গত ৯-১২ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডার লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো বিশ্বের সব থেকে বড় প্রযুক্তি আসর কনজ্যুমার ইলেক্ট্রনিকস শো (সিইএস) – ২০১৮। বিশ্বের বড় বড় বা জায়ান্ট প্রযুক্তি পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো চোখ ধাঁধানো সব প্রযুক্তি পণ্য নিয়ে হাজির হয় এই আয়োজনে। গোটা বছরজুড়ে প্রযুক্তিপ্রেমীরা নতুন নতুন কী চমক পেতে চলেছেন, তারই কিছু নমুনা নিয়ে হাজির হন তারা। তাই এই আয়োজন কেবল পণ্য প্রদর্শনীর, কেনা বেচার নয়। জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় প্রযুক্তিপ্রেমী ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। ১৯৬৭ সাল থেকে কনজ্যুমার টেকনোলজি অ্যাসোসিয়েশন নিউইয়র্কে আর লাস ভেগাসে এই আয়োজন করে আসলেও ১৯৯৮ সাল থেকে কেবল লাস ভেগাসের লাস ভেগাস কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে আয়োজিত হয় এই শো। আগে যেসব প্রযুক্তি শোভা পেত বিজ্ঞান কল্পগল্পে, এখন সেগুলো দেখা যায় কনজ্যুমার ইলেক্ট্রনিকস শো তে।
প্রতিবারের মতো এবারও বিশ্বের বড় বড় সব প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো হাজির হয় তাদের চমক লাগানো সব পণ্য নিয়ে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, অগমেন্টেড রিয়েলিটি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স থেকে শুরু করে গায়িকা রোবট, স্মার্ট হোম ডিভাইস, স্মার্টফোন, ভবিষ্যতের কনসেপ্ট কার সহ অবাক করে দেয়ার মতো সব পণ্য নিয়ে হাজির হয়েছিল এবারের নির্মাতারা। তবে আজকের আয়োজনে থাকছে কিছু বিচিত্র ঘরানার পণ্য, যেগুলো আপনার মনে জায়গা করে নিতেও পারে!
রোবোটিক মুভি প্রোজেক্টর
কেমন হবে যদি বাসাতেই প্রোজেক্টরে সিনেমা, ছবি বা ভিডিও দেখার সাথে সাথে ঘরে না থাকলেও ঘরের ওপর চোখ রাখা যায়! হ্যাঁ একইসাথে বিনোদন এবং বাসার নিরাপত্তার কাজে দেবে এমনই এক রোবট কীকার (Keecker)। দেয়ালে ৭৮ ইঞ্চির ছবি প্রদর্শন করতে সক্ষম রোবটটি চলাচল ও ভয়েস কমান্ড অনুযায়ী কাজ করতে পারে। একে কেবল সিনেমা বা ভিডিও দেখার কাজেই নয়, ব্যবহার করা যাবে যোগাযোগ এবং বাসার নিরাপত্তা ব্যবস্থাতেও।
লাইভ ভিডিও চ্যাট, ৩৬০ ডিগ্রী ভিডিও ধারণ, মিউজিক প্লে, নেটফ্লিক্স বা ইউটিউবের ভিডিও স্ট্রিমিং করতেও কাজে দেবে এই রোবোট। আপনি ঘরে না থাকলেও আপনার ঘরের ওপর চোখ রাখবে কীকার এবং তা আপনি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণও করতে পারবেন। ডেপথ সেন্সিং ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছে এই কাজের জন্য। আর চার্জিং নিয়ে ভয় নেই, কারণ চার্জ ফুরিয়ে গেলে নিজে থেকেই চার্জ করে নিবে নিজেকে কীকার। এটিকে বাসায় পেতে গেলে আপনাকে গুনতে হবে ১,৭৯০ ডলার। তবে এই সেবা কেবল চালু আছে আপাতত যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং ইউরোপে।
স্বচালিত স্যুটকেস অনুসরণ করবে আপনাকে
কোথাও ঘুরতে গেলে লাগেজ টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া কার না বিরক্ত লাগে! অনেকেই হয়তো ভাবেন যদি নিজে থেকেই আপনাকে অনুসরণ করে চলত লাগেজ বা সুটকেসটি! আপনার ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে ফরওয়ার্ড এক্স এবারের শো তে প্রদর্শন করে সিএক্স -১ নামের অটো-ফলোয়িং স্মার্ট স্যুটকেস।
এতে আছে ১৭০ ডিগ্রী ওয়াইড অ্যাঙ্গেল ক্যামেরা আর লেজার রাডার, যার ফলে এটি আপনাকে খুব সহজেই অনুসরণ করে চলতে পারবে আর সামনে কোনো বাধা থাকলেও সেটিকে এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাবে স্যুটকেসটি। চারটি চাকা থাকায় স্পিড ব্রেকার, দুর্গম রাস্তা কিংবা পাহাড়ে চড়া কোনোটিই থামিয়ে রাখবে না সিএক্স ১ কে। চুরি যাবার ভয় করছেন? না সেটিও হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ এতে আছে স্মার্ট অ্যালার্ম সিস্টেম। যার ফলে আপনি ছাড়া অন্য কেউ ব্যাগটি খোলা বা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেই আপনার হাতে থাকা রিস্টব্যান্ডটি বেজে উঠবে। শুধু তা-ই না, যদি আপনি খুব বেশি দূরে চলে যান বা স্যুটকেসের চার্জ শেষ হয়ে আসে, তাহলেও আপনাকে জানিয়ে দেবে সেটি। আর রিস্টব্যান্ডটি স্যুটকেসের সাথেই দেয়া হবে আপনাকে।
বিছানা যখন দোলনা!
ছোট বাচ্চাদের তো দোল খাইয়ে ঘুম পাড়ানো খুব কার্যকর, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে কি সেই কার্যকারিতা কমে যায়? এমন প্রশ্নটা ম্যাক্স রাসেলের মাথায় আসতেই তিনি কাজে নেমে পড়েন। বিজ্ঞান কিন্তু বলে, দোল খেতে খেতে বিশ্রাম নিলে সেটা বেশ কাজে দেয়, আর এতে ঘুমও বেশ ভালো হয়। অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাই ম্যাক্স তৈরি করে ফেলেন দোলন বিছানা বা রকিং বেড। স্টিলের ফ্রেম এবং শব্দহীন কয়েকটি মোটরে সাহায্যে তৈরিকৃত এই বিছানা আপনাকে খুব সহজেই ঘুমের জগতে নিয়ে যাবে। এর জন্যে দরকার পড়বে না বিছানার ফ্রেম বা ম্যাট্রেস পরিবর্তন করার। কেবল বিছানার আকার অনুযায়ী স্টিলের বেড ফ্রেমটি বসিয়ে নিলেই একদম তৈরি! তবে এই দোলন গতি এবং দোলনকাল চাইলে আপনি নিজের মতো করেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। আর এটি দুলতে থাকবে পাশাপাশি সমান্তরালভাবে। এখন পর্যন্ত এর দাম ধরা হয়েছে ৩,০০০ ডলার।
স্যামসাংয়ের দ্য ওয়াল
দক্ষিণ কোরীয় প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেক জায়ান্ট স্যামসাং লক্ষ্য সবসময় থাকে বড়। আর তাই এবারের সিইএস-এ সব থেকে বড় পর্দার স্মার্ট টিভি দ্য ওয়াল উন্মোচন করল প্রতিষ্ঠানটি। ১৪৬ ইঞ্চি ডিসপ্লের এই টিভিতে OLED এর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে মাইক্রো-এলইডি ডিসপ্লে। এর ফলে এতে গাঢ় কাল আর উজ্জ্বল দু’ধরনের ছবিই হবে বেশ ঝকঝকে। এছাড়া এতে ব্যবহার করা হয়েছে ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট বিক্সবি ফিচার। যদি আপনার বাসায় থাকে একটি স্যামসাং স্মার্ট ফ্রিজ, আর তার ভেতরে বাসানো থাকে ক্যামেরা, তবে ফ্রিজ না খুলেই আপনি বুঝে যাবেন কী আছে ভেতরে। কারণ টিভিতেই দেখতে পাবেন ফ্রিজের ভেতরের অবস্থা। এটি মূলত আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) নির্ভর প্রযুক্তি। স্যামসাংয়ের এবারের উদ্দেশ্য ছিল টিভি যেন নির্দিষ্ট আকারের না হয়। আর তাই এতে ব্যবহার করা হয়েছে মড্যুলার প্রযুক্তি। এর সুবিধা হলো যেকোনো আকারের টিভি প্রস্তুত করতে পারবে প্রতিষ্ঠানটি অর্ডারকারীর চাহিদা অনুযায়ী। কারণ এই প্রযুক্তিতে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মডিউল যোগ করে বানানো হয় ডিভাইস। স্যামসাংয়ের এ বছরের লক্ষ্য হলো যোগাযোগ আর শেয়ারিংকে সহজতর করা।
এলজির রোলেবল টিভি
স্যামসাংয়ের বড় পর্দার টিভি দেখা শেষে কি এটি দেয়াল জুড়ে কেবল কালো একটি বস্তু হয়েই থাকবে? কেমন হতো যদি দেখাশেষে টিভিটা মুড়িয়ে রাখা যেত? স্যামসাং আপাতত সেই সুবিধা না দিলেও, এলজি এবারের সিইএস-এ প্রদর্শন করেছে প্রথমবারের মতো মুড়িয়ে রাখা যায় এমন টিভি। OLED ডিসপ্লে উৎপাদনকারী এই প্রতিষ্ঠান ৮৮ ইঞ্চির ৮কে রেজ্যুলেশনের টিভি তৈরি করেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি হয়তো, আর তাই পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো ৬৫ ইঞ্চির ৪কে রেজ্যুলেশনের রোলেবল টিভি তৈরি করল এলজি। এর নিচের দিকে আছে একটি সাউন্ডবারের মতো বক্স আর কাজ শেষে রিমোট কন্ট্রোলারের মাধ্যমে কমান্ড দিয়ে টিভিটিকে মুড়িয়ে রাখা যাবে সেই বক্সে।
একইসাথে সঙ্গীত ও নৃত্যকলায় পারদর্শী রোবট
রোবট গান গায়! আবার নাচেও! শুনতে কি খুব বেশি অবাক লাগছে? শুধু এটুকুই না, অ্যাভাটার মাইন্ডের তৈরি রোবট আইপাল (iPal) কথা বলতে, গল্প শোনাতে, শিক্ষণীয় গেম খেলতে কিংবা ব্যায়াম করার দিক নির্দেশনাও দিতে পারে। ৩.৫ ফুট লম্বা এই রোবট হতে পারে আপনার অবসরের সঙ্গী কিংবা বাচ্চাদের জন্য ডিজিটাল শিক্ষকও। এর বুকে রয়েছে ৬ ইঞ্চির একটি এলসিডি ডিসপ্লে, আর পায়ে রয়েছে ৪টি চাকা। চোখে ১.৩ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা ছাড়াও এর রয়েছে মোট ১৩টি সেন্সর। গানের তালে তালে হাত-পা নাড়িয়ে নাচতে সক্ষম অ্যান্ড্রয়েড ওএস ভিত্তিক রোবোট আইপাল। এমনকি অভিভাবক চাইলে তার সন্তানকে মনিটরও করতে পারবেন এর মাধ্যমে, মোবাইল অ্যাপ বা ডেস্কটপের সাহায্যে।
বাইটন কনসেপ্ট কার
অটোমোবাইল কোম্পানি বাইটন গাড়িকে কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চায় না। তারা চায় গাড়ি হয়ে উঠুক আপনার একটি ঘরের মতো। আর সে লক্ষ্যেই এবারের সিইএস-এ বাইটন উন্মোচন করে তাদের কনসেপ্ট কার। এর মূল আকর্ষণ ছিল পুরো ড্যাশবোর্ড জুড়ে থাকা ৪৯ ইঞ্চি স্ক্রিন। এছাড়াও এতে আছে ফেসিয়াল রিকগনিশন এর মতো আরো অনেক স্মার্ট প্রযুক্তি। বাইটনের তথ্যানুযায়ী, আগামী ২০২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় নামবে তাদের গাড়ি।
অগমেন্টেড রিয়েলিটি টুথব্রাশেও
এবারের গ্যাজেটটি বড়দের জন্য না হলেও ছোটোদের মনে ঠিকই জায়গা করে নেবে। ছোটোদের বিরক্তিকর দাঁত ব্রাশ করাকে আরো মজাদার করে তুলতে এর সাথে অগমেন্টেড রিয়েলিটি জুড়ে দিয়ে কলিব্রী তৈরি করেছে ম্যাজিক (Magik) নামের অগমেন্টেড রিয়েলিটি নির্ভর টুথব্রাশ। এটি অনেকটা গেমের মতো। অ্যাপের মাধ্যমে চালু করে ফোন ক্যামেরাটি মুখের সামনে ধরলেই স্ক্রিনে দেখা যাবে বেশ মজার একটি পরিবেশ। আর গেম কন্ট্রোলার হল ব্রাশটি। এতে আছে বেশ কিছু সেন্সর, যার ফলে সেটি জানিয়ে দিবে বাচ্চাটি ঠিকমতো ব্রাশ করছে কিনা অর্থাৎ জীবাণুদের সাথে ঠিক মত ঢিশুম ঢিশুম চলছে কিনা! সাথে সাথে সেটি অভিভাবককেও জানিয়ে দেবে যে সে ঠিকমত ব্রাশ করছে কিনা।
বেড়ালের খেলনাতেও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স
আপনি যদি একটি পোষা বেড়াল থাকে আর তার জন্যে খেলনা কেনার কথা ভাবেন, তাহলে পেট্রিনিক্স আপনার জন্য এবারের কনজ্যুমার ইলেক্ট্রনিকস শোতে আপনার জন্যই প্রদর্শন করেছিল মাউসার (Mousr)। এটি একটি রোবট ইঁদুর। এতে প্রয়োগ করা হয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আর তাই এটি আপনার বিড়ালের সাথে নিজেই খেলতে পারবে আর সেটিও তার পছন্দমতো। সাথে সাথে এটি আপনি চাইলে অ্যাপের মাধ্যমেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। ইঁদুরটি ধরা পড়ার পর একটি স্বাভাবিক ইঁদুরের মতোই আচরণ করবে। আর এর লেজটিও খুলে বিভিন্ন ধরনের লেজ পরানো যাবে। দাম রাখা হয়েছে ১৪৯ ডলার।
ফিচার ইমেজ – Tech Radar