পেনসিল কীভাবে বানায়?

আজকের লেখার শুরুতেই একটি কাল্পনিক দৃশ্যের অবতারণা করা যাক। চিন্তা করুন আপনার ছোটবেলার সেই দিনগুলোর কথা যখন আপনার মা অথবা বাবা হাতে হাত রেখে আপনাকে ‘অ আ ক খ’ আর ‘A B C D’ লেখা শেখাতেন। কী চমৎকারই না ছিলো সেই দিনগুলো, তাই না? বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিজের হাতে লেখার দক্ষতা অর্জন করলেও ছোটবেলায় সঙ্গী পেনসিল কিন্তু আমাদের ছেড়ে যায় নি। বিভিন্ন ছবি আঁকাআঁকির কাজে আজও আমাদের বিশ্বস্ত সঙ্গী কাঠের তৈরি এ জিনিসটি।

মজার ব্যাপার হলো- আমরা অনেকেই জানি না কীভাবে বানানো হয় পেনসিল। একেবারে কাঠ থেকে শুরু করে পুরোপুরি প্রক্রিয়াজাত রুপে পেনসিল বানানোর পদ্ধতিটি জানলে খানিকটা আশ্চর্যই হতে হয়। আজ আমরা জানতে যাচ্ছি মজার সেই প্রক্রিয়াটিই।

পেনসিলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর সীস যা দিয়ে আমরা লেখালেখি কিংবা আঁকাআঁকির কাজ করি। এর ইংরেজি নাম Lead। নাম Lead হলেও বাস্তবে কিন্তু এ সীসে সীসা থাকে না, বরং সেখানে থাকে কার্বনের রুপভেদ গ্রাফাইট আর কাদামাটির সংমিশ্রণ। প্রথমে এ সীস বানানোর প্রক্রিয়াটিই জেনে নেয়া যাক।

(১) প্রথমে অনেকগুলো গ্রাফাইট খন্ড আর কাদামাটি নিয়ে সেগুলো একটি বিশালাকৃতির ঘূর্ণনশীল ড্রামে রাখা হয়। ড্রামে আগে থেকেই রাখা থাকে বড় বড় পাথরের টুকরা। যখন ড্রামটি ঘুরতে থাকে তখন পাথরের টুকরার চাপে গ্রাফাইট আর কাদামাটি একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পাউডারে পরিণত হয়ে যায়। এরপর এ মিশ্রণে পানি মিশিয়ে তিন দিনের মতো রেখে দেয়া হয়।

(২) এরপর এক মেশিনের সাহায্যে এ মিশ্রণ থেকে পানি নিষ্কাশন করা হয়। এভাবে পাওয়া কাদার মতো পদার্থটিকে পরে চারদিনের জন্য রেখে দেয়া হয় যাতে এটি শুকিয়ে শক্ত হতে পারে।

ছবিতে একজন শ্রমিককে গ্রাফাইট-কাদামাটির পানি নিষ্কাশিত অবস্থাকে একটি কেবিনেটে রাখতে দেখা যাচ্ছে

(৩) মিশ্রণটি শুকিয়ে গেলে আরেকটি মেশিনের সাহায্যে একে আবার পাউডারে পরিণত করা হয়। এরপর সেখানে পানি মিশিয়ে মিশ্রণটিকে নরম করা হয়।

(৪) নরম এ মিশ্রণকে পরে ধাতব টিউবের ভেতর ঢুকিয়ে চিকন রডের আকৃতি দেয়া হয়। এরপর সেই রডগুলোকে পেনসিলের সমান আকারে কাটা হয় মেশিনের সাহায্যে। সীসগুলোকে তারপর তুলে দেয়া হয় কনভেয়ার বেল্টে যেখানে তারা শুকাতে থাকে।

(৫) শুকানোর পর সীসগুলোকে ওভেনে ১,৮০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা হয়। ফলে সীসগুলো আরো মসৃণ ও শক্ত হয়ে ওঠে।

এবার আসা যাক পেনসিলে ব্যবহৃত কাঠের কথায়। পেনসিলের জন্য এমন কাঠ বেছে নিতে হবে যা নিয়মিত কাটাকাটির ধকল সহ্য করতে পারে। অধিকাংশ পেনসিলের জন্যই সীডার গাছের কাঠ ব্যবহার করা হয় কারণ এতে সুগন্ধ আছে। এছাড়া এর আকারও সহজে বিকৃত হয় না। এবার তাহলে এ কাঠের প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পর্কে জানা যাক।

(১) সীডার গাছের কাঠ কেটে ও দরকারি প্রক্রিয়াজাতকরণের পর একে ব্লকের আকার দেয়া হয়।

(২) ব্লকটি কেটে একে চিকন চিকন অনেকগুলো খণ্ডে বিভক্ত করা হয় যাকে ইংরেজিতে বলে স্ল্যাট (Slat)। এগুলো ৭.২৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, ০.২৫ ইঞ্চি পুরুত্ব ও ২.৭৫ ইঞ্চি প্রস্থের হয়ে থাকে। কোম্পানিভেদে এ মাপ ভিন্ন হতে পারে। স্ল্যাটগুলোকে এরপর কনভেয়ার বেল্টে তুলে দেয়া হয়।

(৩) এবার স্ল্যাটের তলকে মসৃণ করা হয়।

(৪) বেল্টে থাকা অবস্থাতেই স্ল্যাটে অর্ধবৃত্তাকার খাঁজ কাটা হয়। খাঁজগুলোর পুরুত্ব হয় সীসের পুরুত্বের অর্ধেক।

(৫) এরপর স্ল্যাটগুলোতে আঠা লাগানো হয় আর খাঁজের ভেতরে পেনসিলের সীসগুলো বসিয়ে দেয়া হয়।

(৬) উপরের চারটি ধাপ যখন চলছিলো তখন আরেকটি কনভেয়ার বেল্ট অন্য আরেক ব্যাচ স্ল্যাট বহন করে আনছিলো। এগুলোর আকার, খাঁজের ধরণ সবই পূর্বোক্ত স্ল্যাটগুলোর মতোই। শুধু এগুলোতে কোনো আঠা লাগানো থাকে না এবং খাঁজগুলোতে কোনো সীসও রাখা থাকে না। একসময় এসব স্ল্যাটকে ৪র্থ ধাপে উল্লেখ করা স্ল্যাটগুলোর উপর বসিয়ে দেয়া হয়। এভাবে একটি স্যান্ডউইচ বানানো হয়। এসব স্যান্ডউইচকে বেল্ট থেকে তুলে ক্ল্যাম্পের সাহায্যে আটকে রাখা হয়। এরপর এগুলোকে হাইড্রোলিক প্রেসের সাহায্যে চাপ দেয়া হয় যাতে বাড়তি আঠা চারপাশ দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখনও স্যান্ডউইচগুলোকে ক্ল্যাম্পে আটকে রাখা হয় শুকানোর জন্য। শুকিয়ে গেলে বাড়তি আঠাগুলো ছেঁটে ফেলা হয়।

(৭) এবার স্যান্ডউইচগুলোর দায়িত্ব নেয় কাটিং মেশিন। দ্রুত ঘুর্ণায়মান স্টিল ব্লেডের সাহায্যে এগুলোকে বৃত্তাকার অথবা ষড়ভূজাকার করে কাটা হয়।

(৮) একই মেশিনের সাহায্যে প্রতিটি স্ল্যাট থেকে ৬-৯টি পর্যন্ত আলাদা আলাদা পেনসিল কেটে নেয়া হয়।

(৯) প্রতিটি পেনসিলকে এরপর মসৃণ করা হয় এবং বার্নিশ করে শুকানো হয়। এ কাজগুলোও করা হয়ে থাকে মেশিনের সাহায্যে। যতক্ষণ না পেনসিলে কাঙ্ক্ষিত রঙ ফুটে উঠে ততক্ষণ এ প্রক্রিয়াটি বারবার চলতে থাকে।

(১০) সবার শেষে এসব পেনসিলের পেছনে আঠা অথবা ধাতব কাঁটার সাহায্যে ধাতব কেস লাগানো হয়। এরপর এসব কেসের ভেতর ইরেজার বসিয়ে দিলেই তৈরি হয়ে যায় একেকটি পেনসিল।

গ্রাফাইট খন্ড দিয়ে সীস বানানো থেকে শুরু করে সীডার গাছের কাঠ দিয়ে শেষ পর্যন্ত পরিপূর্ণ একটি পেনসিল পাওয়ার পেছনের প্রযুক্তিগুলো আসলেই বেশ চমৎকার। পেনসিল বানানোর কৌশলের ইতি টানছি এখানেই। তবে শেষ করার আগে একটি মজার ঘটনা বলে বিদায় নিচ্ছি।

হাইমেন লিপম্যান ছিলেন একজন আমেরিকান। একসময় তিনি খেয়াল করলেন পেন্সিল আর ইরেজার আলাদা থাকায় অনেক সময়ই তাকে কিছু ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। এ ঝামেলা থেকেই তিনি পেয়ে গেলেন এক নতুন আইডিয়া, পেন্সিলের পেছনে ইরেজার লাগিয়ে দিলেই তো হয়! আইডিয়াটি তিনি শুধু নিজের পেন্সিলে কাজে লাগিয়েই থেমে যান নি। বরং ১৮৫৮ সালের ৩০ মার্চ তিনি এ আইডিয়াটি নিজের নামে পেটেন্টও করিয়ে নেন! ফলে পেন্সিলের পেছনে ইরেজার লাগানোর প্রথম রেজিস্টার্ড কৃতিত্বটুকু বগলদাবা করে নেন লিপম্যান।

ঘটনা কিন্তু এখানেই শেষ না, বরং এখন তা শুরু হতে যাচ্ছে। ১৮৬২ সালে লিপম্যান তার পেটেন্টটি ১,০০,০০০ ডলারে জোসেফ রেকেনডর্ফার নামে এক লোকের কাছে বিক্রি করে দেন! ভাবা যায়? সেই আমলের এক লাখ ডলার! ১৮৭৫ সালে শুরু হয় এ ঘটনার ট্রাজেডিক অংশটুকু। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট লিপম্যানের এ উদ্ভাবনকে বাতিল ঘোষণা করে। কারণ তাদের মতে লিপম্যান নতুন কিছু করেন নি বরং প্রচলিত দুটি জিনিসকে একত্রিত করেছেন মাত্র! অবশ্য ততদিনে তো লিপম্যানের পকেট ঠিকই ফুলে উঠেছিলো।

So, keep dreaming & make awkward ideas…

তথ্যসূত্র

১) pencils.com/pencil-making-today-2/

২) pencilpages.com/articles/make.htm

৩) madehow.com/Volume-1/Pencil.html

Related Articles

Exit mobile version