কোনো প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে এখন আর আগের মতো চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন হয় না! বই, গাইড, অভিজ্ঞদের জিজ্ঞেস করার আগে প্রথমেই গুগলে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি আমরা সবাই। এমনকি আজকাল কাউকে কোনোকিছুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে, সে-ও অভিজ্ঞদের মতো হেসে বলে, “মিয়া, গুগলে সার্চ লাগাও!” সত্যিই তো, যেখানে খুব সহজেই দু-চারটি কী-ওয়ার্ড ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো নির্ভুলভাবে জেনে ফেলা যায়, সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কষ্ট করে উত্তর খোঁজার প্রয়োজন প্রায় নেই বললেই চলে! আর এভাবেই আমরা গুগলকে পৃথিবীর সবচাইতে জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে চিনি।
এছাড়াও বহু ব্যবহৃত জনপ্রিয় স্মার্টফোন অপারেটিং সিস্টেম ‘অ্যান্ড্রয়েড’ও গুগলেরই পণ্য। কিন্তু বর্তমানে গুগল শুধুমাত্র একটি সার্চ-ইঞ্জিন নয়, নানান নতুন প্রযুক্তির সমন্বয়ে গড়ে উঠা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রযুক্তি-রাজ্যও বটে। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত নানা প্রযুক্তির সাথে কাজ করে যাওয়ার সাথে সাথে অবিশ্বাস্য সব প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে এই কোম্পানিটি, যা ভবিষ্যতের পৃথিবীকে আরও সহজ এবং রোমাঞ্চকর করে তুলবে। আজ এমনই কিছু গুগল প্রযুক্তি সম্পর্কে জানানো হবে।
হোম অটোমেশন
বিগত কয়েক বছর ধরেই আমরা স্মার্টহোম প্রযুক্তির কথা শুনে আসছি। যেখানে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই ঘরের কফি মেশিনটি গরম এক মগ কফি বানিয়ে দেবে। ঘরের তাপমাত্রা বাড়তেই এসির তাপমাত্রা নিজে নিজে কমে যাবে। দূরে থেকেও বাড়ির বিভিন্ন ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করা সহ আরও কত অবিশ্বাস্য কাজই না করা যাবে এই প্রযুক্তির সহায়তায়! ‘হোম অটোমেশন’ নামে সারা বিশ্বব্যাপী পরিচিত এই প্রযুক্তি নতুন কিছু নয়। ‘ইন্টারনেট অফ থিংস‘ প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনার প্রাথমিক পর্যায়েই এই প্রযুক্তির নাম উঠে আসে। ইউএস, ইউকে, কানাডা সহ বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে এই প্রযুক্তির বেশ প্রসার ঘটেছে। তবে তা স্বল্প পরিসরে। ব্যবহারকারীর সংখ্যাও যেমন কম, তেমনি এই প্রযুক্তির আওতাধীন ডিভাইসের সংখ্যাও অনেক অল্প। প্রচুর খরচ আর ডেভেলপার স্বল্পতার কারণে বেশ পিছিয়ে আছে এই প্রযুক্তিটি। আর এখানেই কাজ করে যাচ্ছে গুগল।
হোম অটোমেশনকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গুগল প্রত্যেককে ‘Android@Home‘ নামের সফটওয়্যার ফ্রেমওয়ার্কের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এটি প্রোগ্রামারদের অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম চালিত স্মার্টফোন, ঘড়ি কিংবা ট্যাবকে কফি মেশিন, ওয়াশিং মেশিন, ফ্যান, বাল্ব, ফ্রিজের মতো ঘরের নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ইলেকট্রিক্যাল পণ্যের সাথে ওয়ারলেস নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সহজে সংযুক্ত করতে সাহায্য করবে। এছাড়াও গুগলের Accessory Development Kit পেশাদার এবং শখের নির্মাতাদের সোর্স কোড এবং হার্ডওয়ারের সবিস্তার বিবরণী দিয়ে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম ভিত্তিক পণ্য তৈরিতে সাহায্য করবে। আর হ্যাঁ, ‘গুগল হোম’ নামের একটি পণ্যও গুগল বাজারে ছেড়েছে, যার মাধ্যমে খুব সহজেই প্রাথমিক পর্যায়ের আইওটি ডিভাইসগুলোর সাথে নেটওয়ার্ক স্থাপন করা যাবে। বহুল পরিচিত ‘গুগল এসিসটেন্ট’ এর মাধ্যমে ডিভাইসটির সাথে সংযোগ স্থাপন করা যায়।
রোবট আর্মি
রোবট নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা প্রায় কয়েক যুগ ধরেই। সায়েন্স ফিকশনের বদৌলতে রোবট প্রযুক্তি বিভিন্ন মানুষের কাছে বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, বিভিন্নজন এটিকে বিভিন্নভাবে গ্রহণ করেছে। মোহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের ‘কপোট্রনিকের সুখ দুঃখ‘, আইজ্যাক আসিমভের ‘I, Robot’ এর মতো বই সহ ‘রিয়েল স্টিল’, ‘রোবোকপ’, ‘টার্মিনেটর’ সিরিজের মুভিগুলো দেখে আমরা কল্পনায় ভালো রোবট, খারাপ রোবটের চিত্র আঁকার চেষ্টাও করেছি। ভবিষ্যতে মানুষের সাথে রোবটের ঝামেলার গন্ধও আমাদের নাকে ভেসে বেড়াচ্ছে। যারা একটু আধটু প্রযুক্তি জার্নালগুলোতে চোখ রাখেন, তারা হয়তো জানেন কল্পনার সেই হুবহু মানুষের মতো, সব কিছু পারে এমন রোবট তৈরি না হলেও এই প্রযুক্তিতে পৃথিবী আজ বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। হোন্ডার তৈরি রোবট ‘আসিমো’র দিকে তাকালে তা বেশ ভালোভাবেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
সবার সাথে তাল মিলিয়ে গুগলও এগিয়ে যাচ্ছে সমান তালে, কিংবা একটু বেশি দ্রুতই! মাত্র কয়েক বছর প্রায় আটটি রোবট প্রস্তুতকারক কোম্পানিকে কিনে নিয়েছে গুগল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোম্পানিগুলো হলো বট এন্ড ডলি (Bot and Dolly), অটোফাজ (Autofuss), রেডউড রোবটিক্স (Redwood Robotics), মেকা রবোটিক্স (Meka Robotics)। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা Defense Advanced Research Projects Agency’র জন্য তৈরি করা ‘BigDog’ নামের মিলিটারি রোবট প্রস্তুতকারক কোম্পানি বোস্টন ডায়নামিককেও (Boston Dynamic) কিনে নিয়েছে কোম্পানিটি! তাহলে কি সাই-ফাই সিনেমায় দেখা রোবট আর্মি তৈরি করতে যাচ্ছে গুগল? গুগলের আধা-গোপন ল্যাব ‘গুগল এক্স’ এর কর্মকান্ডগুলো একটু-আধটু প্রকাশ হয়ে গিয়ে যেন আরো ফুঁসিয়ে তুলতে চাইছে এ ধরনের সম্ভাবনাগুলোকে।
যুদ্ধের ময়দানে শব্দ করায় বোস্টন ডায়নামিকের মিলিটারি রোবট প্রকল্প ‘বিগডগ’ এর কাজ বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বোস্টন ডায়নামিক গুগলের অধীনস্থ হওয়ার পর সাম্প্রতিক ‘বিগডগ’ এর আদলেই গুগল ‘হ্যান্ডেল (Handle)’ নামের আরো একটি রোবট তৈরি করেছে। ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার এই রোবটটি চাকাযুক্ত অবস্থায় দু’ঘণ্টায় নয় কিলোমিটার দৌড়াতে পারে, উল্লম্বভাবে প্রায় চার ফুটের মতো উঁচুতে লাফিয়ে বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করতে পারে। এমনকি এটি উপরের অংশের দু’পায়ের সাহায্যে একশ পাউন্ডের মতো ওজনও বহন করতে পারে। এছাড়া মানুষের মতো দেখতে ‘অ্যাটলাস (Atlas)’ এবং ঘোড়ার আদলে তৈরি হওয়া ‘স্পট (Spot)’ এর মতো রোবটগুলোও যেন উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলে দিচ্ছে।
চালকবিহীন গাড়ি
অটোমেশনই ভবিষ্যৎ, আর এ কথা মাথায় রেখেই যেন টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলো সবকিছু নিয়ে এবার মাঠে নেমেছে। বিভিন্ন সেক্টরকে অটোমেশনের আওতায় আনতে কোম্পানিগুলো ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করছে। কেউ কেউ আবার নিজেদের কাজ, মেধা, সময় এবং সর্বোপরি বেশ মোটা অংকের অর্থ বিনিয়োগ করছে একটি নির্দিষ্ট সেক্টরের স্বতন্ত্র পণ্যের উপর।
উদাহরণ হিসেবে ট্রান্সপোর্টেশন সেক্টরের কথাই ধরুন না! গাড়িই সেখানে মুখ্য জিনিস। আর আপনার গাড়িটি যদি চালকবিহীন হয়? যদি নিজেকে নিজে চালিয়ে নিরাপদে আপনাকে নির্দিষ্ট স্থানে নামিয়ে দিয়ে আসে, তাহলে অসাধারণ হবে না? হয়তো চালকবিহীন গাড়ি বাজারজাত করে মোটা অংকের টাকা কামানোর সময় এখনো আসেনি। কিন্তু গুগলের মতো বিলিয়ন ডলার কোম্পানির জন্য কিছু ডলার খরচ করে গবেষণামূলক কাজে পৃথিবীর সবচাইতে উন্নত মস্তিষ্কগুলোকে ব্যবহার করতে সমস্যা হবার কথা নয়। তারা ঠিক এ কাজটিই করছে এবং ছোটবড় কিছু সফলতাকে পুঁজি করে বেশ ধৈর্যের সাথেই লেগে আছে।
গুগল ‘চালকবিহীন গাড়ি’ প্রকল্পটিতে ২০০৯ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। প্রথমাবস্থায় তা একটি Toyota Prius গাড়ি ব্যবহার করে, যেটি দশটি বিভিন্ন ১০০ মাইল দূরত্বের রাস্তা একটানা অতিক্রম করার মাধ্যমে কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। ২০১২ সালের মধ্যে এই পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের ফলাফল হিসেবে প্রায় ৩০০ মাইল রাস্তা পাড়ি দেয় গাড়িটি। সে বছরই গুগল এই প্রকল্পে Lexus RX450h মডেলের গাড়ি ব্যবহার করা শুরু করে এবং আরো কঠিন কঠিন কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে নিজেদের নিয়ে যেতে থাকে। যেমন- তারা গুগলে কর্মরত বিভিন্ন চাকরিজীবীকে অফিসে আসার জন্য এবং সাপ্তাহিক ট্যুরে যাওয়ার জন্য চালকবিহীন গাড়িগুলোকে ব্যবহার করতে উৎসাহিত করে। খোলা মাঠ, হাইওয়ে ছাড়াও জটিল সব রাস্তায় নামাতে থাকে গাড়িগুলোকে। সেখানে একইসাথে জীপ, বাইসাইকেল, মোটর সাইকেল, ট্রাক সহ ছোটবড় বিভিন্ন গাড়ি চলাচল করে।
বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর গুগল প্রথমবারের মতো নিজেদের ডিজাইন করা গাড়ি রাস্তায় নামায় ২০১৫ সালে। ‘Firefly’ ডাকনামের গাড়িটি বিভিন্ন কাস্টম সেন্সর, কম্পিউটারের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। প্রয়োজনে ব্রেক কষা ও পুনরায় চালানোর সক্ষমতা ছিল এর। কিন্তু কোনো স্টিয়ারিং হুইল এবং দৃশ্যমান ব্রেক ছিল না। অর্থাৎ Firefly পুরোপুরি স্বনিয়ন্ত্রিত গাড়ি।
সর্বোপরি ২০১৬ সালে গুগল তার চালকবিহীন গাড়ির প্রজেক্টটিকে ‘Waymo‘ নামের প্রযুক্তি কোম্পানির আওতায় নিয়ে নেয়, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে স্বনিয়ন্ত্রিত চালকবিহীন গাড়িকে পুরো পৃথিবীতে বাজারজাত করার পরিকল্পনা করছে এই বিখ্যাত এবং বিশাল প্রযুক্তি কোম্পানিটি।