আপনার নতুন কেনা শখের স্মার্টফোনটি পকেটে আছে। মোবাইলটির প্রতি যথেষ্ট যত্নবান আপনি। কিন্তু প্রবল ব্যস্ততার কারণে একদিন ভুল হয়ে গেল। যে পকেটে মোবাইলটি রেখেছেন, নিজের গাড়ির চাবি ভুল-ক্রমে ফেলে দিলেন সেই পকেটে। ব্যস্ততা থেকে বের হয়ে এসে যখন মোবাইলটি বের করলেন, এক পকেটে চাবি ও মোবাইল রাখার শাস্তি আপনার শখের বস্তুটি পেয়ে গেছে। স্মার্টফোনের ডিসপ্লের উপর অসংখ্য আঁচড়ের দাগ, যা আর সহজে বিদায় নেবে না।
আইফোন, অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন বা অন্য যে কোন মোবাইলের উপর থেকে এ দাগ দূর করার একমাত্র উপায় মোবাইলের স্ক্রিন বদলে ফেলা। উদহরণস্বরূপ, যদি আপনার ডিভাইসটি অ্যাপল হয় এবং আপনার অ্যাপলকেয়ার থাকে, তবে এই স্ক্রিন পাল্টে ফেলতে আপনার খরচ হবে ২৯ ডলার। যা বাংলাদেশে প্রায় ২,৪৬৫ টাকার মতো। আর যদি আপনার ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, তবে আপনাকে গুনতে হবে প্রায় ১২৯ থেকে ১৪৯ ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৩ হাজার টাকার মতো।
তাই ঘষা লেগে বা পড়ে গিয়ে যে আঁচড় পড়ে, তা দূর করার জন্য নিশ্চয়ই আপনি এতগুলো অর্থ ব্যয় করার জন্য ভাববেন না। তবে কিছু ঘরোয়া উপকরণ ব্যবহার করে আপনি খুব সহজে এই দাগগুলো দূর করতে পারেন। তেমন কয়েকটি পদ্ধতি নিয়েই আজকের প্রতিবেদন।
তবে এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহারের পূর্বে আপনার স্মার্টফোন বা ডিভাইসটি বন্ধ করে নেয়া জরুরি। বর্তমান স্মার্টফোনগুলোতে ব্যাটারি খুলে ফেলার সুযোগ থাকে না। কিন্তু যদি ব্যাটারি খোলা যায়, তো চেষ্টা করবেন খুলে ফেলতে। আর হেডফোন, চার্জার বা অনান্য পোর্টগুলো, যেগুলো দিয়ে কোন তরল পদার্থ অনায়াসে ভেতরে ঢুকতে পারে, সে পথগুলো সতর্কতার সাথে টেপ বা অন্য কোনো উপায়ে বন্ধ করে নিতে হবে।
টুথপেস্ট
আমাদের দিনের শুরু ও শেষই হয় এ বস্তু দিয়ে। এই সহজলভ্য বস্তু দিয়ে মোবাইলের ডিসপ্লের আঁচড় তুলতে আপনি ব্যবহার করতে পারেন। তবে আঁচড় তুলতে জেলজাতীয় টুথপেষ্ট ব্যবহার করা যাবে না।
প্রথমে তুলা, নরম কাপড় অথবা কর্নবাডের মাথায় আলতো করে পেস্ট লাগিয়ে নিন। এরপর যে স্থানে আঁচড় পড়েছে, সেখানে আলতো করে ঘষুন। কিছু সময় ঘষার পর দাগ উঠে যাবার কথা। এরপর একটি ভেজা কাপড় দিয়ে পুনরায় বাড়তি পেস্টটুকু ফোনস্ক্রিন থেকে মুছে ফেলুন।
এই পদ্ধতি শুধু স্মার্টফোনের ডিসপ্লে নয়, আপনার হাতের স্মার্টওয়াচের ডিসপ্লে বা ক্যামেরার লেন্সের ক্ষেত্রেও দারুণ কার্যকরী।
শিরিষ কাগজ
শিরিষ কাগজ ব্যবহার করা হয় কোনোকিছু মসৃণ করার জন্য। কিন্তু হাত থেকে পরে বা ঘষা লেগে হওয়া দাগের শিরিষ সিরিজ কাগজ তেমন কাজে আসবে না। উল্টে আঁচড় দূর করার কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে আরও বেশি পরিমাণ আঁচড় ফেলার ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে হাত থেকে পড়ে কোথাও ধারালো হয়ে গেলে বা, দাগের ধরণটা সাধারণ না হলে শিরিষ কাগজ বেশ উপকারী।
তাই খুব প্রয়োজন না হলে, এটি ব্যবহার না করাই ভালো। আর ব্যবহার করতে হলে ভালো মানের এবং মসৃণ শিরিষ কাগজ, খুব সাবধানে ব্যবহার করা উচিত।
বেকিং সোডা
স্ক্র্যাচ দূর করার জন্য বেকিং সোডার ব্যবহার বেশ দারুণ একটি পদ্ধতি। কিন্তু এটি অনুসরণ করতে হলেও আপনাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ আপনি অবশ্যই চান না, স্ক্র্যাচ দূর করতে গিয়ে আপনার স্মার্টফোনটি পানিতে ভিজিয়ে নষ্ট করতে!
একটি পাত্রে দু’ভাগ বেকিং সোডা ও একভাগ পরিষ্কার পানি নিয়ে ঘন মিশ্রণ না হওয়া পর্যন্ত ভালোভাবে মেশাতে থাকুন। এরপরের ব্যবহারটি টুথপেস্টের মতোই। পরিষ্কার নরম কাপড় দিয়ে তৈরী মিশ্রণটি স্ক্র্যাচের উপর লাগাতে হবে এবং আলতো করে ঘষে অন্য একটি নরম কাপড় দিয়ে মুছে ফেলতে হবে।
আপনার ডিভাইসের স্ক্র্যাচ যদি খুব বেশি গভীর না হয়, তবে বেকিং সোডা ব্যবহার করে এই স্ক্র্যাচ তুলে ফেলা তেমন জটিল কোনো কাজ না।
বেবি পাউডার
বেবি পাউডারের ব্যবহার ঐ বেকিং সোডার মতোই। একইভাবে পেষ্ট তৈরি করে স্ক্র্যাচের ওপর প্রয়োগ করতে হবে। তবে বেবি পাউডার ব্যবহারেও একই পরিমাণ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোনোভাবে পানি বা পেষ্ট যেন আপনার স্মার্টফোনের ভেতরের অংশে না পৌঁছাতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
ভেজিটেবল অয়েল
ছোট ও লুকোনো আঁচড়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে ভেজিটেবল অয়েল, যা সাময়িক সমাধান হিসেবে দারুণ কাজের। আঁচড়ের ওপর এক ফোঁটা তেল নিয়ে মুছে ফেললে দ্রুত কসমেটিক ফিক্স হিসেবে কাজ করে। ভেজিটেবল অয়েলের ক্ষেত্রে আরও বেশি সাবধানী হওয়া উচিত। কারণ এ পর্যন্ত সবই ছিলো পেষ্ট জাতীয় পদার্থের ব্যবহার কিন্তু এবারের টোটকা একদম তরল।
ডিম এবং পটাসিয়াম অ্যালুমিনিয়াম সালফেট
এতক্ষণ যেসব পদার্থের নাম বলা হচ্ছিল, তা খুব সহজেই সংগ্রহ করা সম্ভব। তবে পটাসিয়াম অ্যালুমিনিয়াম সালফেট সে তুলনায় পাওয়া কঠিন। তবে আপনার বাড়ির পাশের ফার্মেসিতেই এই রাসায়নিক কিনতে পাওয়া যাবে। আর এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হলে আপনার লাগবে ডিম, সিন্থেটিক কাপড়, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল ও পটাসিয়াম অ্যালুমিনিয়াম সালফেট।
প্রথমে ডিমের সাদা অংশ এবং অ্যালুমিনিয়াম সালফেট একটি পাত্রে ভালোভাবে মিশিয়ে ১৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় গরম করুন। এরপর ঐ সিন্থেটিক কাপড়টি গরম করা ডিম ও অ্যালুমিনিয়াম সালফেট দ্রবণ ভিজিয়ে নিন। ভেজানো কাপড়টি অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে রেখে ওভেনে ৩০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গরম করুন, যতক্ষণ না পর্যন্ত কাপড়টি সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে যায়।
কাপড়টি শুকিয়ে গেলে ওভেন থেকে বের করে ২০ অথবা ৩০ সেকেন্ড ধরে আলতোভাবে ভেজান। এই একই কাজ কমপক্ষে তিনবার করুন এবং কাপড়টি এবার ৪৮ ঘণ্টার জন্য বাতাসে শুকোতে দিন।
এবার, ঐ কাপড়টি আপনার স্মার্টফোনের স্ক্রিনের আঁচড় দূর করার কাজে ব্যবহার করতে পারেন।
ব্যাসো, সিলভো বা অনান্য পলিশ
ব্যাসো, সিলভো বা অনান্য পলিশ স্মার্টফোনের ডিসপ্লের উপর সরাসরি ব্যবহার বেশ বিপদজনক। এতে স্ক্রিনে আরও বেশি বড় আঁচড়ের দাগ পড়তে পারে। তাই এই পদার্থ ব্যবহার করতে চাইলে সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে।
প্রথমে একটি বাটিতে পলিশ ঢেলে নিন। বাটির নিচে একটি কাপড় দেয়া ভালো। এতে পলিশ বাইরে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। একটি কাপড় ভালোভাবে পলিশে চোবান ও আঁচড়ের উপরে গোল করে ঘষতে থাকুন। আঁচড়ের দাগ উঠে গেলে অন্য একটি কাপড় দিয়ে ডিসপ্লেতে লেগে থাকা পলিশ ভালোভাবে মুছে ফেলুন। দরকার হলে পানি বা ভেজা কাপড় ব্যবহার করুন।
এছাড়াও, ম্যাজিক ইরেজার (যা এক প্রকার শিরিষ কাগজ) ডিসপ্লের আঁচড় তুলতে ব্যবহার করা হয়। গাড়ির কাঁচের আঁচড়ের দাগ তোলার ক্রিম টার্টল ওয়্যাক্স, ৩-এম স্ক্র্যাচ ও সোয়ার্ল রিমুভার ব্যবহার করা যায়। তবে স্মার্টফোনের মতো ডিভাইসের পর্দার হালকা দাগ বা আঁচড় তুলতে টুথপেস্ট ও বেকিং সোডার ব্যবহারই সবথেকে নিরাপদ। আর ক্যামেরার লেন্সের মতো স্পর্শকাতর অংশে শিরিষ কাগজ বা বেকিং সোডার মতো পদার্থ না ব্যবহার করাই ভালো। সেক্ষেত্রে সবথেকে নিরাপদ হচ্ছে টুথপেস্ট। আর এসব পদ্ধতি ব্যবহার করেও দাগ সরাতে না পারলে স্ক্রিন বদলে ফেলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো রাস্তা আপনার জন্য খোলা নেই।
যদিও স্মার্টফোনের আঁচড় ওঠাতে এগুলোর পাশাপাশি বেশ কিছু গুজব চালু আছে। যেমন- অনেকের ধারণা, কলার খোসা বা পেন্সিলের দাগ মোছার জন্য ব্যবহৃত ইরেজার, পেট্রোলিয়াম জেলি বা নারকেল তেল দিয়ে আঁচড় ওঠানো সম্ভব। আসলে এগুলো ব্যবহার করে আসলে আঁচড় বা দাগ ওঠানো সম্ভব না। নারকেল তেল বা পেট্রোলিয়াম জেলি আপনার মোবাইলের ডিসপ্লে পিচ্ছিল করে দেবে। কলার খোসা ব্যবহার করে দেখা গেছে, কলার খোসা এ কাজের জন্য নয়। পেন্সিলের দাগ মোছার ইরেজার আসলে কোনোকিছুর দাগ ওঠানোর জন্য মাঝে মাঝে কাজ করে, আঁচড় মুছে ফেলার ক্ষমতা রাবারের নেই। তাই এসব পন্থা অবলম্বন করা শুধুমাত্র সময় নষ্ট করে গুজবের অংশীদার হওয়া।