পিয়ার-টু-পিয়ার অর্থ লেনদেনের জন্য ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থার শুরুটা হয় বিটকয়েনের মাধ্যমে। ২০০৯ সালে এই বিটকয়েনের সূত্রপাত ক্রিপ্টোকারেন্সির জগতে একটি অভূতপূর্ব বিপ্লবের সূচনা করেছে। বর্তমানে অর্থনৈতিক বাজারে প্রায় পাঁচশো বিভিন্ন ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে। কিন্তু বিটকয়েন এসবের ভিড়ে নিজের শীর্ষ জায়গাটি দখল করে রেখেছে। যেহেতু এটি একটি অর্থনৈতিক মুদ্রাব্যবস্থা এবং মানুষ এই ব্যবস্থা দিয়ে সরাসরি লেনদেন করবে তাই এরকম অর্থনৈতিক লেনদেন আইনের আওতায় পড়বে কিনা, লেনদেনের প্রক্রিয়াতে তৃতীয় কোনো মাধ্যম (যেমন- ব্যাংক) অন্তর্ভুক্ত করা যাবে কিনা এসব নিয়ে ভাবার বিষয় আছে। কারণ, বিটকয়েনের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গ্রাহক এবং প্রেরক ছাড়া অন্য কেউ এই লেনদেন বিষয়ে জানবে না বা এর কোনো রেকর্ড থাকবে না। এরকমটি হওয়ার কারণে অসদুপায় অবলম্বন করা খুব সহজ হয়ে যায়। ট্যাক্স কর্তৃপক্ষ এবং নিয়মনীতি গঠনকারী প্রতিষ্ঠান যারা আছে তাদের জন্য একটি ধাঁধার বিষয় হচ্ছে- বিটকয়েন কি বেআইনি নাকি আইনত বৈধ? এটার সঠিক উত্তর নির্ভর করে জায়গা এবং ব্যবহারকারীর ব্যবহারের উপর।
পৃথিবীর অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিন্তু বিটকয়েনকে স্বীকৃতি দেয়নি। বিটকয়েনকে স্বীকৃতি না দেয়ার কারণ হচ্ছে এর মাধ্যমে যে অর্থের লেনদেন করা হয় সেটা গোপন রাখা হয়। লেনদেন হয় অনলাইনের মাধ্যমে। কোনো প্রকার বিনিময় অর্থ না দিয়েই এক দেশ থেকে আরেক দেশে অর্থ পাঠানো যায় যেকোনো সময়। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এ সম্পর্কে তৃতীয় কেউ কিছু জানতে পারবে না। উল্লেখ্য, বিটকয়েন তৈরি হয় কম্পিউটার দিয়ে তৈরি একধরনের প্রক্রিয়ায়, যাকে বলে মাইনিং।
ব্যবহারকারীরা বিটকয়েন দিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো বিভিন্ন দ্রব্যাদি এবং অন্যান্য সেবাসমূহ ক্রয় করতে পারে। অনলাইনে খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে, এমনকি রাস্তার পাশে অবস্থিত যে বাজারগুলো বসে, যাকে Brick and Mortar Stores বলে, সেখান থেকেও গিফট কার্ড থেকে শুরু করে অন্যান্য চাহিদা মাফিক সেবা বিটকয়েনের সহায়তায় নিতে পারে। বিটকয়েনের সাহায্যে খুব সহজেই অর্থনৈতিক বিনিময় করা যায় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের ভার্চুয়াল কারেন্সি সিস্টেম এই বিটকয়েনের সাহায্যে খুব সহজে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কিন্তু প্রধান সমস্যা হচ্ছে এই ধরনের কারেন্সির কোনো আন্তর্জাতিক আইন এখনও পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করা যায় নি।
বিটকয়েন নিয়ে সবচেয়ে বড় যে সমস্যা সেটা হচ্ছে এর গোপনীয়তা যেটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সুবিধাও আছে যে, যেকোনো সময় পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় এর মাধ্যমে লেনদেন সম্ভব এবং বেশ দক্ষতার সাথেই সেটা সম্ভব। লেনদেনের নিরাপত্তার বিষয়টি বিটকয়েন বেশ ভালোভাবে নিশ্চিত করে। কিন্তু অনেক উন্নত দেশ এখনও বিটকয়েনকে প্রধান লেনদেনের উৎস হিসেবে মর্যাদা দিতে নারাজ। এখনও তারা বিটকয়েনকে ট্রায়াল এন্ড ইররের মধ্যে রেখেছে। তারা কিছুদিন সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা এবং জরিপ করে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চায়। তবে কোনো কোনো দেশ কিছু নিয়মের আওয়াতায় বিটকয়েনকে এনে এর ব্যবহারে বৈধতা দিয়েছে। যেসব দেশে বিটকয়েন আইনত বৈধ সেই বিষয় নিয়েই আজকের আলোচনা।
যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকেই বিটকয়েন নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে এসেছে। কিন্তু কিছু কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান বিটকয়েনের মাধ্যমে যেন কোনো বেআইনি কাজ না হয় সেদিকেও খেয়াল করছে এবং এ ধরনের নেতিবাচক কাজ বন্ধ করতে ভূমিকা পালন করছে। কিছু কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যেমন- Dish Network তাদের পেমেন্ট বিটকয়েনের মাধ্যমে গ্রহণ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের U.S. Department of Treasury’s Financial Crimes Enforcement Network (FinCEN) বিটকয়েন নিয়ে কিছু নির্দেশিকা তৈরির কাজ করছে যেটা ২০১৩ সাল থেকে শুরু হয়েছে। এই ট্রেজারি বিটকয়েনকে কোনো অর্থনৈতিক মুদ্রাব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, বরং এটাকে ব্যবসা করার জন্য একটি অর্থ-সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করার নির্দেশনা দিয়েছে। এছাড়া বিটকয়েন থেকে কর আদায়ের উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে সেখানকার Internal Revenue Service (IRS)।
কানাডা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী দেশ কানাডাও বিটকয়েন লেনদেনের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তারাও বিভিন্ন পণ্য-দ্রব্য এবং সেবাসমূহ বিটকয়েনের মাধ্যমে করা স্থির করেছে। তারা বিটকয়েন মানি লন্ডারিং বা অবৈধভাবে লেনদেনের জন্য সিদ্ধ করেনি। Canadian Revenue Agency (CRA) বিটকয়েনকে পণ্যদ্রব্য বা প্রয়োজনীয় সামগ্রী হিসেবে দেখছে। এর মানে হচ্ছে বিটকয়েন দিয়ে বিনিময় করা যাবে কিন্তু এর থেকে যে আয় হবে সেটা ব্যবসায়িক আয় হিসেবে পরিগণিত হবে এবং এখান থেকে ট্যাক্স আদায় করা হবে। এই ট্যাক্স আদায় হবে বিটকয়েন ব্যবহারকারীর ব্যবসার আচরণের উপর এবং তারা কোথায় কোথায় তাদের অর্থ বিনিয়োগ করছে সেটার উপর নির্ভর করে। বিটকয়েন দিয়ে লেনদেন করতে হলে কানাডাতে Financial Transactions and Reports Analysis থেকে নিবন্ধন করে নিতে হয় যাতে বিটকয়েনের মাধ্যমে করা যেকোনো ধরনের লেনদেন নজরে রাখতে পারে এবং সেগুলোর তথ্য লেখ্যপ্রমাণ হিসেবে রাখতে পারে। তাছাড়া বিটকয়েন এবং অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির জন্য নিয়মনীতি তৈরি করার নির্দেশনা দিয়েছে কানাডা সরকার।
অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়াতে বিটকয়েন শুধু লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয় এবং মাইনিং এর কাজেই ব্যবহার করা হয় না, সেখানে বিটকয়েন দিয়ে বাণিজ্যও করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার ট্যাক্স অফিস বিটকয়েন দিয়ে এই ধরণের লেনদেনের জন্য বৈধ ঘোষণা করেছে এবং আগের দুটি দেশের মতো অস্ট্রেলিয়াতেও ব্যবহারকারী এবং তারা কী ধরনের কাজে এটা ব্যবহার করছে তার উপর ভিত্তি করে বিটকয়েন থেকে কর আদায় করা হয়।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন
যদিও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ক্রিপ্টোকারেন্সির উন্নয়নের পথকে অনুসরণ করেছে কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এবং লিখিতভাবে এর বৈধতা, নিয়মনীতি এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি। কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কিছু কিছু দেশ বিটকয়েন নিয়ে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। কোনো কোনো দেশ বিটকয়েনকে বৈধতা দিয়েছে এবং কোনো কোনোটি আবার এই ধরনের ভার্চুয়াল কারেন্সি নিয়ে সতর্কতামূলক অবস্থান নিয়েছে।
ফিনল্যান্ড এমন একটি দেশ যেখানে বিটকয়েনকে কারেন্সির মর্যাদা না দিয়ে পণ্যদ্রব্য বা কমোডিটি হিসেবে বৈধতা দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বিটকয়েনকে তারা কর আরোপ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। এছাড়া বেলজিয়ামেও বিটকয়েন নিয়ে তাদের Federal Public Service Finance একই রকম ঘোষণা দিয়েছে। সাইপ্রাসেও বিটকয়েন চালু হয়েছে। সেখানে বিটকয়েনকে কোনো আইনের মধ্যে যদিও আনা হয়নি, কিন্তু অবৈধও করা হয়নি।
ইউনাইটেড কিংডমে বিটকয়েনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়নি কিন্তু সেখানে এর ব্যবহারকে কিছু নিয়মের আওয়াতায় আনার জন্য তাদের Financial Conduct Authority এর ব্যবহারকে নজরদারির মধ্যে এনেছে। উপরিউক্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত দেশের মতো সেখানে বিটকয়েন থেকে কর বাদ দেয়া হয়নি, বরং আরোপ করা হয়েছে। একই রকম বিটকয়েনকে করের আওতায় এনেছে বুলগেরিয়ার National Revenue Agency (NRA)।
জার্মানিতেও বিটকয়েন বৈধতা পেয়েছে। কিন্তু এটাকে ট্যাক্সের আওতায় আনা হয়েছে সেখানে। কিন্তু এই ট্যাক্সের পরিমাণ নির্ভর করবে ব্যবহারকারী, ব্যবসার ধরণ, মাইনিং এর ধরণ এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রকৃতির উপর।
ফিচার ইমেজ সোর্স: Techzim.com