ইন্টারনেটের কল্যাণে বিটকয়েন শব্দটির সাথে পরিচিত হলেও ব্লকচেইনের ধারণাটি আমাদের অনেকের কাছেই একেবারে নতুন। যদিও ব্লকচেইন এবং বিটকয়েন প্রায় সমসাময়িক ধারণা এবং এদের ব্যাপারে ইন্টারনেটে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়, তবু প্রোগ্রামিংয়ে যথেষ্ট ধারণা না থাকলে ব্লকচেইন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া এককথায় কঠিন। ব্লকচেইন সম্পর্কে সহজ কথায় কিছুটা ধারণা দিতেই আজকের লেখা।
আমরা অনেকেই ছোটবেলায় বিনিময় প্রথার ওপরে কিছুটা হলেও পড়াশোনা করেছি। একদম শুরুতে অর্থনীতির ভিতই তো ছিল এই বিনিময় প্রথা। এখনও আমরা বিনিময় করি, তবে চালের বিনিময়ে ডাল কিংবা কাপড়ের বিনিময়ে জুতো নয়। এখন আমরা বিনিময় করি মুদ্রার মাধ্যমে। আসলে মুদ্রাগুলো আমাদের সবার সমষ্টিগত বিশ্বাসের জোরে টিকে থাকে। আমরা সবাই যদি ডলারের ক্ষমতায় বিশ্বাস না করতাম, তাহলে তো আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এত ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হতে পারত না, তাই না? বিটকয়েন সেরকমই এক বিনিময় ব্যবস্থা। তবে টাকা, রুপি বা ডলারের মতো বিটকয়েন কোনো স্টেট ব্যাংক কর্তৃক ইস্যু হয় না। সংক্ষেপে বলতে গেলে, বিটকয়েন একটি অনলাইন কারেন্সি বা মুদ্রা, যার বিনিময়ে আমরা কেনাবেচা করতে পারি।
টাকা যেমন একধরনের মুদ্রা, তেমনি বিটকয়েন একধরনের ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’। বিটকয়েন ছাড়াও লাইটকয়েন, বিটক্যাশ ইত্যাদি আরো অনেক ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে। এসকল ক্রিপ্টোকারেন্সি ইস্যুর মূল উদ্দেশ্য হলো যাতে আমরা ব্যাংক কিংবা রাষ্ট্রের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ না হয়ে নিজেরাই বিশ্বাসযোগ্য লেনদেন সেরে ফেলতে পারি।
বিটকয়েনের জন্মপ্রক্রিয়া
বিটকয়েন তৈরি হয় বিটকয়েন মাইনারের মাধ্যমে। সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে যেভাবে টাকা ছাপানো হয়, সেরকমভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সি ছাপার জন্য কোনোরকম ছাপাখানা নেই। কারণ, ক্রিপ্টোকারেন্সির কোনো দৃশ্যমান শরীরী অস্তিত্ব থাকে না। একেকটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক পাজল সমাধান করে একেকটি বিটকয়েন তৈরি হয়।
বিটকয়েনের সাথে ব্লকচেইনের কী সম্পর্ক?
বিটকয়েন বা অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে আমরা যেসব লেনদেন করে থাকি সেসবের তো একটি হিসাব রাখা প্রয়োজন। নাহলে জনাব করিম জনাব রহিমের কাছে ডেটা বিক্রি করার পরে যদি দাবি করেন যে, জনাব রহিম তাকে তার প্রাপ্য কয়েন দেননি, তখন ঝগড়া লেগে যেতে পারে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য এসব লেনদেনের একটি হিসাবনিকাশ রাখা দরকার। ব্যাংকিং পদ্ধতিতে অ্যানালগ যুগে লেজার বুক থাকত, যাতে প্রতিটি অ্যাকাউন্টের মধ্যকার লেনদেনের লগ রাখা হতো। আর এখন ডিজিটাল লেজার বুক ব্যবহার হয়, এই যা পার্থক্য। তবে বিটকয়েন বা অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের লেজার বুকই হলো আমাদের এই ব্লকচেইন।
ব্লকচেইন কীভাবে কাজ করে?
ব্লকচেইন শব্দটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এটি অনেকগুলো ব্লকের একটি চেইন বা শেকল। এখন প্রশ্ন হলো, ব্লক কী? সহজ কথায়, একটি ব্লকে কোনো একটি মুহূর্তের প্রায় ১০ মিনিটে সংঘটিত সকল লেনদেনের তথ্য ‘এনক্রিপ্টেড’ অবস্থায় থাকে। এই ব্লকটি তার পূর্ববর্তী ব্লকের সাথে যুক্ত থাকে, তার আগেরটি তারও আগের ব্লকটির সাথে। এভাবে একটি চেইন তৈরি হয়েছে যা আসলে বেড়েই চলেছে প্রতিনিয়ত। ব্লক ব্যবহারের একটি ‘পাবলিক কি’ (Public Key) এবং একটি ‘প্রাইভেট কি’ (Private Key) থাকে। আমার যদি একটি পাবলিক কি থাকে তবে সেটি দেখে আমার নেটওয়ার্কের যে কেউ বুঝতে পারবেন, লেনদেনটি আসলেই আমি করেছি কিনা। অর্থাৎ আমি যদি মূল্য পরিশোধ না করে থাকি, তবে সেটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগই থাকছে না আমার কাছে। পাবলিক কির মাধ্যমে লেনদেনের স্বচ্ছতা রাখাটা সহজ হয়ে যাচ্ছে এভাবে। তাহলে প্রাইভেট কির কাজটি কী? লেনদেনটি যে কারো কাছে দৃশ্যমান হলেও এই লেনদেনের বিস্তারিত কেবল তিনিই জানতে পারবেন, যার কাছে প্রাইভেট কি রয়েছে।
ব্লকের গঠন কেমন?
একটি ব্লক তার পূর্ববর্তী ব্লকের সাথে যুক্ত থাকে, সেকথা আগেই বলেছি। যখন কোনো ডেটাকে এনক্রিপ্ট করা হয়, তখন সেই ডেটার বিপরীতে আমরা একটি ‘ইউনিক হ্যাশ’ পাই যেটি অপরিবর্তনীয়। যেকোনো কম্পিউটারে ওই নির্দিষ্ট ডেটাটির বিপরীতে ঐ হ্যাশটিই পাওয়া যাবে। ‘ক্রিপ্টোগ্রাফিক পাজল’ সমাধান করার নামে আমরা আসলে এরকম ইউনিক হ্যাশগুলো খুঁজতে থাকি। আগের ব্লকের সাথে যুক্ত হবার জন্যে একটি ব্লকের একটি ‘প্রিভিয়াস হ্যাশ’ থাকে। সেই সাথে থাকে ‘টাইমস্ট্যাম্প’। টাইমস্ট্যাম্প নির্দেশ করে এই ব্লকটি কখন তৈরি হয়েছে। এরপর থাকে ডেটা, অর্থাৎ যে তথ্যটিকে আমরা আদানপ্রদান করতে চাচ্ছি। ডেটাটিকে এনক্রিপ্ট করে আরেকটি লম্বা হ্যাশে পরিণত করা হয়। একটি ব্লকের একটি নির্দিষ্ট ‘NONCE’ নম্বর থাকে। এই নম্বর দিয়ে আমরা বুঝি, ঐ নির্দিষ্ট হ্যাশটি খুঁজে পেতে সিস্টেমকে কতবার পুরো ‘খোঁজ দ্য সার্চ’ প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি করতে হয়েছে।
ব্লকচেইন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
ব্লকচেইন কেন গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে হলে বুঝতে হবে ক্রিপ্টোগ্রাফির মূল কথাগুলো। যখন আমরা কোনো তথ্য ‘এনক্রিপ্ট’ করি তখন আমরা কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করতে চাই। প্রথমত, আমাদের ডেটার গোপনীয়তা যাতে বজায় থাকে। যে কেউ চাইলেই যাতে এই ডেটা পড়ে ফেলতে না পারে। কেবল আমাদের অনুমোদিত লোকজনই যাতে এই ডেটায় ‘অ্যাক্সেস’ পান। দ্বিতীয়ত, আদানপ্রদান চলাকালীন আমাদের ডেটায় যাতে কোনো পরিবর্তন না আসে। অর্থাৎ আমি যেমন তথ্য পাঠাব, প্রাপক যাতে অবিকৃত অবস্থায় সেই তথ্য পান। তৃতীয়ত, প্রেরক এবং প্রাপক, দুজনেরই যাতে কখনোই অস্বীকার করার উপায় না থাকে যে তিনি ডেটাটি পেয়েছেন। এবং চতুর্থত, দুই পক্ষই যাতে ডেটার হাল হকিকত জানতে পারেন। অর্থাৎ ডেটা কে দিচ্ছে, কে নিচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, কীভাবে যাচ্ছে এসব। এসব বিষয় নিশ্চিত হলেই আমরা ধরে নেই আমাদের এনক্রিপশনের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ব্লকচেইন যেহেতু একধরনের এনক্রিপশন, তাই আমরা এসব শর্ত পূরণ করতে চাই। চলুন একে একে দেখে নিই ব্লকচেইন কীভাবে এসব শর্ত পূরণ করে।
- ব্লকচেইন ক্রমানুসারে সাজানো থাকে। ডেটার ‘সিকোয়েন্স’ এলোমেলো হয় না, কারণ, প্রতিটি ব্লক তার আগের ব্লকের সাথে যুক্ত থাকে।
- ব্লকের ডেটা কখনো পরিবর্তনযোগ্য নয়। এমনকি প্রাইভেট কি থাকলেও নয়। একটি ডেটা ‘ভেরিফায়েড’ হয়ে ব্লকে যুক্ত হয়ে গেলে সেটি একটি ‘রিড অনলি ডেটা’ হিসেবে সংরক্ষিত থাকে, এই ডেটা মুছে ফেলা বা বদলে দেওয়া অসম্ভব।
- ব্লকচেইন ডেটাবেজ মূলত উন্মুক্ত। লেনদেনের পরিমাণ যে কেউ দেখতে পায় বলে এর স্বচ্ছতা বজায় থাকে।
- ব্যাংক বা দালাল নামক মধ্যস্বত্বভোগী দলেরা কোনো সুবিধা পায় না কারণ, ব্লকচেইন একটি ‘পিয়ার-টু-পিয়ার’ বা গ্রাহক থেকে গ্রাহক লেনদেন ব্যবস্থা।
ব্লকচেইনের মূল টেকনোলজিগুলো; Source: eng.paxos.com
মধ্যস্বত্বভোগীর ব্যাপারটি পুরোপুরি বোঝা গেল না?
আমরা যখন বিকাশ বা রকেটে টাকা লেনদেন করি, তখন আমাদেরকে তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ দোকানদারের সাহায্য নিতে হয়। দোকানদার তো ফ্রিতে আমার বা ব্যাংকের কাজ করে দেবে না। তাকে কোনো ধরনের সুবিধা দিতে হবে, যেটি ব্যাংকের গ্রাহক হয়ে আপনাকে-আমাকেই বহন করতেই হবে। যখন ব্যাংকের এটিএম থেকে টাকা তোলা হয় তখন এই বাড়তি টাকাটা খরচের দরকার পড়ে না, কারণ, গ্রাহক এবং ব্যাংকের মধ্যে তখন তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে কেউ উপস্থিত থাকে না। ব্লকচেইন এরকমভাবে তৃতীয় পক্ষকে হটিয়ে দেয়। ফলে লেনদেনকারীদেরকে কোনো তৃতীয় পক্ষের সাহায্য নিতে হয় না।
ব্লকচেইন যদি হ্যাক হয়ে যায়?
ব্লকচেইনের আসল কার্যকারীতা এখানেই যে ব্লকচেইন হ্যাক হওয়া একপ্রকারে অসম্ভব। প্রথমেই বলেছি, ব্লকচেইন একেকটি লেনদেনের রেকর্ড। প্রাইভেট কি ছাড়া এই লেনদেনের ভেতরের তথ্য পড়া যায় না। সাথে এ-ও বলেছি, প্রতিটি ব্লকের একটি ইউনিক হ্যাশ থাকে এবং প্রতিটি ব্লক তার আগের ব্লকের সাথে যুক্ত। যদি কোনো হ্যাকার কোনো ব্লকে প্রবেশ করে, তবে সাথে সাথে সেই ব্লকের হ্যাশ বদলে যাবে। হ্যাশ পালটে যাওয়া মানে সেই ব্লক পুরোপুরি ‘ইনভ্যালিড’ হয়ে যাওয়া। এরপর চেইন আকারে পরবর্তী ব্লকগুলো ইনভ্যালিড হতে থাকবে। কারণ, প্রতিটি ব্লক তার আগেরটির সাথে যুক্ত! হ্যাকার মহাশয় যদি সফলভাবে হ্যাক করতে চান, তবে তাকে প্রতিটি ব্লক আবার ভ্যালিড করতে হবে। এই কাজে প্রতিটির জন্যে ৫২% ইউজারের ভোট প্রয়োজন, যেটি আদতে অসম্ভব। কারণ, এই বিপুল পরিমাণ ডেটা ব্লক ‘ভ্যালিডেট’ করার জন্যে হ্যাকার পাবেন ১০ মিনিটেরও কম সময়। কেননা এ সময়ের মাঝেই তো নতুন ডেটা ব্লক তৈরির সময় হয়ে যাবে! এ কারণেই বলা হচ্ছে, ব্লকচেইন হ্যাক করা আদতে অসম্ভব।
ভবিষ্যতের কথা কেউ বলতে পারে না। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, ভবিষ্যতে ক্রিপ্টোকারেন্সিই পৃথিবী চালাবে, কাগুজে নোটের অস্তিত্ব থাকবে না। আবার ক্রিপ্টোকারেন্সির হুটহাট দর বেড়ে যাওয়া কিংবা দরপতনের ‘র্যানডম বিহেভিয়ারের’ কারণে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ বিটকয়েনের পেছনে বিনিয়োগকে জুয়া খেলার সাথে তুলনা করেছেন। যে তত্ত্বই সঠিক হোক না কেন, বর্তমান পৃথিবীতে যে ব্লকচেইন এবং বিটকয়েনের গুরুত্বের গ্রাফ যে উর্ধ্বমুখী, সে ব্যাপারটি নিঃসন্দেহ।
ফিচার ইমেজ- CryptoCurrency Times