বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত প্রযুক্তির ডিভাইসগুলো দুটি জিনিসের সমন্বয়ে তৈরি- হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার। দুটি ক্ষেত্র একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হলেও হার্ডওয়্যার হচ্ছে ভৌত সত্ত্বা, অর্থাৎ এর বাস্তব রূপ রয়েছে। প্রথমে যদি হার্ডওয়্যার তৈরি করা না হয়, তাহলে সফটওয়্যার তৈরি করা যেমন অর্থহীন, তেমনি কোনো হার্ডওয়্যারের জন্যও যদি উপযুক্ত সফটওয়্যার না থাকে- তাহলে তার পূর্ণ ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রতিটি সফটওয়্যার সমানভাবে তৈরি করা হলেও হার্ডওয়্যার কিন্তু সমানভাবে তৈরি করা না-ও হতে পারে।
ধরুন, আপনি ও আপনার বন্ধু বাজার থেকে একই মডেলের দু’টি ফোন কিনলেন কিন্তু ব্যবহারে দেখা গেলো একই মডেল হওয়া সত্ত্বেও আপনার বন্ধুর ফোনটি আপনারটির থেকে ভালো কাজ করছে। সিলিকন লটারির ধারণা অনেকটা এমনই। তবে এই টার্মটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় কম্পিউটিং ডিভাইস, যেমন প্রসেসর কিংবা গ্রাফিক্স কার্ড সমুহে।
প্রসেসর তৈরি এবং বিনিং
সিলিকন লটারি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে হলে প্রথমে চিপ তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে হবে। প্রতিটি ইলেকট্রনিক চিপ যেমন প্রসেসর, গ্রাফিক্স কার্ড কিংবা ডির্যাম (DRAM-Dynamic RAM) তৈরি করা হয় সবচেয়ে বিশুদ্ধ সিলিকনের ডিস্ক দিয়ে। একটি চিপ তৈরি করার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং এতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। এজন্যই প্রতিটি ব্যাচ তৈরির সময় খেয়াল রাখা হয়, যাতে করে সবচেয়ে কস্ট-ইফেক্টিভ প্রক্রিয়ায় কাজটি সেরে ফেলা যায়।
সিলিকন ডিস্কগুলো ওয়েফার নামেও পরিচিত। ইনটেল, গ্লোবাল ফাউন্ড্রিস এবং টিএসএমসি’র মতো কোম্পানিরা প্রতি বছর লক্ষাধিক ওয়েফার তৈরি করে। ওয়েফারে থাকা কোটি কোটি ট্রানজিস্টরে ফ্যাব্রিকেশন বা লিথোগ্রাফির মাধ্যমে ইঞ্জিনিয়ারদের করা সূক্ষ্ম নকশা ছাপা হয়ে থাকে। ওয়েফারগুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়, এজন্য উৎপাদন কক্ষকে একদম প্রেসারাইজড রাখা হয়, যাতে করে কোনো ব্যাকটেরিয়া বা ধুলো না থাকে। কর্মীদেরও পিপিই পরতে হয়। নিজেদের সুরক্ষাতে নয়, চুল কিংবা ত্বককোষের কোনো অংশ যাতে যন্ত্রে প্রবেশ না করতে পারে, সেজন্য।
ওয়েফারগুলো তৈরির পর অনেক দৃষ্টিনন্দন দেখায় এবং অত্যন্ত মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রতিটি ৩০০ মিলিমিটারের একটি ওয়েফার তৈরিতে ৪০০-৭০০ ডলার পর্যন্ত খরচ হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে সময় লেগে যায় প্রায় কয়েকমাস। এই ওয়েফারগুলো ভাগ করেই চিপ বা ডাই তৈরি করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে তৈরির খরচ অনুপাতে বিক্রি করা হয়।
সমস্যা বাঁধে ওয়েফারগুলো কাটতে গিয়ে। যদিও হীরের করাত দিয়ে কাটা হয়, তবুও ওয়েফারের প্রান্তের দিকগুলো অসম্পূর্ণ থাকার জন্য একটি বিশাল অংশ (৫-২৫ শতাংশ) ফেলেই দিতে হয়। বাকি সমানভাবে কাটা অংশগুলো প্রসেসর, গ্রাফিক্স কার্ড ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক সামগ্রীতে পরিণত হয়, যা আমরা সচরাচর দেখি।
এবার বলা যাক বিনিং প্রক্রিয়া নিয়ে। বিনিং এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে প্রসেসর, গ্রাফিক্স কার্ড বা র্যামের প্রস্তুতকারীরা তাদের পণ্যগুলোকে বিল্ড কোয়ালিটি এবং পারফরম্যান্স অনুযায়ী ভাগ করে। একটি ফ্যাব্রিকেশন প্লান্ট বা উৎপাদন কারখানায় ব্যবহৃত প্রযুক্তি যতই উন্নতমানের হোক না কেন, তাতে ভগ্নাংশ পরিমাণ ত্রুটি থেকেই যায়। সেটি হতে পারে কারখানার যন্ত্র বা কাঁচামালে। যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, ১০০ ভাগ বিশুদ্ধ ওয়েফার তৈরি সম্ভব নয়। একটি ওয়েফারকে কয়েকবার স্ক্যানিং প্রসেসের মাধ্যমে দিয়ে যেতে হয়। যদি ত্রুটি বেশি হয়, তাহলে পুরো ওয়েফারটি বাতিল হয়ে যেতে পারে। সব ত্রুটি অবশ্য গুরুতর নয়। এভাবে সচল ওয়েফারগুলোকে আলাদা করা হয় এবং পুনরায় প্রসেসর কিংবা চিপের মাপ অনুসারে কাটা হয়। কিন্তু এসবের পরেও চিপগুলোতে কিছু অসামঞ্জস্য রয়েই যায়।
প্রতিটি প্রসেসর চলতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভোল্টেজের প্রয়োজন হয়। কোন প্রসেসর কত ভোল্টেজে সবচেয়ে ভালো কাজ করছে, কম তাপ উৎপন্ন করছে এসব পরীক্ষা করার প্রক্রিয়াকে ইয়েল্ডিং বলা হয়। কোনো চিপ হয়তো বেশি ভোল্টেজে কাজ ভালো করবে, আবার কতগুলো হয়তো ওই ভোল্টেজে বেশি তাপ উৎপন্ন করবে; আর কিছু হয়তো আশানুরূপ ফলই দেবে না। তবে সবই কিন্তু এসেছে একই সিলিকন ওয়েফার থেকে।
এজন্যই আমরা প্রসেসর ও গ্রাফিক্স কার্ডের কয়েকটি লাইন-আপ দেখতে পাই। যেমন ইন্টেলের কোর আই ৩, আই ৭ কিংবা রাইজেন ৫ বা রাইজেন ৯। এক্ষেত্রে যা ঘটে, তা হচ্ছে যেসব চিপ কম পারফরম্যান্স দেয়, সেগুলোকে এন্ট্রি লেভেলে রাখা হয় এবং যেগুলো ভালো পারফর্ম করে, সেগুলোকে উচ্চ সারিতে রাখা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাইজেন ৭ সিরিজের প্রসেসরগুলো সাধারণত ৮ কোর বিশিষ্ট হয়ে থাকে, পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেল, আটটির মাঝে দু’টি ঠিকভাবে কাজ করছে না। তখন সেগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং ৬ কোর বিশিষ্ট রাইজেন ৫ হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়। এভাবেই প্রতিটি কোম্পানি তাদের চিপ ভাগ করে এবং আমরা ৪, ৬ কিংবা ১২ কোর বিশিষ্ট প্রসেসর দেখতে পারি। এটিই হচ্ছে বিনিং।
এখন যদি একই বিনিং এবং একই মডেলের দু’টি চিপ পরীক্ষা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, একটি সামান্য হলেও অপরটির থেকে ভালো পারফর্ম করছে। আর একেই বলে সিলিকন লটারি।
লটারিতে যাদের নাম ওঠে!
প্রতি ক্লাসে যেমন কিছু অত্যাশ্চর্য শিক্ষার্থী থাকে, তেমন প্রতিটি সিলিকন ওয়েফার থেকেও কিছু চিপ বের হয়, যেগুলো তাদের প্রত্যাশিত মানের চেয়েও খুব ভালো পারফর্ম করে। এগুলোকে একটু যত্ন করে আলাদা করে রাখা হয় এবং ‘আনলকড’ হিসেবে বিক্রি করা হয়।
আনলকড প্রসেসর সম্পর্কে জানতে হলে আগে জানতে হবে, প্রসেসর ক্লক স্পিড সম্পর্কে। ক্লক স্পিড বলতে বোঝায়, কোনো প্রসেসর একটি নির্দেশনা কত দ্রুত গ্রহণ এবং প্রয়োগ করতে পারে। এটি পরিমাপ করা হয় গিগাহার্জে। প্রতিটি প্রসেসরের দুইটি মান থাকে, একটি হলো বেজ ক্লক আরেকটি বুস্ট ক্লক। বেজ ক্লক হচ্ছে সম্পূর্ণ লোডে প্রসেসরটি সর্বনিম্ন যে ক্লক স্পিড ধরে রাখতে পারবে এবং বুস্ট ক্লক হচ্ছে, প্রসেসরটি সর্বোচ্চ কত ক্লক স্পিড তুলতে সক্ষম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বুস্ট ক্লক নির্ধারণ করে দেওয়া থাকে। কিন্তু, যেসব চিপ আভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় নির্ধারিত বুস্ট ক্লকও ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়, তাদেরকে পরে আনলকড চিপ হিসেবে বাজারে ছাড়া হয়।
এই প্রসেসরগুলোকেই ওভারক্লক করা যায়। ইন্টেলের যেসব প্রসেসরের নামের শেষে K দেখতে পাওয়া যায়, যেমন i9-10900K, i7-7700K এগুলো আনলকড চিপ। আর এই আনলকড চিপ নিয়েই তৈরি হয় লটারি প্রতিযোগিতা। দু’টি আনলকড i-7700 যদি ওভারক্লক করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, দু’টি ভিন্ন ক্লক স্পিড তুলছে। যে বেশি ক্লক স্পিড তুলতে সক্ষম হবে, সে হচ্ছে জয়ী! নিচের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৩ শতাংশ 4790K প্রসেসর ৫ গিগাহার্জ ক্লক স্পিড তুলতে সক্ষম হয়।
গ্রাফিক্স কার্ড প্রস্তুতকারীরাও এভাবেই তাদের পণ্যের লাইন-আপ তৈরি করে। তবে কিছু তৃতীয় পক্ষের কোম্পানি রয়েছে যারা শুধু সেসব প্রসেসর বা গ্রাফিক্স কার্ড বিক্রি করে, যেগুলো সিলিকন লটারিতে জয়ী হয়েছে। এগুলোর মূল্য বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
চিপ তৈরির প্রক্রিয়ায় কমতি রাখা হয় না। কিন্তু প্রক্রিয়াটি এতটাই জটিল যে সমানভাবে সকল চিপ তৈরি করা আপাতত অসম্ভব। তবে চিপের অগ্রগতির সাথে বিবেচনায় এই অসামঞ্জস্য খুবই অল্প হওয়ায় প্রযুক্তিখাতে এর প্রভাব অল্প। তবে আশা করা যায়, ভবিষ্যতের প্রযুক্তি দ্বারা এ বৈষম্য কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।