একটা সময় প্রিয়জনের অসুস্থতার সময় রক্তের প্রয়োজন হলে সে এক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতো। কারণ চিকিৎসকরা সবসময় পরামর্শ দিয়ে থাকেন যাতে তাৎক্ষণিকভাবে সংগৃহীত রক্ত দেওয়া যায়। রক্তের গ্রুপ মিলে গেলে তো আর সমস্যা থাকতো না, তবে চট করে একই গ্রুপের রক্তদাতা পাওয়া না গেলে তখন নিজেদের অসহায়ত্ব টের পাওয়া যেত। তবে আজকাল ফেসবুকের কল্যাণে রক্ত সংগ্রহ করাটা আগের চেয়ে অনেক বেগবান হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুক সাম্প্রতিককালে রক্তদান সম্পর্কিত একটি ফিচার যোগ করে তাদের ওয়েবসাইটে। এর মাধ্যমে ফেসবুক ব্যবহারকারী হিসেবে যে কেউ তার রক্তের গ্রুপ লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে একজন রক্তদাতা হিসেবে নিবন্ধিত হতে পারবেন। রক্তের প্রয়োজনে যে কেউ নিজের চাহিদা জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করলে তার এলাকার আশেপাশে রক্তদাতা হিসেবে নিবন্ধিত সকলের কাছে নোটিফিকেশন চলে যাবে। সেখান থেকে ইচ্ছুক যে কেউ রক্ত গ্রহীতার উপকারে এগিয়ে আসতে পারবেন।
আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে ফেসবুক এতটা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে যে এখন আমাদের যেকোনো কাজের সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে প্রথমে ফেসবুকের কথাই মনে আসে। তবে ইদানীংকালে ফেসবুকের গোপনীয়তা নীতির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রযুক্তি জগতের রথীমহারথীরা অনেকেই মতামত দিয়েছেন, ফেসবুকের টিকে থাকাটা কঠিন হবে। আবার এর বিপরীত মন্তব্যও করেছেন অনেকেই। ব্যবহারকারীদের কাছে নিজের প্রতিষ্ঠানকে মার্ক জাকারবার্গ কতটা আস্থাভাজন হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন, বিতর্কের ঝড় সামলে কোন পথে এগোতে যাচ্ছে টিম ফেসবুক আর কেমনই বা হতে যাচ্ছে ফেসবুকের ভবিষ্যৎ- এসব নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা
বেশ কিছু মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলাফল হিসেবে ফেসবুক নিজেকে প্রযুক্তির দুনিয়ায় এক মস্ত বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মাত্র ১৪ বছরে বাজার মূলধনের হিসেবে ফেসবুক আজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের একটি। এর বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২.২ বিলিয়ন, যেটি ক্যাথলিক চার্চের অনুসারীর চেয়েও বেশি! সুনিশ্চিত সাক্ষ্যপ্রমাণ বলছে, বেশ কিছু ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এর প্রতি গ্রাহকদের ভালোলাগা অনস্বীকার্য। পরিবার, বন্ধু অথবা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঘুমের চেয়ে গ্রাহকরা বরং ফেসবুকে সময় কাটানোতেই বেশি আগ্রহী।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ফেসবুকের ব্যবসা নীতি প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ায় গত তিন-চার মাসে ফেসবুকের আর্থিক লোকসান হয় ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। মে মাসে প্রণীত ইউরোপের নতুন গোপনীয়তা আইনের কারণে আসন্ন দিনগুলো ফেসবুকের জন্য হতে যাচ্ছে আরও চ্যালেঞ্জিং।
প্রযুক্তির বাজারে গ্রাহকদের মাঝে ফেসবুকের তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জনের পিছনে কারণ মূলত দুটি। প্রথমত, ফেসবুকের ধারাবাহিকভাবে সৃজনশীলতার প্রমাণ দিয়ে যাওয়া, এবং দ্বিতীয়ত, গ্রাহক চাহিদার সাথে দ্রুত নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক স্কট গ্যালোওয়ে তার সাড়াজাগানো বই The Four: The Hidden DNA of Amazon, Apple, Facebook, and Google বইয়ে এই বিষয়ে বলেন, “পুরনো ফিচারের বিলুপ্তি ও নতুন ফিচার যোগ করার ক্ষেত্রে ফেসবুকের তৎপর মনোভাবই একে বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি এনে দিয়েছে। গ্রাহকদের অসন্তোষের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে দ্রুততার সাথে সমস্যা সমাধানের যে চর্চা সেটি ফেসবুকের অন্যতম বড় শক্তি।”
গ্রাহকরা যখন আপাতদৃষ্টিতে বিন্যামূল্যে ফেসবুক ব্যবহার করে যাচ্ছেন তখন প্রযুক্তি দুনিয়ার এই নামী প্রতিষ্ঠানটি প্রায় পাঁচ মিলিয়ন বিজ্ঞাপনদাতা থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। প্রত্যেক গ্রাহকের কার্যক্রমের উপর কর্তৃপক্ষের রয়েছে সজাগ দৃষ্টি। কোনো বিজ্ঞাপনদাতা যদি ব্যক্তি বিশেষকে উদ্দেশ্য করে বিজ্ঞাপন দিতে চায় সেক্ষেত্রেও গ্রাহকের সব ধরনের তথ্য রয়েছে ফেসবুকের কাছে। ফলাফল হিসেবে বিজ্ঞাপন এখন আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট। এই চমৎকার কাজটির মাধ্যমেই গ্রাহকদের কাছে বিজ্ঞাপন দেখানোর বিনিময়ে যে বিশাল অঙ্কের অর্থ উপার্জনের যে একচেটিয়া সুযোগ ছিল গুগলের, তাতে এখন ভাগ বসেছে ফেসবুকের। বর্তমান পৃথিবীতে ডিসপ্লে অ্যাডভার্টাইজিং বা পর্দায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে ফেসবুক।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হচ্ছে ফেসবুক আমাদের সম্পর্কে আমাদের বন্ধু বা পরিবারের চেয়েও বেশি জানে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এটি যেমন ফেসবুককে অনন্য অবস্থান দান করেছে তেমনি তা গ্রাহকদের জন্য যথেষ্ট বিপদ ডেকে আনতেও সক্ষম। মে মাস থেকে কার্যকর ইউরোপের নতুন গোপনীয়তা নীতি– General Data Protection Regulation (GPDR) এর কারণে টেক জায়ান্ট ফেসবুকের ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও শঙ্কার মুখে।
ফেসবুকের সাম্প্রতিক ব্যর্থতা
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে মার্কিন কংগ্রেসের মুখোমুখি হতে হয়। এই বৈঠকে মার্ক সংসদকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তার সৃষ্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (যেটির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যকার যোগাযোগ দৃঢ় করা) পশ্চিমা গণতন্ত্রের জন্য কোনোভাবেই হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না এবং ব্যবহারকারীদের তথ্যকে কখনোই অবজ্ঞার চোখে দেখবে না। ব্রিটিশ রাজনৈতিক পরামর্শ সংস্থা কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ফেসবুক থেকে ৫০ মিলিয়ন গ্রাহকের তথ্য অবৈধ উপায়ে সংগ্রহ করে তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে। ফেডারেল নিয়ন্ত্রক এবং রাষ্ট্রীয় কৌসুলিরা জরুরী ভিত্তিতে তলব করলেন জাকারবার্গকে তার প্রতিষ্ঠানের এহেন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার ব্যাখ্যা চেয়ে। সংবেদনশীল এই ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর মাত্র দুই মাসের মাঝেই বিনিয়োগকারীরা ফেসবুক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করলেন এবং অর্থের হিসেবে এই ক্ষতির পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও অধিক।
সামনের দিনগুলোতে ফেসবুকের পরিকল্পনা
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে যদিও ফেসবুককে বেশ টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, তবুও কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতের জন্য ভেবে রেখেছে বেশ কিছু অসাধারণ আইডিয়া। MIT Technology Review এর ভাষ্যমতে, ফেসবুক আগামী দশ বছরে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এবারে চলুন জেনে নেওয়া যাক সেসবের কথা।
বট হতে যাচ্ছে ব্যবহারকারীর নতুন বন্ধু
মেসেঞ্জারে স্বয়ংক্রিয় বট ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ফেসবুক বিভিন্ন কোম্পানির সাহায্য নিচ্ছে। এই ধরনের বিজনেস বটের সাহায্যে গ্রাহকরা এখন থেকে ফুল, বার্গার ঘরে বসেই কিনতে পারবেন অথবা বটের কাছেই জানতে পারবেন আবহাওয়ার পূর্বাভাস। এখন পর্যন্ত ফুল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান 1-800-Flowers.com, Burger King এবং ডাচ এয়ারলাইন KLM এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এই পদ্ধতি সাফল্যের মুখ দেখলে সন্দেহাতীতভাবে ফেসবুক বিশাল অঙ্কের রাজস্ব উপার্জনের পথে এগোচ্ছে। তবে এখনও নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে, একজন গ্রাহক সাধারণ অ্যাপ বা ওয়েবসাইট ব্যবহার করে কেনাকাটার বিকল্প হিসেবে মেসেঞ্জার বিজনেস বট ব্যবহারের প্রতি আকৃষ্ট হবেন কি না।
নিউজফিডে ভিডিওর সংখ্যা বৃদ্ধি
ফেসবুকের নিজস্ব তথ্যমতে, ব্যবহারকারীরা আপলোড করা ভিডিওর চেয়ে লাইভ ভিডিও দেখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং এসব ভিডিওতে তারা স্বাভাবিকের তুলনায় দশগুণ বেশি কমেন্ট করে থাকেন। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসন্ন দিনগুলোতে গ্রাহকদের লাইভ ভিডিও দেখার এই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পাবে। ফেসবুকের ডেভেলপার টিম তাই এখন চেষ্টা করছে যেকোনো ডিভাইস থেকে (ড্রোন) গ্রাহকের নিউজ ফিডে যেন লাইভ ভিডিও সম্প্রচার করা যায়।
নতুন অ্যালগরিদমের সংযোজন
ফেসবুক ধীরে ধীরে আরও উন্নত ইমেজ প্রসেসিং অ্যালগরিদমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ফেস রিকগনিশন প্রযুক্তির বদৌলতে একজন ব্যবহারকারী কোনো গ্রুপ ছবি আপলোড করলে তাতে উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে নোটিফিকেশন চলে যায় যে ওই নির্দিষ্ট ছবিতে তিনি আছেন কি না। এর ফলে ফটো ট্যাগিং সুবিধা আরও বেগবান হয়েছে। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তিটিই আরও শক্তিশালী কোডের উপর নির্ভর করে গ্রাহককে সুনির্দিষ্ট ছবি অথবা ভিডিও খোঁজার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। যেমন- একজন গ্রাহক তার অনেক আগে পোস্ট করা একটি ভিডিও অথবা ছবি খুঁজতে চাচ্ছেন, কিন্তু তার হয়তো সঠিক দিনক্ষণ মনে নেই। সেক্ষেত্রে তিনি ছবিটির প্রাথমিক একটি বর্ণনা লিখে সার্চ করলেই তার কাঙ্ক্ষিত ছবিটি পেয়ে যাবেন।
বদলে যাবে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির রকমফের
বর্তমানে বাজারে ফেসবুকের দুটি ভিআর সেট আছে। একটি তাদের নিজেদের যার নাম Oculus Rift এবং আরেকটি স্যামসাংয়ের সাথে যৌথ উদ্যোগে যেটিকে বলা হচ্ছে Gear VR । এখন পর্যন্ত ভার্চুয়াল রিয়েলিটির যে ধারণাটি সবচেয়ে জনপ্রিয় সেটি হচ্ছে এটি শুধু নির্দিষ্ট প্রযুক্তি সহায়ক পরিবেশেই সীমাবদ্ধ থাকার মতো কিছু। প্রচলিত এই ধারণাকে ভেঙে দিতে যাচ্ছে ফেসবুক এবং একে তারা বলছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সামাজিকীকরণ, অর্থাৎ এর মাধ্যমে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কোনো নির্দিষ্ট পরিবেশ, ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের অধীনে না থেকে বরং হয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণভাবে সকলের জন্য উন্মুক্ত।
সাম্প্রতিক ব্যর্থতা কি ফেসবুকের হারিয়ে যাওয়ার কারণ হবে?
সর্বশেষ ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির পরও গ্রাহকরা ফেসবুক বর্জন করেননি, বরং উত্তরোত্তর এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রযুক্তির বিশ্বে ফেসবুক তাদের জন্য এমন একটা দৃঢ় অবস্থান তৈরি করেছে যে একচেটিয়া ব্যবসা করা তাদের জন্য কঠিন কিছু না। ইন্টারনেট ব্যবস্থার নতুনীকরণের মাধ্যমে তারা জনসাধারণের আরও বেশি কাছে পৌঁছে যাবে।
ইউনিভার্সিটি অফ কোপেনহেগেনের গবেষণানুযায়ী, ফেসবুক মানুষকে একাকীত্ব এবং বিষণ্ণতা উপহার দেয়। গ্রাহকরা নিত্যদিন ফেসবুক ব্যবহার করছে কি না, এটিই ফেসবুকের একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। গ্রাহকদের সন্তুষ্টি কিংবা এ থেকে উপকৃত হওয়া এসব কিছুই প্রকৃতপক্ষে ফেসবুকের মাথাব্যথার কারণ নয়। ব্যবহারকারীদের কাছে জনসমক্ষে জাকারবার্গ ক্ষমা চাইলেও তার প্রতিষ্ঠানের প্রধানতম উদ্দেশ্য সবসময়ই গ্রাহকদের ডেটা মাইনিং করে নিজেদের ব্যবসার চাকা সচল রাখা। তাই বলা যায়, মানুষ তার নিজের জীবনে ফেসবুকের ক্ষতিকর প্রভাব বুঝে যতক্ষণ পর্যন্ত এটিকে বর্জন না করছে, ততক্ষণ ফেসবুক নামক টেক জায়ান্ট প্রযুক্তির দুনিয়ায় বহাল তবীয়তেই টিকে থাকবে।
ফিচার ইমেজ: bbc.com