বিমানের ব্ল্যাকবক্স দেখতে কি আসলেই কালো?

বিমান যাত্রায় ব্ল্যাকবক্স কেন?

১৭ ডিসেম্বর ১৯০৩, রাইট ব্রাদার্সের উড়োজাহাজ আবিষ্কারের সেই দিনের পর এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে এটি মানবজাতির যাত্রাপথের এমন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে যে, ২০১৬ সালের এক জরিপে দেখা যায় এসে বছরে প্রায় ৬৭ মিলিয়ন ফ্লাইট পরিচালনা করেছে বিশ্বের সব কয়টি এয়ারলাইন্স মিলে! এর মাত্র ২৫০ থেকে ৩০০টি দুর্ঘটনায় পড়েছে, যেখানে ১৯৫০ এর আগে প্রতি ৫০ টি উড়োজাহাজের একটি দুর্ঘটনায় পতিত হতো।

বিমান চালনা, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং তা পরে বিমান নির্মাণ শিল্পে প্রয়োগ করে এই অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছে যে যন্ত্র সেটি হলো ব্ল্যাকবক্স। তাই বিমান দুর্ঘটনায় পড়ার পর দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে যে জিনিসটির সবচেয়ে বেশি দরকার পরে সেটি হলো ব্ল্যাকবক্স। ব্ল্যাকবক্স যার কেতাবি নাম ‘ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার (Flight Data Recorder)’। আজ আমরা বিমানের লেজের প্রান্তে স্থাপিত এবং দেখতে উজ্জ্বল কমলা রঙের যন্ত্রটিকে কেন ব্ল্যাকবক্স বলা হয়ে থাকে। সেই সাথে জানবো এয়ার ক্রাশ ইনভেস্টিগেটররা কীভাবে এই যন্ত্রের মাধ্যমে বিমান দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়ে যাবার পরেও সুনিপুণভাবে তথ্য উদ্ধার করে থাকেন।

বিমানে ব্যবহৃত ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার

নাম কেন ব্ল্যাকবক্স?

দেখতে গাঢ় কমলা রঙের যন্ত্রটিকে কেন ব্ল্যাকবক্স ডাকা হয় তা নিয়ে অনেক মতবাদ প্রচলিত আছে। মূলত আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত করা আছে যে ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডারের রঙ হতে হবে গাঢ় কমলা বর্ণ। এই গাঢ় কমলা রঙ ব্যবহারের কারণ হলো ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার এ ব্যবহৃত হয় উচ্চ তাপ সহনক্ষম গাঢ় কমলা বর্ণের পেইন্ট‌, আর এই বর্ণের তীব্রতা এত বেশি যে বিমানের ধ্বংসস্তুপে এটি সহজেই দৃশ্যমান হয়।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ‘ব্ল্যাক বক্স’ শব্দটি মূলত প্রচলিত ও জনপ্রিয় হয় গণযোগাযোগ মাধ্যমে এর বহুল ব্যবহারের ফলে। বিমান চলাচলে ব্যবহৃত পরিভাষা হিসাবে মূলত ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার বা সংক্ষেপে ফ্লাইট রেকর্ডার হিসাবেই এই যন্ত্রটির পরিচয় উল্লেখ করা হয়ে থাকে। তবে এই শব্দটি প্রচলন করার কৃতিত্ব মিডিয়ার একারই কিনা এই নিয়ে ও সম্পূর্ণ নিশ্চিত নন ভাষাবিদরা।

আরেকটি স্বীকৃত ধারণা অনুযায়ী ব্ল্যাকবক্স শব্দটির উৎপত্তি হয় মূলত প্রথমদিকের বিমান বিষয়ক চলচ্চিত্রগুলো থেকে। যেখানে ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডারকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখানো হয়ে থাকে নিখুঁত কালো রঙের যন্ত্ররুপে।

তবে ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডারকে ব্ল্যাকবক্স হিসাবে ব্যবহারের প্রথম রেকর্ড পাওয়া যায় বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত সংস্থার [Air Accidents Investigation Branch (AAIB)] আগস্ট ১৯৫৮ এর মিটিংয়ে, শব্দটি প্রথম সেই মিটিংয়ে ব্যবহার করেন এডোয়ার্ড নিউটন।

কার আবিষ্কার এই ব্ল্যাকবক্স

ব্ল্যাকবক্সের প্রোটোটাইপ হাতে এর উদ্ভাবক ডেভিড রোনাল্ড ওয়ারেন

অস্ট্রেলিয়ার ডিফেন্স সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির গবেষক ডেভিড ওয়ারেন ১৯৫৭ সালে ব্ল্যাকবক্স বা ফ্লাইট রেকর্ডার উদ্ভাবন করেন।এটি উদ্ভাবনের পর থেকেই বহুল ব্যবহৃত যন্ত্রের মধ্যে একটি হিসাবে পরিণত হয়। এর ব্যবহার শুরু হবার পর বিমান দুর্ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পায়। কারণ আকাশ পথে চলাচলকারী দুর্ঘটনাকবলিত বিমানগুলো থেকে ব্ল্যাকবক্স সংগ্রহ করে বিমান দুর্ঘটনার কারণগুলো আরো নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। পরবর্তীতে বিমান তৈরীতে এবং বিমান চালনা প্রশিক্ষণে এই তথ্যগুলো এক ইতিবাচক পরিবর্তন এর সূচনা করে এই ব্ল্যাকবক্স।

এই যন্ত্র কাজ করে কীভাবে

ব্ল্যাকবক্স বা ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার মূলত দুইটি প্রধান অংশের সমন্বয়ে গঠিত। এদের কাজগুলোর মাধ্যমেই মূলত পুরো যন্ত্রটির কাজ জানা যাবে।

১) ককপিট ভয়েস রেকর্ডার (Cockpit Voice Recorder) – এটি ব্ল্যাকবক্সের প্রধান অংশ এবং এটি মুলত ককপিট বা বিমানের চালনা কক্ষে থাকে। এটি বিমানের চালনাকক্ষের সমস্ত মাইক্রোফোন এবং ইয়ারফোনের শব্দ রেকর্ড করে থাকে। পাইলটদের নিজেদের মধ্যে কথা কিংবা কন্ট্রোল রুমের সাথে কথার সব কিছুই সংরক্ষিত থাকে ককপিট ভয়েস রেকর্ডারে। প্রথম দিকের ককপিট ভয়েস রেকর্ডারগুলো অ্যানালগ তারভিত্তিক রেকর্ডিং সিস্টেম ব্যবহার করতো যা সাম্প্রতিক কালের ম্যাগনেটিক টেপ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার বা ব্ল্যাকবক্স এর ককপিট ভয়েস রেকর্ডার অংশ

তবে সাম্প্রতিক ক্ষেত্রের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় যে পানিতে ডুবে যাওয়া বিমানগুলোর ম্যাগনেটিক টেপ থেকে শব্দ পুনরুদ্ধার করা খুবই কঠিন কাজ।  তাই বর্তমানে ম্যাগনেটিক টেপ এর বদলে সলিড স্টেট মেমরি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

২) আন্ডারওয়াটার লোকেটর বিকন (Underwater Locator Beacon) – বিমান বিধ্বস্ত হয়ে পানিতে ডুবে গেলে এই বিকন বা সনাক্তকারীগুলোর সাহায্যে বিমানের ধ্বংসস্তুপ পানির নীচে ঠিক কোথায় আছে তা জানা যায়।

আন্ডারওয়াটার লোকেটর বিকন / পানিতে নিমজ্জন সনাক্তকারী

এই ধরনের বিকন বা সনাক্তকারীতে মূলত লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যেটি সচল বিমানে কয়েক বছর পরপর বদলানোর প্রয়োজন হয়ে থাকে। এটিতে থাকে বিল্ট ইন ওয়াটার-সুইচ যা যন্ত্রটি পানিতে নিমজ্জিত হবার সাথে সাথে চালু হয়ে যায় এবং চালু হবার পর সর্বোচ্চ ৩০ দিন নাগাদ সংকেত পাঠাতে পারে। তবে ১ জুলাই ২০১৪ এর পর বানানো সকল উড়োজাহাজে যন্ত্রটিতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাটারি ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে যার মেয়াদ ৯০ দিন। এই দুটি অংশ ছাড়াও আরো ক্ষুদ্র কিছু যন্ত্রাংশ ব্ল্যাকবক্সে ব্যবহার করা হয়ে থাকে যা যন্ত্রটিকে আরো শক্তপোক্ত এবং দুর্ঘটনা ঘটার পরেও টিকে থাকতে সহায়তা করে।

লেজেই কেন এই ব্ল্যাকবক্স

ব্ল্যাকবক্স বা ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার মূলত বিমানের লেজের অংশে স্থাপন করা হয়ে থাকে যার ফলে এটি অনেক মারাত্মক দুর্ঘটনায়ও তুলনামুলক কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাক।  নিচে ‘ওয়েস্ট এয়ার সুইডেন ফ্লাইট-২৯৪’ নামক একটি কার্গো বহনকারী বিমানের উদ্ধারকৃত ব্ল্যাকবক্স এর ছবি দেওয়া হলো‌, যেটি ওই বিমানের সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত অংশের মধ্যে একটি এবং এটি থেকে সম্পূর্ণ তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিলো।

“ওয়েস্ট এয়ার সুইডেন ফ্লাইট-২৯৪” নামক একটি কার্গো বহনকারী বিমানের উদ্ধারকৃত ব্ল্যাকবক্স

কত যে খুঁজিলাম তারে

বিমান নিখোঁজ হবার পরেই সকল তথ্য উপাত্ত হাতে নিয়ে শুরু হয় খোঁজাখুজি।  ২০১৪ তে নিখোঁজ হওয়া ‘মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের” ফ্লাইট ৩৭০ এর বোয়িং বিমানটি খুঁজতে সারা বিশ্বের অনেকগুলো দেশ একসাথে কাজ করছিলো। কিন্তু ৩ বছর পেরিয়ে গেছে, আজ অবধি ভারত মহাসাগরে ডুবে যাওয়া এই ফ্লাইট ৩৭০ এর ডানার কয়েকটা অংশ ছাড়া আর কিছুই পায়নি অনুসন্ধানকারীরা।

ব্ল্যাকবক্স ব্যবহার করে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত বিমান খুঁজে পাবার সফলতাও আছে অনেক, ব্রাজিলে ২০০৭ সালে ভুপাতিত হওয়া “গল এয়ারের” ব্ল্যাকবক্সটি খুঁজতে ব্রাজিল সরকার ২০০ আর্মি নিয়োগ দেয় এবং রেকর্ড ৪ সপ্তাহ পর তারা সেটি খুজে পায়।

৪ সপ্তাহ পর খুজে পাওয়া ব্ল্যাকবক্স।

আন্তর্জাতিকভাবে বিমান চলাচল সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার হিসাব অনুযায়ী গড়ে দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার করা হয়ে সম্ভব হয়ে থাকে।

ব্ল্যাকবক্সের অংগীকার‌, নিরাপদ আকাশপথ

ষাটের দশক থেকে বিমানগুলোতে ব্ল্যাকবক্সের বাধ্যতামুলক ব্যবহার আকাশপথে দুর্ঘটনার হার অনেকাংশে কমিয়ে আনে। আকাশপথ নিরাপদ হয়ে উঠে আর যৎসামান্য দুর্ঘটনা ঘটে তাদের পিছনের কারণগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ যেমন- ককপিটে বসে পাইলটদের বলা কথাবার্তা বিশ্লেষণ করে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে যা পরবর্তীতে পাইলটদের ট্রেনিংয়েও পরিবর্তন এনেছে! আর এভাবেই  নিরাপদ আকাশপথ বিনির্মাণে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে ব্ল্যাকবক্স ব্যবহারের মাধ্যমে।

 

This article is in Bangla Language. Its about blackbox of aeroplanes.
References:

1. en.wikipedia.org/wiki/Flight_recorder

2. en.wikipedia.org/wiki/David_Warren_(inventor)

3. en.wikipedia.org/wiki/Underwater_locator_beacon

4. en.wikipedia.org/wiki/Gol_Transportes_Aéreos_Flight_1907

5. en.wikipedia.org/wiki/Malaysia_Airlines_Flight_370

Featured Image: SmartSky

Related Articles

Exit mobile version