সারা বিশ্বে প্রযুক্তির অসাধারণ উন্নতির সাথে সাথে বেড়ে চলেছে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা। একজন নতুন কোনো ফিচার নিয়ে আসলে আরেকজন তাকে টেক্কা দেয়ার জন্য নিয়ে আসে অন্যকিছু! আবার দ্বিতীয়জনকে হারানোর জন্য প্রথমজন নিয়ে আসে আরও উন্নত সংস্করণ। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এভাবেই বেড়ে চলেছে কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা, এমনকি রীতিমতো প্রযুক্তি যুদ্ধ! আর সে যুদ্ধ যদি হয় দুই টেক-জায়ান্টের মাঝে?
এই যুদ্ধক্ষেত্রের এক প্রান্তে আছে মাইক্রোসফট কর্পোরেশন। এই কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালে, বিল গেটস এবং পল অ্যালেনের হাত ধরে। ফোর্বসের ২০১৭ সালের সবচেয়ে দামি ব্যান্ডগুলোর তালিকায় মাইক্রোসফট রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। বর্তমানে এর ব্র্যান্ড মূল্য ৮৭ বিলিয়ন ডলার। মাইক্রোসফটের প্রধান পণ্য হলো অপারেটিং সিস্টেম মাইক্রোসফট উইন্ডোজ। অনেক আগে থেকেই কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেমের বাজারে একাধিপত্য করে যাচ্ছে মাইক্রোসফট। Net Application Inc. এর তথ্যানুযায়ী, ৯১ শতাংশেরও বেশি পার্সোনাল কম্পিউটার চলে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে!
অন্যদিকে এই যুদ্ধক্ষেত্রের অপর প্রান্তে আছে গুগল। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন পিএইচডি ছাত্র ল্যারি পেইজ ও সের্গেই ব্রিন ১৯৯৮ সালে গুগল প্রতিষ্ঠা করেন। জন্মের কয়েক বছরের মাথায় গুগল ইন্টারনেটের সেরা সার্চ ইঞ্জিনে পরিণত হয়। বলা বাহুল্য, এখন পর্যন্ত সেরার তকমাটা সগৌরবে ধরে আছে প্রতিষ্ঠানটি! ১০১.৮ বিলিয়ন ডলার ব্র্যান্ড মূল্য নিয়ে ফোর্বসের তালিকায় গুগল রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। যদিও আমাদের এক প্রান্তের যোদ্ধা মাইক্রোসফটের ব্র্যান্ড মূল্য গুগলের থেকে বেশ কম, কিন্তু নতুন নতুন বৈচিত্র্যময় পণ্য নিয়ে আসতে দুজনের কেউই কিন্তু কম যায় না! কিন্তু এই যুদ্ধে জয়ী হবে কে? দুই প্রযুক্তি-মোঘলের মধ্যে কে কতটুকু ক্ষমতা রাখে অন্যকে টেক্কা দেয়ার?
গুগল বনাম মাইক্রোসফট
গুগলের শুরুটা যেভাবে হয়েছিল, তাতে প্রথম দিকে এমনটা মনে হয়নি যে মাইক্রোসফটের সাথে গুগলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। কারণ, প্রথম দিকে গুগল ছিল শুধুমাত্র ওয়েবের একটি সার্চ ইঞ্জিন, যার আয়ের উৎস ছিল বিজ্ঞাপন। আর অন্যদিকে মাইক্রোসফট প্রধানত তৈরি করতো অপারেটিং সিস্টেম, অফিস প্রোডাক্টিভিটি স্যুট এবং অন্যান্য সফটওয়্যার। তবে আজকের কথা চিন্তা করলে অনেকগুলো বিন্দু আছে, যেখানে গুগল আর মাইক্রোসফটের পথে সংঘর্ষ হয়। এরা দিনকে দিন একে অন্যের পণ্য বাজারে হানা দিচ্ছে আর রীতিমত তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি করছে। মাইক্রোসফট গুগলের সাথে প্রথম সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার পদক্ষেপ নেয় Bing সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে। বলা যায়, গুগলের ভাতের থালায় ভাগ বসিয়েছিল মাইক্রোসফট! ২০০৯ সালে ইন্টারনেট জগতে আসে Bing। অবয়বের দিক থেকে Bing যেমন ছিল গুগলের মতো, তেমনি কাজের দিক থেকেও গুগলের সাথে কোনো অমিল ছিল না। ভাগ বসালেও Bing-কে কিন্তু ততটা সফল বলা যাবে না। কারণ বিশ্বে সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহারের দিক থেকে ৭৭.৯৮% নিয়ে সবার উপরে গুগল। Bing এর দখলে মাত্র ৭.৮১%!
অন্যদিকে মাইক্রোসফট অফিসকে টেক্কা দেয়ার জন্য গুগল নিয়ে এসেছে ওয়েব ভিত্তিক প্রোডাক্টিভিটি সফটওয়্যার Google Docs। Google Docs-এ রয়েছে ওয়ার্ড প্রসেসর, স্প্রেডশিট এপ্লিকেশন, প্রেজেন্টেশন মেকার এবং ড্রয়িং টুলস। অর্থাৎ একটি ওয়েব ব্রাউজার থেকে সম্ভাব্য যা যা এক্সেস দেয়া যায় সবই দেয়া আছে Google Docs-এ। সম্পূর্ণ ওয়েব ভিত্তিক হওয়ার কারণে বেশ সুবিধা আছে এর। কিন্তু ফিচারের দিক থেকে অবশ্যই মাইক্রোসফট অফিস থেকে অবশ্যই Google Docs পিছিয়ে আছে।
মাইক্রোসফট গুগলকে প্রত্যুত্তর দেয় Office Live Workspace (OLW) এর মাধ্যমে। এটি হলো মাইক্রোসফট অফিস প্রোডাক্টসের অনলাইন সংস্করণ। OLW এর ফিচারও মাইক্রোসফট অফিসের কাছাকাছি। Google Docs-কে টেক্কা দেয়ার জন্য OLW কিন্তু একরাতেই তৈরি হয়ে হয়ে যায়নি। সময় যেমন লেগেছে, তেমন খসাতে হয়েছে অনেক অর্থও!
আবার গুগল এবং মাইক্রোসফট উভয়েরই মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম রয়েছে। তবে এখানে অবশ্য গুগল মাইক্রোসফট থেকে যোজন দূরত্বে এগিয়ে আছে। মোবাইল প্লাটফর্মে অ্যান্ড্রোয়েডের দখলে আছে ৬৫.৫৩% ডিভাইস। অপরদিকে উইন্ডোজের দখলে আছে মাত্র .৮৭%! মাইক্রোসফট মোবাইল প্রথমদিকে বেশ সাড়া ফেললেও পরবর্তীতে নতুনত্বের অভাবে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। ধারাবাহিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া মাইক্রোসফট শেষ পর্যন্ত আর কোনো নতুন মোবাইল তৈরি করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে কিছুদিন আগে।
মোবাইল প্ল্যাটফর্মের পাশাপাশি গুগল এবং মাইক্রোসফট উভয়েরই ওয়েব ভিত্তিক ইমেইল প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। দুজনেই মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে ক্লাউড কম্পিউটিং সল্যুশনে। গুগলের অবশ্য এদিক থেকে কিছুটা সুবিধা আছে। কারণ, গুগল আগে থেকেই সম্পূর্ণ ওয়েব ভিত্তিক কোম্পানি। আবার আপ্লিকেশন ডেভলপমেন্টের ব্যাপারে মাইক্রোসফটেরও অভিজ্ঞতা কয়েক যুগের কম নয়!
দুই জায়ান্টের সবল ও দুর্বল দিক
সাধারণ মানুষের গুগলের ব্যাপারে বেশ ভালো পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। গুগল প্রতিনিয়তই তাদের পণ্যের নতুনত্ব ও গ্রাহক সেবার মাধ্যমে নিজের খ্যাতি বাড়িয়ে যাচ্ছে।
মাইক্রোসফটেরও গ্রাহকদের কাছে এরকম মর্যাদাই ছিল। বছরের পর বছর ধরে অপারেটিং সিস্টেম জগতে রাজত্ব করে মাইক্রোসফট অনন্য নামে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং সামঞ্জস্য নিয়ে বহুদিন ধরেই উইন্ডোজকে বিভিন্ন সমালোচনা সইতে হয়েছে। Windows ME এবং Windows Vista প্রথম দিকে খুবই সমালোচিত হয়। তবে পরবর্তীতে Windows XP, Windows 7 এবং সর্বশেষ Windows 10 মাইক্রোসফটকে তার মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।
অন্যদিকে ওয়েবে গুগলের অবস্থান খুবই শক্তিশালী। গুগলের ইমেইল সার্ভিস Gmail মার্কেটের সবচেয়ে বেশি অংশ জুড়ে আছে। মাইক্রোসফটের Outlook এখানে কোনোভাবেই গুগলকে টেক্কা দিতে পারবে না বলে ধরে নেয়া যায়। সার্চ ইঞ্জিন ছাড়াও গুগল অনেকগুলো অনলাইন প্রোডাক্টিভিটি সফটওয়্যার নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে ভিডিও ও ছবি শেয়ারিং সেবা এবং ম্যাপিং সেবা অন্যতম।
এদিকে গুগল মোবাইল মার্কেটে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। আর তাদের ওয়েব ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম প্রজেক্টও প্রতিনিয়তই উন্নত করছে। তবে ইন্টারনেট ছাড়া চলতে পারে এমন খুব বেশি ডেস্কটপ অ্যাপ্লিকেশন নেই গুগলের। আবার ডেক্সটপ অ্যাপ্লিকেশনের দিক দিয়ে মাইক্রোসফট অনেক শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। উইন্ডোজের পাশাপাশি অফিস স্যুট, কম্পিউটার সার্ভারের জন্য বিভিন্ন সফটওয়্যার এবং নতুন ওয়েব ব্রাউজার Edge নিয়ে বেশ এগিয়ে যাচ্ছে মাইক্রোসফট। তবে শুধু ব্রাউজারের কথা ধরে নিলে এখানেও মাইক্রোসফট গুগল থেকে যোজন দূরত্বে পিছিয়ে! কারণ, এখন বিশ্বে সব থেকে বেশি ব্যবহৃত হয় গুগল ক্রোম ব্রাউজার। সাম্প্রতিক সময়ে ক্রোম এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে একসময়ের সর্বাধিক জনপ্রিয় Firefox ব্রাউজারও এর কাছে নতিস্বীকার করেছে। এদিক থেকে ক্রোমের বিপরীতে Edge কে এখনো বাচ্চাই বলা যায়!
তবে এগুলো ছাড়াও মাইক্রোসফটের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি পণ্য Xbox কনসোলস ও গেমস। আর ভিডিও গেমের মার্কেটে মাইক্রোসফটকে ছোঁয়া গুগলের জন্য বেশ কষ্টসাধ্যই হবে বলে ধারণা করা যায়।
যদি ক্রেতারা সীমিত প্রসেসিং ক্ষমতার ডিভাইস ব্যবহার করা শুরু করেন, তাহলে গুগলের সুবিধা বেশি। কারণ গুগলের অধিকাংশ সেবা হল ওয়েব ভিত্তিক। আর এটা ব্যবহার করতে আপনার শুধুমাত্র একটি ওয়েব ব্রাউজার দরকার। তাই এক্ষেত্রে গুগলকে এগিয়ে রাখা যায়।
আবার ক্রেতারা যদি সর্বশেষ ও শক্তিশালী কম্পিউটার ব্যবহারে আগ্রহী থাকেন তাহলে এগিয়ে থাকবে মাইক্রোসফট। কারণ তাদের পণ্যগুলো সাধারণত ফিচার সমৃদ্ধ এবং স্বাভাবিকভাবেই এগুলো ব্যবহার করার জন্য বেশি প্রসেসিং ক্ষমতা সম্পন্ন ডিভাইস প্রয়োজন।
গুগল ও মাইক্রোসফটের ভবিষ্যৎ
এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, গুগল এবং মাইক্রোসফট অদূর ভবিষ্যতেই আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়াবে। একদিকে মাইক্রোসফট তাদের অ্যাপ্লিকেশন উন্নত করে যাচ্ছে। আর অন্যদিকে গুগল এমনভাবে ওয়েব সার্ভিস তৈরি করছে যাতে ডেস্কটপ অ্যাপ্লিকেশনের সব সুবিধা ওয়েবেই পাওয়া যায়। আবার দুটি কোম্পানিই ছোট কোম্পানিকে কিনে নিচ্ছে যাতে নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করা যায়। পণ্যে নতুনত্ব আনার জন্য গুগলের অন্যরকম একটা ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। তাই অনেক দিক থেকে গুগল প্রতিনিয়তই এগিয়ে যাচ্ছে। আবার বেশ কিছু জায়গায় মাইক্রোসফট আগের মতোই তার শক্তিশালী অবস্থান ধরে আছে। গুগল মাইক্রোসফটকে ধ্বংস করবে কিনা এ প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়ত সম্ভব নয়। কিন্তু এটা নিশ্চিত বলা যায়, কোনোদিন সেটা ঘটলেও অদূর ভবিষ্যতেই যে আপনি সেটা দেখতে পাবেন না তা বলা বাহুল্য!