নেট নিউট্রালিটি: যেভাবে ইন্টারনেট প্রোভাইডাররা নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের

অনলাইন জগতের সাথে আমাদের সংযোগ এখন অনেকটা মৌলিক চাহিদায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে প্রতিটি ক্ষেত্রই কোনো না কোনোভাবে ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত। বিশ্বের সম্মুখসারির দেশগুলো তাদের সেবা এবং ব্যবস্থাসমূহ প্রায় সম্পূর্ণ ইন্টারনেট-নির্ভর করে ফেলেছে। এর ফলে একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার বা আইএসপি (ISP)-দের হাতে চলে যাচ্ছে।

Image Courtesy: VPNpro

 

প্রতিটি আইএসপি ব্যবহারকারীর কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে। তারা চাইলেই আপনার পছন্দের ওয়েবসাইটে গতি কমিয়ে দিতে পারে কিংবা কোনো ওয়েবসাইটে প্রবেশ একেবারেই বন্ধ করে দিতে পারে। আমরা ব্রডব্যান্ড সংযোগে বিভিন্ন গতির প্যাকেজ দেখি। কিন্তু সব ওয়েবসাইটেই কি আমরা সেই গতির সবটুকু পেয়ে থাকি? সিম অপারেটররা আমাদের প্রযোজ্য গতির কতটুকু প্রদান করছে? নেট নিউট্রালিটির প্রভাব আমাদের দেশে নীরব থাকলেও এটি একটি বৈশ্বিক জটিলতায় পরিণত হয়েছে।

নেট নিউট্রালিটি কী?

পৃথিবীব্যাপী একটি বৃহৎ নেটওয়ার্ক হচ্ছে ইন্টারনেট। এই নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা দুটি স্বতন্ত্র অংশ দিয়ে তৈরি। আমরা যখন ওয়েব ব্রাউজ করি তখন আমরা যা দেখি তা হচ্ছে ইন্টারনেটের বিষয়বস্তু বা কন্টেন্ট। যত সাইট আমরা ব্রাউজ করি, তা হোক খবরের কিংবা ব্যবসায়িক কাজ বা বিনোদনের জন্য, এসব হচ্ছে ইন্টারনেটের কন্টেন্ট।

ইন্টারনেটের যে দিকটি আমরা দেখতে পারি না তা হলো এর অবকাঠামোগত দিক। এগুলো হলো স্যাটেলাইট, সেল টাওয়ার, সার্ভার, ফাইবার অপটিকসহ যাবতীয় যন্ত্রাংশ যা প্রতিনিয়ত এক সাইট থেকে আরেক সাইটে এই কন্টেন্টগুলো আদান-প্রদান করছে। এই দিকগুলো নিয়ন্ত্রণ করে যারা আমাদের ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে তারা, যেমন- ব্রডব্যান্ড কিংবা সিম অপারেটর। সমস্যা হলো আইএসপিরা আপনার ইন্টারনেটের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করে, আপনার অনলাইন জগতটি তাদের সামনে উন্মুক্ত, যেমন- সোশ্যাল মিডিয়ায় পায়চারা, ভিডিও স্ট্রিমিং কিংবা অনলাইন গেমিংসহ আরও অনেক কর্মকাণ্ড।

এর অর্থ হচ্ছে তারা চাইলে তাদের সার্ভারের মাধ্যমে কিছু সাইট স্লো কিংবা ব্লক করে দিতে পারে এবং কিছু সাইটের গতি বাড়িয়েও দিতে পারে বা ‘ফাস্ট লেন’ হিসেবে যুক্ত করতে পারে। ফাস্ট লেন-এ যুক্ত সাইটগুলোতে সবসময় হাই স্পিড পাওয়া যায়।

ফাস্ট লেন বনাম সাধারণ; Image Source: Beneficial State

এখন আপনার মনে হতে পারে স্পিড বাড়ালে সমস্যা কোথায়। ধরুন, মুভি দেখার জন্য আপনার একটি পছন্দের সাইট রয়েছে, যেখানে আপনি সাবস্ক্রিপশন কিনেছেন। স্বভাবতই মুভি স্ট্রিমিং করার জন্য দ্রুতগতির ইন্টারনেট দরকার, তাই আপনি একটি হাই স্পিড প্যাকেজ কিনলেন। কিন্তু হাই স্পিড প্যাকেজ কেনার পরেও দেখা যাচ্ছে আপনার বাফারিং হচ্ছে, ঠিকমতো চালানো যাচ্ছে না। অথচ অন্য কিছু সাইটে সর্বোচ্চ স্পিডই পাচ্ছেন। আপনার আইএসপিকে জানানোর পর তারা বললো, ঐ সাইট চালানোর জন্য আপনাকে আলাদা টাকা দিতে হবে অথবা আপনি তাদের পছন্দনীয় ওয়েবসাইটে যদি সাবস্ক্রিপশন করেন তাহলে নিরবচ্ছিন্ন এবং উচ্চগতির সেবা পেতে পারেন। এছাড়া কোনো মোবাইল অপারেটরও তাদের নিজস্ব স্ট্রিমিং সার্ভিস জনপ্রিয় করে তুলতে অন্যান্য স্ট্রিমিং সাইটে ডাটা ক্যাপ বা গতি কমিয়ে রাখতে পারে।

নেট নিউট্রালিটি কী; Image Source: Ip Vanish

এখানেই নেট নিউট্রালিটি বা নিরপেক্ষতার বিষয়টি আসে। অর্থাৎ সহজ কথায়, আপনি অনলাইনে যা করবেন সেটি একান্তই আপনার ইচ্ছা। এখানে গতি কমিয়ে বা ফাস্ট লেন যুক্ত করে বা কিছু সাইট ব্যবহারের জন্য ভিন্ন প্যাকেজ তৈরি করে আপনার ব্যবহারের প্রাধান্যকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তারা রাখে না। তারা বিভিন্ন গতিসম্পন্ন প্যাকেজ তৈরি করতে পারবে, কিন্তু সেই প্যাকেজের প্রদত্ত স্পিড দিয়ে আপনি যা করবেন সেটা আপনার ব্যাপার।

নেট নিউট্রালিটি এবং ইন্টারনেটকে উন্মুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করার পক্ষে দীর্ঘকাল ধরে সাধারণ মানুষেরা লড়ে আসছে। যদি ইন্টারনেট প্রোভাইডাররা তাদের পছন্দ অনুযায়ী অনলাইন কোম্পানি, প্রযুক্তি বাছাই করে তাহলে অনেক নতুন কোম্পানি হয়তো কখনও তাদের পরিধি বৃদ্ধি করার সুযোগ পাবে না। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই চিত্র ভিন্ন হতে পারে, তবে বহির্বিশ্বে এর প্রভাব গুরুতর।

নেট নিউট্রালিটির ইতিহাস

২০০৩ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টিম ইয়ু সংবাদপত্রে অনলাইন বৈষম্য নিয়ে একটি লেখায় ‘নেট নিউট্রালিটি’ টার্মটি ব্যবহার করেন। সেসময় আমেরিকায় কিছু ব্রডব্যান্ড প্রোভাইডার তাদের ব্যবহারকারীদের জন্য ভিপিএন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। এছাড়া আরও কিছু মোবাইল অপারেটর ওয়াইফাই-রাউটার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তিনি ভেবেছিলেন, ইন্টারনেট প্রোভাইডারদের এই নতুন প্রযুক্তিতে তৈরি সীমাবদ্ধতাগুলো দীর্ঘমেয়াদী উদ্ভাবনের ক্ষতি করবে।

আইএসপি কর্তৃক ওয়েবসাইট ব্লক; Image Source: Martechtoday

২০০৫ সালে বুশ সরকারের আমলে এফসিসি (Federal Communications Commission) প্রথম ইন্টারনেট বৈষম্যের উপর একটি আইনি বিবৃতি প্রকাশ করে। এই বিবৃতিতে আইএসপিদের বৈধ কন্টেন্ট ব্লক, প্যাকেজ গ্রহণে চাপ প্রয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়। এই নীতিমালার অধীনে ২০০৮ সালে এফসিসি Comcast-কে পি-টু-পি কানেকশনসমূহের (যেমন- বিটটরেন্ট) গতি কমিয়ে দিতে বলে। বিটটরেন্টের বৈধ ব্যবহার থাকলেও তখন এটি ডিজিটাল পাইরেসিতে ব্যবহার হচ্ছিল। এরপর Comcast এফসিসির বিরুদ্ধে মামলা করে। আদালত রায় দেয়- এফসিসি তাদের নীতিমালা কার্যকরে ব্যর্থ হয়েছে।

২০১০ সালে ওবামার যুগে এফসিসি পুনরায় নেট নিউট্রালিটির উপর একটি নীতিমালা প্রদান করে, যা আগের থেকে আরও শক্তিশালী ছিল। কিন্তু আবারও এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়, এবার করে Verizon। একই আদালত ২০১৪ সালে রায় দেয়- এফসিসি নেটওয়ার্ক অপারেটরদের উপর নেট নিউট্রালিটি সম্পর্কিত কোনো প্রবিধান আরোপ করার ক্ষমতা রাখে না। অনেক জল্পনা-কল্পনার পর ২০১৫ সালে এফসিসি পুনরায় নেট নিউট্রালিটি নিয়ে একটি আইনি বিধান তৈরি করে এবং এবারও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। কিন্তু সেবার রায় তাদের পক্ষ নেয়, যদিও তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়।

২০১৬ সালে নির্বাচনের পর এফসিসির চেয়ারম্যান পরিবর্তিত হয়। নতুন চেয়ারম্যান অজিত পাই ২০১৫ সালের নেট নিউট্রালিটি নীতিমালা পরিবর্তন করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চান। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এফসিসিতে ভোট হয় এবং ২০১৫ এর নীতিমালাকে সম্পূর্ণরুপে বাতিল করে দেয়া হয়। এরই সাথে নেট নিউট্রালিটিকে মৃত হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

নেট নিউট্রালিটির প্রভাব ও ভবিষ্যৎ

২০১৫ সালে ওবামা প্রশাসন আইএসপিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে নেট নিউট্রালিটির যে বিধিমালা কার্যকর করে তা হলো:

  • আইএসপি কোনো ওয়েবসাইট বা অ্যাপ্লিকেশন ব্লক করার ক্ষমতা রাখে না।
  • কোনো বৈধ কন্টেন্টের গতি কমিয়ে দেয়া যাবে না।
  • আইএসপিরা বিভিন্ন কোম্পানি ও ভোক্তার জন্য ফাস্ট লেন চালু করে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করতে পারবে না।

হয়তো গ্রাহকরা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করবে না, কিন্তু ধীরে ধীরে এটি সকলকে গ্রাস করবে। এবং এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় থাকবে না। ইতিমধ্যে আমরা বিভিন্ন রকমের ডাটা প্যাকেজ দেখছি, যেগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজনে কাজে লাগে, একই পরিমাণ ডাটার মূল্য কাজভেদে ভিন্ন হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সকল ডাটা প্যাক দিয়ে ফেসবুক, গুগল ব্রাউজ করা যাচ্ছে। কিন্তু নেটফ্লিক্স/ইউটিউব দেখার জন্য আপনাকে স্ট্রিমিং ডাটা প্যাক নিতে হলো অথবা যদি আপনি সকল কিছু ব্রাউজ করতে চান তাহলে আপনাকে তুলনামূলক বেশি দামি প্যাকেজ নিতে হবে। অথবা থাকতে পারে সোশ্যাল মিডিয়া প্যাক কিংবা মিউজিক প্যাক। অর্থাৎ এই যে ইন্টারনেটের প্রতিটি ক্ষেত্রকে ভিন্নভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে এটিই নেট নিউট্রালিটি না থাকার প্রভাব। আপনি ১০ এমবিপিএস-এর প্যাকেজ গ্রহণ করেও যে প্রযোজ্য স্পিড পাবেন এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।

নেট নিউট্রালিটি না থাকায় যা হতে পারেল Image Source: Medium

শুধু গ্রাহকের ক্ষেত্রে নয়, কোনো ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডেও এটি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। জনপ্রিয় কোনো সাইট চালাতে হলে যেমন আপনাকে অতিরিক্ত দাম দিতে হচ্ছে, তেমনই বিভিন্ন কোম্পানিকেও আইএসপিদের সাথে সমঝোতায় আসতে হচ্ছে। ফাস্ট লেন তৈরি করে নির্দিষ্ট কিছু সাইটকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, যার ফলে অন্য সাইটগুলো তাদের ব্যবহারকারীর সংখ্যা হারাচ্ছে। নতুন কোম্পানিগুলো আইএসপিদের তাদের সাইটে যাতে সর্বোচ্চ স্পিড পাওয়া যায় সেজন্য অতিরিক্ত মূল্য প্রদান করতে হচ্ছে। অথবা কোনো কোম্পানি অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে তাদের সুবিধার ক্ষেত্র তৈরি করে অন্যদের উপরও চাপের সৃষ্টি করছে।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে সরকার প্রদত্ত কোনো আইন ছাড়া এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। সরকারকে জানান দেয়ার জন্য ব্যবহারকারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। এর মাঝেও অনেক ইন্টারনেট প্রোভাইডার ভালো সুবিধা দিয়ে থাকে, কিন্ত তাদের সংখ্যা সীমিত। প্রতিনিয়ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে, তাই আপনার আশেপাশে যদি ভালো কোনো আইএসপি থাকে তাহলে তাদের কাজ বর্ধিত করতে সহায়তা করুন এবং অনলাইন বৈষম্যকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

Related Articles

Exit mobile version