পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো প্রকৌশলবিদ্যা হচ্ছে পুরকৌশল বিভাগ বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। আমরা যে বসবাসের জন্য এবং নিজস্ব কাজের জন্য উঁচু উঁচু দালান নির্মাণ করি এবং চলাচলের জন্য ব্রিজ ব্যবহার করি সেগুলো তৈরি একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের কাজ। মূলত Structural Engineer এসব কাজের জন্য নিয়োজিত থাকে।
যে রাস্তা দিয়ে আমরা যাতায়াত করি সেই রাস্তা নির্মাণ, রাস্তার উপর দিয়ে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চলাচলের নিরাপত্তা থেকে শুরু করে তাদের গতিবিদ্যা নিয়ে কাজ করা হয় এই প্রকৌশল বিভাগে, যা Transportation Engineering এর মধ্যে পড়ে। মাটি বা সয়েল নিয়ে কাজ করা হয় এই বিভাগে। উঁচু উঁচু যে দালান নির্মাণ করা হয় সেগুলোর ভিত্তি থাকে মাটির নিচে। এই ভিত্তি হতে হয় মজবুত এবং ভারবাহী। এই ভিত্তি এমনভাবে তৈরি করতে হয় যেন ভূমিকম্প হলেও দালান মাটিতে বসে না যায় বা হেলে না পড়ে। এ বিষয় পড়ানো হয় Geotechinal Engineering এর ভিতর।
পরিবেশ প্রকৌশল (Environmental Engineering) নিয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়। এই বিষয়টিতে যেকোনো পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে গবেষণা করা হয়। ঘরে ঘরে মানুষ যেন বিশুদ্ধ পানি পেতে পারে সেজন্য যে যে বিষয় পড়ানো উচিত তার সব কিছু পরিবেশবিদ্যার মধ্যে পড়ে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যার নাম পানি সম্পদ প্রকৌশল বা Water Resource Engineering। বাঁধ তৈরি, বন্যা এবং খরা নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন ঋতুতে ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় পানি বণ্টন ইত্যাদি বিষয়বস্তু পড়ানো হয় এই বিভাগে।
অনেক পুরনো প্রকৌশলবিদ্যা হলেও ধীরে ধীরে দেখা যাচ্ছে এই বিষয়টি জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এই বিভাগ বন্ধ পর্যন্ত করে দিয়েছে। তুলান বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ইউনিয়ন কলেজ এরকম দুটি প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের নাম দেখলে দেখা যাবে তারা এই নামের সঙ্গে নতুন বিষয়ের শব্দ যোগ করে দিয়েছে। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এই বিভাগের নাম রাখছে Civil and Environmental Engineering। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এই নামের সাথে Building, Geodetic, Infrastructural, Transportation ইত্যাদি শব্দ যোগ করছে। এরকম করার মূল কারণ হচ্ছে শিক্ষার্থীদেরকে আকৃষ্ট করা এবং তাদেরকে এককথায় বোঝানো যে আসলে এই বিষয়ে পড়াশোনা করলে পরবর্তীতে কী কাজ করা যাবে।
সিভিল কথাটি ঐতিহ্যের কারণে আমাদেরকে রাখতেই হবে। কিন্তু বিষয়টিকে আরও আধুনিক করার জন্য অন্য নাম ব্যবহার করা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। হাই স্কুল বা কলেজ পড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বলতে তারা কী বোঝে, তখন দেখা যাবে যে হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী এই বিষয় সম্পর্কে বলতে পারছে। কিন্তু সাথে যদি Environmental Engineering বলা হয়, তাহলে আগের তুলনায় বেশি শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে যারা এই বিষয় সম্পর্কে একটু হলেও জানে।
বর্তমানে মিডিয়ার বদৌলতে ‘অবকাঠামো’ কথাটি সবার মুখে মুখে চলে এসেছে। এই শব্দের ইংরেজি হচ্ছে Infrastructure। পদ্মা কিংবা যমুনা ব্রিজ, বিভিন্ন ফ্লাইওভার, ইউ-লুপ ইত্যাদি তৈরি হওয়ার কারণে ‘অবকাঠামো’ শব্দটি গুরুত্ব পেয়েছে। পুরকৌশল বিভাগের নামের সাথে যদি Infrastructure শব্দটি যোগ করা যায় তাহলে বিষয়টির গুরুত্ব আরও বেশি করে জনগণের কাছে প্রকাশ পাবে।
তবে পুনরায় জনপ্রিয়তা লাভের জন্য সিভিলের সঙ্গে অন্যান্য প্রকৌশলবিদ্যাকে যোগ করতে হবে। এরকমটি করলে দেখা যাবে, একবিংশ শতাব্দীতে এই বিষয়ে যারা পড়াশোনা করছে এবং গবেষণা করছে, তাদের জন্য প্রচুর কাজ লুকিয়ে আছে। সিভিলের সাথে প্রযুক্তির একটি মিশ্রণ ঘটিয়ে চমৎকার সব কাজ করার সুযোগ আছে এই বিষয়ে। আজ সেই বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করা হবে।
Sustainability শব্দটির কথা প্রায়ই শোনা যায়। এ শব্দটির টেকনিক্যাল অর্থ হচ্ছে পৃথিবীতে যতটুকু সম্পদ আছে সেগুলো সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করে, পরিবেশের উপর কোনো প্রভাব না ফেলে, পরিবেশবান্ধব রুপে সেগুলো ব্যবহার করা। অবকাঠামো নির্মাণের বেলাতেও এই বিষয়টি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। কারণ এসব কাঠামো তৈরি করার জন্য যে কাঁচামাল আমাদের প্রয়োজন সেগুলো কিন্তু অপরিসীম নয়। যেসব অবকাঠামোর অনেক বছর বয়স হয়ে গিয়েছে সেসব কাঠামোকে আবার সংস্কার করার জন্য প্রচুর অর্থ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়োজন। পরিবেশবান্ধব উপায়ে এসব কাঠামো তৈরি করার জন্য এখন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজন। যেমন- দালানকোঠার জন্য গ্রিন ডিজাইন তৈরি করা।
অবকাঠামো নির্মাণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয় হচ্ছে এর নির্মাণ খরচ। একবিংশ শতাব্দীর প্রকৌশলীদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কীভাবে অবকাঠামোর বাইরের সৌন্দর্য বজায় রেখে জটিল জটিল ডিজাইন কম খরচে করা যায় সেটার উপায় বের করা। শুধু খরচ কম রাখলেই হবে না, কম খরচে ভালো কাঁচামাল ব্যবহার করে অনেক বেশি স্থায়িত্ব নিয়ে এই কাঠামো তৈরি করতে হবে। এই খরচের ভিতর কিন্তু আবার কাঠামো নির্মাণ করার পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কার- এই দুটোর জন্য যে খরচ হবে সেটাও ধরতে হবে। বিষয়টি একটু জটিল মনে হতে পারে। কিন্তু যেসব কাঠামোর ডিজাইন এই পদ্ধতি অনুসরণ করবে সেসব অবকাঠামো Sustainable শব্দটির প্রতিনিধিত্ব করবে। এটা নিয়ে আরও বেশি গবেষণার প্রয়োজন। ইতোমধ্যে এ ধরনের কাজের জন্য গাণিতিক একটি উপায় বের করা হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে “Life-cycle Cost Optimization”।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রত্যেক প্রকৌশলীকে নিজ বিষয়ের বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হবে। অন্যান্য বিভাগ কিংবা বিষয়াদির সাথে সিভিলের বিভিন্ন কাজকে যুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। নতুন নতুন প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করতে হবে। বিখ্যাত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হোজ্জাত আদেলি একবার বলেছিলেন, পুরকৌশল বিভাগে অনেক ধরনের জটিল জটিল বিষয় আছে যেগুলোর সমাধান করার জন্য অন্য বিষয়ের সাহায্য নেয়া জরুরি।
সিভিলে যা যা পড়ানো হয় সেগুলোর সাথে যদি অন্যান্য প্রকৌশল বিভাগে বিষয়বস্তু এক করা যায়, তাহলে যেকোনো কঠিন সমস্যা সহজেই সমাধান করা সম্ভব। প্রোগ্রামিংয়ের কথা আমরা ধরে নিতে পারি। এখন প্রোগ্রামিং করে সিভিলের জন্য বড় এবং দামি সফটওয়ার তৈরি করা হচ্ছে। যেমন- Autocad, Civil 3D, Revit, StaadPro, Etabs ইত্যাদি। আবার অনেকে নিজেদের মতো করে প্রোগ্রামিং শিখে বিভিন্ন ডিজাইন নিমিষেই করে ফেলতে পারছে। অবকাঠামোর কোথায় কতটুকু ফাটল ধরেছে সেগুলোImage Processing এর সাহায্যে বের করা যায়। এমনকি আগে থেকে ভবিষ্যদ্বাণীও করা যায় যে কোথায় কোথায় ফাটল ধরতে পারে এবং কতটুকু ধরতে পারে।
আর্কিটেকচার, মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, কম্পিউটার ইত্যাদি প্রকৌশলবিদ্যা এবং গণিত, পদার্থবিদ্যা, অর্থনীতি, পরিসংখ্যান ইত্যাদি বিষয় এক করে সিভিলে ব্যবহার করলে এই বিভাগটিকে সময়োপযোগী এবং আরও আধুনিক করা যেতে পারে। যদিও এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরকৌশলের সিলেবাসে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, অর্থনীতি, ইলেকট্রিক্যালের দুই বা তিন ক্রেডিটের কোর্স রাখা হয়, কিন্তু সেগুলো কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে করানো হয় সেখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়।
সিভিলের কোর্সগুলোতে Intelligent System কীভাবে তৈরি করা যায় এবং এগুলো কীভাবে ব্যবহার করা যায় এসব বিষয়াদি রাখা যেতে পারে। মেশিন লার্নিং, নিউরাল নেটওয়ার্ক, প্যাটার্ন রিকগনিশন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদির প্রয়োগ বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রযুক্তি নির্মাণ সহজ হয়ে যাচ্ছে। স্পিচ রেকগ্নিশন এবং ভয়েস রিকগনিশন দিন দিন নিখুঁত হচ্ছে। অনেক কোম্পানি এগুলো ব্যবহার করছে তাদের গাড়ির জন্য স্মার্ট ব্রেক তৈরি করতে। এই স্মার্ট ব্রেক নিয়ে Transportation Engineering– এ পড়ানো যেতে পারে এবং এর নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে।
এখন Smart City তৈরির দিকে সবাই জোর দিচ্ছে যেটা হবে একাধারে সবুজ, পরিবেশবান্ধব, উন্নত প্রযুক্তি সম্পন্ন এবং এসব শহরে Smart Intelligent Freeway System থাকবে। এসব রাস্তার নিচে নিচে আধুনিক ডিটেক্টর থাকবে এবং এসব ডিটেক্টরের সাথে রাস্তার উপর চলাচল করা গাড়ির একটি সংযোগ থাকবে। গাড়ি চলাচলের ডাটা নিয়ে সেটার উপর গাণিতিক বিশ্লেষণ করে কোথায় কী ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে সেগুলোর সংকেত ৩০-৬০ সেকেন্ডের মধ্যে বুঝিয়ে দিতে হবে। বর্তমানে উন্নত দেশগুলোর ফ্রিওয়েতে ডিটেক্টর লাগানো থাকে। সেখান থেকে ডাটা দিয়ে আগেভাগে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জাপানে কাজ হচ্ছে, যাকে বলা হয়ে থাকে Real-time Crash Prediction Model।
উপরে যে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলো এসব বিষয় নিয়ে এখন আধুনিক বিশ্বে কাজ হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো এখানে পিছিয়ে আছে। এসব কাজ আমাদের দেশে নিয়ে আসার জন্য জনবল দরকার। এই জনবল তৈরি করার একমাত্র মাধ্যম বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব পড়ানোর জন্য যোগ্য শিক্ষক দরকার এবং তাদের পড়ানোর সিলেবাসের মধ্যে এসব বিষয় আনয়ন জরুরি। একবিংশ শতাব্দীতে পুরকৌশলবিদদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এ ধরনের নতুন প্রযুক্তি তৈরি এবং সেগুলোর প্রয়োগ।
পরবর্তী পর্বে পুরকৌশলে কী কী প্রযুক্তি এবং নতুন নতুন গাণিতিক ফর্মুলা ব্যবহার করে নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কার করা যেতে পারে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে।