মুক্ত সফটওয়্যার: প্রাযুক্তিক স্বাধীনতা আন্দোলনের উপাখ্যান

– ল্যাপটপে কী নেবেন?

– কী নেব মানে?

– মানে উইন্ডোজ ৭, ৮, না ১০ কোনটা দেব?

– কিছু দিতে হবে না। আমি উইন্ডোজ চালাই না।

নতুন কম্পিউটার কেনার পর এই পর্যায়ে দোকানী আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকান। আমি ছোট করে হাসি। ঘরোয়া এবং অফিস ব্যবহারের জন্য মাইক্রোসফটের পণ্য উইন্ডোজের এতটাই বিস্তৃতি যে, অনেকেই এর বিকল্প কিছুর কথা জানেন না। মাইক্রোসফটের পণ্য কঠোরভাবে বাণিজ্যকেন্দ্রিক, সফটওয়্যারের যেটা ভেতরের কথা, অর্থাৎ ‘সোর্স কোড’, সেটিকে তারা যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সফটওয়্যার ব্যাপারটি ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে এমন ছিল না। আপনি একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখে আপনার বন্ধুকে তার সোর্সটি দেবেন, বন্ধুটি সেটি দেখে তার ইচ্ছেমতো কিছু উন্নতি সাধন করবে। এভাবে আপনি যেমন ভালো একটি জিনিস ভাগাভাগি করতে পারলেন, তেমনি জিনিসটিও বহু মানুষের হাতের স্পর্শে আরও উন্নত হয়ে উঠবে। মাইক্রোসফটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস সোর্স কোড বন্ধ করার ধারা জনপ্রিয় করার আগ পর্যন্ত ব্যাপারটি সেরকমই ছিল।

DEC VT100 টার্মিনালে ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেম চলছে। Source: Wikimedia Commons

মুক্ত সফটওয়্যার কী?

কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন, সফটওয়্যার জিনিসটিতে সকলের অধিকার আছে। সেই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে হলে সফটওয়্যারের কলকব্জা অর্থাৎ সোর্স কোড দেখার অনুমতি থাকতে হবে। সেই সফটওয়্যারটি ব্যবহার করার এবং সেটিতে পরিবর্তন আনার অধিকারও থাকতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কাছে সেই সফটওয়্যার জিম্মি করে রাখে, তাদের ধিক্কার জানিয়ে রিচার্ড স্টলম্যান ১৯৮৫ সালে ‘ফ্রি সফটওয়্যার ফাউন্ডেশন’ নামে একটি অলাভজনক সংস্থার সূচনা করেন। এখানে ‘ফ্রি’ ব্যবহৃত হয়েছে ‘মুক্ত’ অর্থে। সত্তরের দশকের সূচনালগ্নে জন্ম নেওয়া ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেম মুক্তভাবেই মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছিল।

টিঅ্যান্ডটি বেল ল্যাবস আশির দশকের শুরুতে ইউনিক্সের বাণিজ্যিকীকরণ শুরু করলে স্টলম্যান একটি ‘ফ্রি’ অপারেটিং সিস্টেম নির্মাণের ঘোষণা দেন, যেটি হুবহু ইউনিক্সের মতোই কাজ করবে, কিন্তু তার সোর্স কোড হবে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। তা যাতে সবসময় উন্মুক্ত থাকে তার নিশ্চয়তা দেবার জন্য নতুন একটি সফটওয়্যার লাইসেন্সও তৈরি করেন তিনি। অভূতপূর্ব এই সিস্টেমের নাম দেওয়া হয় ‘GNU’ (যার অর্থ GNU, Not Unix!, উচ্চারণ ‘গ্নু’)। নতুন লাইসেন্সটির নাম রাখা হয় GPL বা General Public License। ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেমের গঠন এরকম যে, ছোট ছোট টুকরো প্রোগ্রাম একত্র হয়ে বড় কোনো কাজ করতে পারে। এর পরিকল্পনাটাও ইচ্ছে করেই সাদামাটা রাখা হয়েছিল শুরু থেকেই।

ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেমের অন্যতম দুই নির্মাতা ডেনিস রিচি এবং ব্রায়ান কার্নিগান; Source: Studfiles

তাই ইউনিক্স ‘ক্লোন’ করার কাজটি নানা স্বেচ্ছাসেবকদের পরিশ্রমে ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হতে থাকে। মানে ভালো হওয়ায় নব্বইয়ের দশক শুরু হবার আগেই বাণিজ্যিক ইউনিক্সেও গ্নু এর প্রোগ্রামগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ একটি ইউনিক্স সিস্টেমের প্রায় সবকিছু থাকলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ টুকরো বাদ থেকে গিয়েছিল, যাকে বলে ‘কার্নেল’।

লোগোসমেত গ্নু অপারেটিং সিস্টেম; Source: YouTube

কার্নেলের কাজ হলো একটি কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যারের ভেতর জোড়াসেতু স্থাপন করা। ফ্রি সফওয়্যার ফাউন্ডেশন যখন কার্নেল খুঁজছে, তখন ফিনল্যান্ডের এক ছাত্র তার ব্যক্তিগত কম্পিউটারে ইউনিক্স ব্যবহারের প্রয়োজন বোধ করলেন। ইন্টেল তখন ব্যক্তিগত কম্পিউটারের বাজার সদ্যই দখল করতে শুরু করেছে। গ্নু এর কথা তিনি জানতেন। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য তৈরি মিনিক্স নামের একটি অপারেটিং সিস্টেম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই ছাত্র ইন্টেল প্রসেসরের জন্য একটি কার্নেল লিখে ফেললেন। ছাত্রটির নাম লিনাস টোর্ভাল্ডস, কার্নেলটির নাম লিনাক্স। তিনি এটি জিপিএল লাইসেন্সে ছাড়েন।

সদ্য গণমানুষের হাতে আসা ইন্টারনেটের মাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে প্রায় খেলার ছলে লেখা এই সফটওয়্যার। আগ্রহী প্রোগ্রামাররা লুফে নেয় লিনাক্স, উন্নত করতে থাকে একে, এবং খুব শীঘ্রই গ্নু এর অন্যান্য প্রোগ্রামের সাথে একে জোড়া দিয়ে আস্ত অপারেটিং সিস্টেম বানিয়ে ফেলা হয়। প্রথম দিককার এরকম একটি ‘ডিস্ট্রিবিউশন’ হলো ডেবিয়ান। পুরোপুরি স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে চলা ডেবিয়ান এবং তার বিভিন্ন বংশধর (উবুন্টু, লিনাক্স মিন্ট ইত্যাদি) এখন পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ইউনিক্স সিস্টেম। বিকল্পের সন্ধান যারা জানেন, তারা ঘরোয়া কম্পিউটারেও এগুলো ব্যবহার করে থাকেন। গ্নু এর সাথে লিনাক্স কার্নেল জোড়া দেবার কারণে পূর্ণাঙ্গ অপারেটিং সিস্টেমটিকে ‘GNU/Linux বলে ডাকা হয়, কেউ কেউ শুধু কার্নেলের নামে লিনাক্স বলেই ডাকেন।

লিনাক্স কার্নেলের লোগো ‘টাক্স’ নামের পেঙ্গুইন; Source: Wikimedia Commons

বিএসডি

এদিকে বার্কলিতে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অভ ক্যালিফোর্নিয়ায় আশির দশক জুড়ে আরেকটি মুক্ত ইউনিক্স সিস্টেম গড়ে উঠছিল। প্রচুর নতুন প্রযুক্তি তাতে যোগ হচ্ছিল প্রতিনিয়ত, এবং সেগুলি এটিঅ্যান্ডটি তাদের বাণিজ্যিক পণ্যে ব্যবহার করছিল বলে বার্কলির এই মুক্তচর্চায় তারা বাধা দেয়নি। বার্কলি সফটওয়্যার ডিস্ট্রিবিউশন বা বিএসডি পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যার কর্মশালার একটি। ইন্টারনেট প্রযুক্তির অনেক কিছু বার্কলিতে বিকাশ লাভ করে, যার ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধহয় টিসিপি/আইপি। বিএসডি এর ৪.৩ রিলিজকে প্রায়শই বলা হয়, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সফটওয়্যার। কিন্তু বিএসডির সাথে গ্নু এর মৌলিক কিছু পার্থক্য আছে।

বিএসডি একেবারে সরাসরি সত্যিকার এটিঅ্যান্ডটির গবেষণা ইউনিক্সের উত্তরসূরি, কিন্তু গ্নু (এবং লিনাক্স কার্নেল) হলো, যাকে বলে ‘ক্লোন’। বিএসডির প্রোগ্রামার এবং দলপতিরাও একটি লাইসেন্স তৈরি করেছিল, এবং এটিও সফওটওয়্যারের স্বাধীনতাকেন্দ্রিক, কিন্তু এই লাইসেন্সে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম কেউ নিয়ে চাইলে মুক্ত রাখতেও পারে, না-ও পারে। অন্যদিকে জিপিএল লাইসেন্স অনুসারে সোর্স কোড যা-ই করা হোক না কেন, সেটি অবশ্যই মুক্ত থাকতে হবে। বিএসডি যখন নিজেদের মতো করে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন অপারেটিং সিস্টেম মুক্তি দিতে যাচ্ছিল, তখনই এটিঅ্যান্ডটি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে। পরে মামলাটি উঠিয়ে নিলেও ততদিনে গ্নু/লিনাক্স ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে। গ্নু/লিনাক্সের মতো পরিচিত এবং আলোচিত না হলেও আমাদের অজ্ঞাতে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ ওয়েব সার্ভার বিএসডি থেকে জন্ম নেওয়া মুক্ত অপারেটিং সিস্টেমরা চালিয়ে যাচ্ছে। ফ্রিবিএসডি এর ভেতর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।

ফ্রিবিএসডি লোগো Beastie; Source: Medium

কিন্তু কেন?

মুক্ত অপারেটিং সিস্টেমের কী দরকার? আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, বেশিরভাগই অনৈতিকভাবে অর্থ্যাৎ না কিনেই মাইক্রোসফট উইন্ডোজ ব্যবহার করছেন। অর্থব্যয় করে অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করতেই হবে, সেরকম কোনো কথা তো নেই! তবে সেই কাজটিই নিয়ম মেনেও করা যায়। বিএসডি এবং গ্নু/লিনাক্সের প্রচুর সিস্টেম ইন্টারনেটে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। সামর্থ্য থাকলে অর্থ সাহায্য দিতে পারেন এসব প্রজেক্টে, না পারলে নেই। অভিজ্ঞ ব্যবহারকারীদের সাহায্য হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় ইন্টারনেটে।

যখন একজন অনভিজ্ঞ ব্যবহারকারী সমস্যা সমাধান করতে শিখে যান, তিনিও নতুন পথিকদের দিশা দেখাতে পারেন। ইউনিক্সের চমৎকার আদি গড়নের কারণে ‘ভাইরাস’ নিয়ে ভাবতে হয় না। নিরাপত্তার অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি অপারেটিং সিস্টেমের সাথেই দেওয়া থাকে। মুক্ত সোর্স হবার কারণে কোথাও কোনো খুঁত থাকলে কারও চোখে পড়বার সাথে সাথে সেটি ঠিক করে ফেলা হয়, যেটি উইন্ডোজের মতো বাণিজ্যিক অপারেটিং সিস্টেমে সম্ভব নয়। আর দৈনন্দিন কাজে লাগে এরকম প্রায় সবক’টি প্রোগ্রামের একটি মুক্ত সংস্করণ রয়েছে।

ঘরোয়া ব্যবহারের জন্য কিছু মুক্ত সফটওয়্যারের উদাহরণ; Source: Wikimedia Commons

সবচেয়ে বড় কথা, এই মুক্ত সফটওয়্যারগুলো আসে কিছু মানুষের আপ্রাণ ভালোবাসা থেকে। তাই এগুলোকে ছড়িয়ে দিন চারিদিকে, মুক্ত থাকুন!

ফিচার ইমেজ: Beyond Open Source | Sealed Abstract

Related Articles

Exit mobile version