিচে ব্যবহৃত অনস্ক্রিন কীবোর্ডের ক্ষেত্রেও এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের আলাদা আলাদা তিনটি কীবোর্ড রয়েছে।
অ্যাপলের আইওএস কেন্দ্রিক সকল পণ্যে লেখার জন্য সাধারণভাবে আইওএস কিবোর্ড দেয়া থাকে। ঠিক এভাবেই গুগলের পক্ষ থেকে টাইপ করার জন্য জিবোর্ড নামের একটি কিবোর্ড রয়েছে। মাইক্রোসফট অনস্ক্রিন কিবোর্ডের এই প্রতিযোগিতায় ছিল না। কিন্তু সুইফটকি নামের একটি অনস্ক্রিন কিবোর্ড সফটওয়্যার অধিগ্রহণের মাধ্যমে মাইক্রোসফট আর এই দৌড়ে একদমই পিছিয়ে নেই। এই তিন প্রতিষ্ঠানের তিনটি কিবোর্ডেই বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত হচ্ছে। কাংখিত শব্দ প্রেডিকশন, দ্রুত লেখার জন্য বৈচিত্র্যময় নানা সুবিধা এবং ইমোজি- জিআইএফ সম্ভার নিয়ে তিনটি কী-বোর্ডই পরস্পরের প্রতি বেশ শক্ত টক্কর দিচ্ছে।
আইওএস কীবোর্ড
প্রথমে আইওএস কীবোর্ডের কথাই বলা যাক। অ্যাপলের স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেট কেন্দ্রিক এই কিবোর্ডটি খুবই সহজ, সাধারণ ইন্টারফেস, এককথায় কোনোরকম ঝামেলাবিহীন। সোয়াইপ, ইমোজি এবং জিআইএফের বর্তমান রাজত্বে এই কিবোর্ড এখনো তার চিরচেনা পথেই হাঁটছে। আইওএস কিবোর্ডে কোনোরকম ইমোজি এবং জিআইএফ টুলবার নেই। তাহলে এই কিবোর্ড দৌড়ে অ্যাপলের শক্তি আসলে কি?
বস্তুতপক্ষে অ্যাপলের এই সাধারণ কিবোর্ডের একটি স্বকীয়তা রয়েছে। আইওএস ১১ সংস্করণের পরে অ্যাপলের এই কিবোর্ডে ডান হাত এবং বাম হাতের ‘ব্যবহার সুবিধা’ ছাড়া তেমন কোনো বড় ধরনের ফিচারের পরিবর্তন ঘটেনি। আইওএসে ৩য় পক্ষীয় বেশ কিছু টাইপিং এপ্লিকেশন এক্ষেত্রে বেশ কিছু উন্নত সুবিধা প্রদান করলেও অ্যাপল তাদের সাদামাটা চেহারার কিবোর্ডে পরিবর্তন আনতে একটু নারাজই বটে।
তবে অ্যাপল বর্তমানে তাদের ভোক্তাদের চাহিদা এবং ডেভেলপারদের দিকে বেশ নজর রাখছে। ভোক্তারা ঠিক কি চাচ্ছে, ডেভেলপাররা তাদের এপ্লিকেশনগুলো দিয়ে কতটা চাহিদা মেটাতে পারছে- অ্যাপল এই বিষয়গুলো বেশ সতর্কতার সাথে খেয়াল করছে। এর ফলে, পরবর্তীতে প্রয়োজন মনে করলে অ্যাপল বেশ সহজেই বৈচিত্র্যময় সুবিধা সংবলিত একটি কিবোর্ড আনতে পারবে। এক্ষেত্রে যেমন তাদের ঘণ্টার ঘণ্টার পর গবেষণা করতে হবে না, ঠিক তেমনি ব্যবহারকারীর চাহিদাও শতভাগ পূরণ করা সম্ভব হবে।
জিবোর্ড
মোবাইলকেন্দ্রিক সমস্ত পরিসেবাকে একটিমাত্র কিবোর্ডের মধ্যে কিভাবে নিয়ে আসা সম্ভব, গুগল ঠিক সেই কাজটিই করে দেখিয়েছে। স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটে লেখার জন্য গুগলের পক্ষ থেকে জিবোর্ড নামের একটি অত্যন্ত স্মার্ট অনস্ক্রিন কিবোর্ড রয়েছে। অনেক স্মার্টফোনে গুগলের এই কিবোর্ড না থেকে থাকলেও খুব সহজে গুগল প্লে স্টোর থেকে এই কিবোর্ডটি নামিয়ে নেয়া সম্ভব। গুগল তার প্রতিটি পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে হালনাগাদ আপডেট দেয়ার জন্য বিখ্যাত। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই জিবোর্ডও।
জিবোর্ডের সাম্প্রতিক আপডেটে বারে বারে ব্যবহার করা ইমোজি এবং জিআইএফ পরবর্তী সময়ে সহজে আবারো ব্যবহার করার জন্য একটি টুলবার দেয়া হয়েছে। শুধু এই সুবিধাই নয়, নতুন জিবোর্ডে একটি ‘জি’ লোগো রয়েছে। এই লোগোতে ক্লিক করলে একটি ‘বিবর্ধিত কিবোর্ড আউটলেট’ পাওয়া যায়। এছাড়া এই কিবোর্ডের অপশন থেকে গুগল ডুগলের দেখা পাওয়াও সম্ভব। লেখার সময় গুগল সার্চ, ইউটিউব পরিসেবা অথবা গুগল ম্যাপ উপভোগ করার জন্য এই কিবোর্ডের বাইরে যাবার কোনো দরকার নেই, জিবোর্ডে ব্যবহৃত টুলবার থেকেই এসব গুগল পরিসেবা পুরোপুরি উপভোগ করা সম্ভব। গুগলের সব দরকারি পরিসেবা এখন একটি স্মার্ট কিবোর্ডের মধ্যে, গুগল বলে কথা!
গুগলের এই কিবোর্ডের আরেকটি অসাধারণ ফিচার হচ্ছে এর শব্দ প্রেডিকশন ক্ষমতা। বাংলা হোক কংবা ইংরেজি, সার্চ জায়ান্ট গুগলের জিবোর্ড লেখার সময়ে পরবর্তী শব্দ প্রেডিকশনে অত্যন্ত স্মার্ট।
শুধু সুবিধা নয়, জিবোর্ডে সামান্য অসুবিধাও রয়েছে। গুগলের এই কিবোর্ড স্ক্রিনের অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে। সেটিংস থেকে এই আকার পরিবর্তন করে নেওয়া সম্ভব। আসলে গুগলের এই কিবোর্ডকে শুধু একটি কিবোর্ড না বলে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টই বলা ভালো, আসলে বেশি অপশন এবং টুলবার রাখতে একটু বেশি জায়গার দরকার।
সুইফট কিবোর্ড
সুইফট কিবোর্ড বা সংক্ষেপে সুইফট কি প্রথমে একটি স্বতন্ত্র ডেভেলপার এপ্লিকেশন হিসেবে কাজ করলেও মাইক্রোসফট দুই বছর আগে স্মার্টফোনে টাইপ করার এই এপ্লিকেশনটি কিনে নেয়। স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে মাইক্রোসফটের নিজস্ব কোনো টাইপিং এপ্লিকেশন না থাকার কারণে এই ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি গুগল এবং অ্যাপল থেকে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু সুইফট কি অধিগ্রহণের মাধ্যমে মাইক্রোসফট সরাসরি জিবোর্ড এবং আইওএস কিবোর্ডের সাথে প্রতিযোগিতায় নামে।
সুইফট কি ৭.০ সংস্করণ থেকে স্ক্রিনের ঠিক বামপাশে একটি প্লাস প্রতীক রয়েছে। এই প্রতীকটি মূলত কিবোর্ডের টুলবার হিসেবে কাজ করে। টুলবারটিতে বেশ কয়েকটি অপশন রয়েছে। তবে জিবোর্ডের টুলবার থেকে যেমন গুগলের বিভিন্ন ব্রান্ডিং সেবায় (যেমন- সার্চ, ম্যাপ, জিমেইল ইত্যাদি) সরাসরি প্রবেশের সুবিধা রয়েছে, সুইফট কি এর ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু ভিন্ন। মাইক্রোসফট এক্ষেত্রে সুইফট কিবোর্ডে শুধু দরকারি থিম, ক্লিপবোর্ড কন্টেন্ট, ইমোজি, জিআইএফ এবং এগুলো খোঁজার জন্য একটি সার্চ অপশন রেখেছে।
মাইক্রোসফটের সুইফট কি যেন একটু বেশিই স্মার্ট! এই কিবোর্ডে লেখা প্রতিটি শব্দ, ইমোজি এবং জিআইএফএর ব্যবহারগত তথ্য মাইক্রোসফট সংগ্রহ করে। তবে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ব্যবহারকারীদের আরও উন্নত সেবা দেবার জন্যই সুইফট কি’র এই প্রচেষ্টা। ব্যবহারকারীর ব্যবহারের উপর নির্ভর করে সুইফট কি পরবর্তী সময়ে কাংখিত শব্দ বা ইমোজি প্রেডিক্ট করে থাকে। ব্যবহারকারীকে সময় এবং কষ্ট থেকে বাঁচাতে সুইফট কি’র এই প্রচেষ্টা।
সুইফট কি-তে ব্যবহৃত নতুন স্টিকার অপশনটি এন্ড্রয়েডে ব্যবহার করা গেলেও আইওএসে এই সুবিধাটি চালু নেই। মজার বিষয়টি হচ্ছে, এই স্টিকারগুলো এডিট করা যায় এবং পরবর্তী সময়ে ব্যবহার করার জন্য সংরক্ষণ করেও রাখা যায়।
কোন কিবোর্ডটি সবথেকে ভালো?
আইওএস কিবোর্ড, জিবোর্ড এবং সুইফট কি- এই তিন কিবোর্ডের মধ্যে স্বতন্ত্র কোনো বিজয়ী খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তিনটি কিবোর্ডই নিজ নিজ দিক থেকে স্বতন্ত্র। যে কেউই আইওএস কিবোর্ডের সাধারণ ইন্টারফেসকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন, কেননা এই কিবোর্ড সবথেকে ঝামেলামুক্ত। তবে অ্যাপল ব্যবহারকারী না হলে এই কিবোর্ড ব্যবহার করার কোনো রকম সম্ভাবনাই নেই। জিবোর্ডের ক্ষেত্রে পরবর্তী শব্দের সাজেশন ফিচারটি সবথেকে ভালো। আবার অনেকে জিবোর্ডের বাড়তি টুলবার অপশনটি পছন্দ না-ও করতে পারেন। সুইফট কির টুলবার অপশনটি অনেকের কাছে বেশ কাজের মনে হতে পারে। এছাড়া, সুইফট কির কাস্টম স্টিকার সুবিধাটিও অনেকের কাছে (বিশেষ করে বাচ্চা এবং স্টিকারপ্রেমীদের কাছে) বেশ কাজের মনে হতে পারে।
Featured Image- geek.digit.in