গগণচুম্বী অট্টালিকা বলতেই আমরা বুঝি স্টিল অথবা কনক্রিটের কাঠামো বিশিষ্ট ভবন। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেন, শুধুমাত্র কাঠ দিয়েও সুউচ্চ অট্টালিকা নির্মাণ করা সম্ভব? শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, এটা যে শুধু সম্ভব, তা-ই না, ইতোমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অনেকগুলো কাঠের তৈরি সুউচ্চ ভবন নির্মিত হয়েছে এবং আরো অনেকগুলো ভবন নির্মানাধীন আছে।
বর্তমানে কাঠের কাঠামো দ্বারা নির্মিত বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন কানাডার ভ্যানকুভারের ব্রোক কমন্স বিল্ডিং (Vancouver’s Brock Commons)। ১৮ তলা বিশিষ্ট এ ভবনটির উচ্চতা ৫৩ মিটার। নির্মানাধীন আছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার হোহো টাওয়ার (HoHo Tower), যার উচ্চতা হবে ৮৪ মিটার। ২৪ তলা বিশিষ্ট ভবনটির নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার কথা এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে। এছাড়াও, সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ট্রি হাউজ নামে ৪০ তলা একটি গগণচুম্বী ভবন পরিকল্পনার পর্যায়ে আছে, বাস্তবায়িত হলে যার উচ্চতা হবে ১৩৩ মিটার!
তবে এটিই কাষ্ঠনির্মিত ভবনের সর্বোচ্চ সীমা না। স্থপতি এবং প্রকৌশলীদের মতে, কাঠ দিয়ে ১০২ তলা বিশিষ্ট এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের চেয়েও উঁচু বিল্ডিং নির্মাণ সম্ভব। শুধু যে সম্ভব তা-ই না, বরং এ ধরনের বিল্ডিং কনক্রিট বা স্টিলের চেয়েও সাশ্রয়ী, পরিবেশ বান্ধব এবং টেকসই! আর তাই বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বর্তমানে অনেকগুলো কাঠের ভবন নির্মাণাধীন আছে। এবং প্রকৌশলীদের বিশ্বাস, এ সংখ্যা দিনে দিনে আরো বৃদ্ধি পাবে।
কাঠের তৈরি ভবন নির্মাণের ইতিহাস কিন্তু নতুন না। স্টিল এবং কনক্রিট আবিষ্কারের এবং সহজলভ্য হওয়ার আগে কাঠ দিয়েই বিভিন্ন ভবন নির্মাণ করা হতো। জাপানের ১,৪০০ বছর পূর্বে নির্মিত কাঠের প্যাগোডাগুলো শত শত ভূমিকম্প সহ্য করে আজও অক্ষতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এদের ৫৫ মিটার পর্যন্ত উচ্চতা বিশিষ্ট প্যাগোডাও আছে। ৯০০ বছর আগে চীনের লিয়াও সাম্রাজ্যের সময় নির্মিত ফোগোং দুর্গের একটি প্যাগোডার উচ্চতা ৬৭ মিটার, যা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উঁচু কাঠের তৈরি ভবন।
বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন বুর্জ খলিফার মূল কাঠামো কনক্রিটের তৈরি। কিন্তু মাত্র একশো বছর আগেও মানুষের কাছে তা ছিল অকল্পনীয়। ১৯০৩ সালে যখন সর্বপ্রথম কনক্রিটের তৈরি আকাশ ছোঁয়া ভবন তৈরি হয়েছিল, তখন কেউ বিশ্বাসই করতে পারেনি যে এটি বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে। অধিকাংশ মানুষেরই ধারণা ছিল, নিজের ওজনেই এটি ভেঙ্গে পড়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর ইনগলস বিল্ডিং নামের মাত্র ১৬ তলা উঁচু ঐ ভবনটির সাপোর্টগুলো যেদিন সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, এক স্থানীয় সাংবাদিক সেদিন সারা রাত জেগে ছিল এই আশায় যে কখন বিল্ডিংটি ভেঙ্গে পড়বে এবং সংবাদটি সে তার পত্রিকায় পাঠাতে পারবে!
কিন্তু সে সময়ের পরীক্ষামূলক অবস্থান থেকে কনক্রিট ধীরে ধীরে নির্মাণ শিল্পে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পদার্থ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। প্রথমদিকের গগণচুম্বী ভবনগুলোর স্টিল দ্বারা নির্মিত হলেও বর্তমানে সেগুলো নির্মিত হচ্ছে কনক্রিটের মাধ্যমে। এছাড়াও স্টিলের কলাম এবং বিম বিশিষ্ট বিল্ডিংয়েও প্রতিটি তলার মেঝে এবং অনেকক্ষেত্রে দেয়ালগুলো কনক্রিট দ্বারাই নির্মিত হয়। কিন্তু স্টিল এবং কনক্রিটের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আর সে সমস্যাগুলোরই চমৎকার সব সমাধান পাওয়া যায়, যদি বিল্ডিংগুলো নির্মিত হয় কাঠ দিয়ে।
প্রথমত, কনক্রিটের কাঠামো নির্মাণ বেশ সময়সাপেক্ষ। বিম, কলাম এবং স্ল্যাবের উপর ভিত্তি করে এর প্রতিটি তলার কাঠামোগুলোর কনক্রিট শুকাতে এবং ব্যবহারোপযোগী হতে ৭ থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। যেহেতু স্টিলের বিল্ডিংয়েও মেঝেগুলো কনক্রিটের তৈরি হয় এবং এক তলার মেঝের কনক্রিট শুকানো না পর্যন্ত উপরের তলার কাজ করা যায় না, তাই এ পদ্ধতিতে বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ হতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। অন্যদিকে কাঠের বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে সবগুলো বিম, কলাম, প্যানেল যেহেতু কারখানাতেই সঠিক মাপে প্রস্তুত করা হয়, তাই সেগুলোর প্রতিটি তলা তার কয়েক দিনের মধ্যেই জুড়ে দেওয়া সম্ভব হয়। এ পদ্ধতিতে কয়েক মাসের মধ্যেই বিল্ডিং নির্মাণ সম্পন্ন করা সম্ভব।
কনক্রিটের ক্ষেত্রেও অবশ্য প্রি-কাস্ট কনক্রিট ব্যবহার করা সম্ভব, যেখানে বিম, কলাম সহ প্রতিটি কাঠামোগত উপাদান কারখানা থেকেই প্রস্তুত করে নির্মাণক্ষেত্রে নিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কাঠের তুলনায় কনক্রিটে ভর প্রায় ২৫ গুণ বেশি। কাজেই সেগুলোকে স্থানান্তর করা, উপরে ওঠানো, জায়গামতো বসানো, প্রতিটি কাজই তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ এবং ঝুঁকিপূর্ণ।
কাঠের ভবনের আরো অনেক ধরনের উপকারিতা আছে। যেমন, প্রচন্ড ভূমিকম্পেও এগুলো ভেঙ্গে পড়ে না। উদাহরণস্বরূপ চীনের ফোগোং দুর্গের প্যাগোডাটি অন্তত এ পর্যন্ত ৭টি ভূমিকম্পের আঘাত সহ্য করেছে, যার মধ্যে ১৫৫৬ সালের ভূমিকম্পে ঐ অঞ্চলে দশ লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও প্যাগোডাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কনক্রিট ভঙ্গুর পদার্থ, সেই তুলনায় কাঠ অনেক বেশি নমনীয়। ভূমিকম্পের তীব্র কম্পনে কনক্রিটের কলাম যেখানে খুব সহজেই ভেঙ্গে পড়তে পারে, সেখানে কাঠ অনেকটুকু বেঁকে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। বিশ্বের অনেক ভূমিকম্প প্রবণ এলাকাতে তাই কাঠের তৈরি বাড়িঘর বেশি দেখা যায়।
কাঠ দিয়ে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। যেমন কাঠে পানি লাগলেই তাতে পচন ধরে। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তির উন্নতির ফলে কাঠের নির্মিত ভবনগুলোতে এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না। কারণ বর্তমানে কাঠের ফলকগুলো পানিরোধক পদার্থ দ্বারা মুড়ে দেওয়া থাকে। আর পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে কাঠের তৈরি ভবন টিকে থাকতে পারে সহস্রাধিক বছর।
কাঠের আরেকটি বড় সমস্যা হল, কনক্রিট বা স্টিলের তুলনায় কাঠে সহজে আগুন ধরে যায়। কিন্তু বর্তমানে এ সমস্যারও চমৎকার সমাধান আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমানে সুউচ্চ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যে কাঠগুলো ব্যবহৃত হয়, সেগুলো ঠিক প্রাকৃতিক কাঠ না, বরং কাঠের ছোট ছোট টুকরাকে আঠার সাথে জুড়ে দিয়ে তৈরি করা কৃত্রিম কাঠ, যাতে সহজে আগুন ধরে না।
বর্তমানে নির্মাণ শিল্পে প্রধানত বিভিন্ন ধরনের কাঠ ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে আছে Gulam বা Glued Laminated Timber, যেগুলো সাধারণত বিম এবং কলাম তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও বিম বা কলাম নির্মাণে আরেক ধরনের কাঠ ব্যবহৃত হয়, যাকে বলা হয় LVL (Laminated Veneer Lumber), যার ভারবহন ক্ষমতা প্রায় কনক্রিটের কাছাকাছি। তবে সবচেয়ে শক্তিশালী কাঠ হলো CLT (Cross-Laminated Timber), যার ক্ষমতা স্টিলের প্রায় কাছাকাছি। এটি ব্যবহৃত হয় কাঠামোগত দেয়াল, ছাদের প্যানেল প্রভৃতি নির্মাণে।
বিশেষ পদ্ধতিতে নির্মিত হওয়ায় এ ধরনের কাঠে সহজে আগুন ধরে না। এছাড়াও সাধারণত ছোট ছোট টুকরোতেই সহজে আগুন ধরে। কিন্তু যখন একেকটি কলাম, বিম বা প্যানেল অখন্ড অবস্থায় থাকে, তখন সেগুলোতে সহজে আগুন ধরতে পারে না। আমেরিকান উড কাউন্সিল গত বছর একটি পরীক্ষা চালিয়েছিল, যেখানে এ ধরনের কাঠ দ্বারা নির্মিত ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আগুনে ঘরটির সমস্ত আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও CLT দ্বারা তৈরি মূল কাঠামোর কোনো ক্ষতি হয়নি। আগুন ধরা ছাড়াও প্রচন্ড তাপেও যেকোনো ভবনের কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু এদিক থেকে কাঠ সব সময়ই নিরাপদ। প্রচন্ড তাপে কনক্রিট দুর্বল হয়ে যায় এবং স্টিল গলে যায়, কিন্তু কাঠের খুব বেশি ক্ষতি হয় না।
যেকোনো গগণচুম্বী ভবনের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যার সৃষ্টি করে এর ওজন। কনক্রিট এবং স্টিলের তৈরি ভবনগুলোর ওজন এত বেশি হয় যে, এর নিচের তলাগুলোকে এবং ভিত্তিকে প্রচন্ড মজবুত করে তৈরি করতে হয়। কিন্তু কাঠের তৈরি ভবনগুলোর ওজন অনেক কম হওয়ায় এর ভিত্তি ভবনটির ভার বহন করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হয় না। বরং এক্ষেত্রে উল্টো ইচ্ছে করে ভবনগুলোর ওজন বাড়াতে হয়, যেন উপরের দিকের প্রচন্ড বাতাসেও ভবনগুলো দু’পাশে বেশিদূর পর্যন্ত দোল না খায়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য অনেকেই বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি এবং এলিভেটরগুলো কনক্রিট দিয়ে তৈরি করার প্রস্তাব করেন।
যদিও প্রকৃত অর্থে এখন পর্যন্ত নির্মিত কাঠের ভবনগুলোকে গগণচুম্বী বলা যায় না, সেগুলো শুধুই সুউচ্চ ভবন, কিন্তু অনেক স্থপতিরই বিশ্বাস, শীঘ্রই পৃথিবীতে কাষ্ঠনির্মিত সুউচ্চ ভবন নির্মাণের আধিক্য দেখা যাবে। ইংল্যান্ডের একটি কাঠের ভবনের নকশা করা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াহ থিসেলটন আর্কিটেক্ট‘ এর পরিচালক অ্যান্থনি থিসেলটন বলেন,
বিংশ শতাব্দী ছিল কনক্রিটের যুগ। কিন্তু এখন আমরা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে এগোচ্ছি। পুনরায় স্বাগতম, কাঠের যুগে।
ফিচার ইমেজ- vox-cdn.com