আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, মাত্র এক বছর আগেও ফেসবুকে যেকোনো স্ট্যাটাসে শুধুই লাইক দেওয়া যেত; হাহা, লাভ বা অ্যাংগ্রি রিঅ্যাকশন দেওয়া যেত না। কিন্তু কারও কি মনে আছে, এক সময় ফেসবুকে লাইকও দেওয়া যেত না? এটিই হচ্ছে ফেসবুকের বৈশিষ্ট্য। ফেসবুক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে জানে।
ফেসবুক বিশ্বের প্রথম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। এর আগেও মাইস্পেসের মতো সাইট ছিল, এর পরেও গুগল প্লাসের মতো সাইট এসেছে। কিন্তু তারা কেউ যে ফেসবুকের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি, তার কারণ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ফেসবুক বছর বছর নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজিয়েছে।
টাইমলাইন থেকে শুরু করে ফেসবুকের প্রায় প্রতিটি বড় ধরনের পরিবর্তনের পর ব্যবহারকারীদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকটাই ঋণাত্মক। অনেকে এমনকি এসব পরিবর্তন বাতিল করা না হলে ফেসবুক ছেড়ে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছিল। কিন্তু ফেসবুক এসব পরিবর্তন বাতিল করেনি, মানুষও ফেসবুক ছেড়ে যায়নি, বরং সময়ের সাথে এসব নতুন সুযোগ-সুবিধার প্রতি আরও আসক্ত হয়ে পড়েছে। ফেসবুক প্রমাণ করেছে, তারা সময়ের চেয়ে অনেক অগ্রগামী। তারা যেসব সুবিধা চালু করেছে, পরে সেগুলোই ইন্টারনেটে মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক, শুরু থেকে ফেসবুক কীভাবে ধাপে ধাপে আজকের চেহারায় এসে দাঁড়িয়েছে।
২০০৪: যাত্রা শুরু
ফেসবুকের যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে। প্রথমে এটি শুধুই হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল। সেসময় কোনো স্ট্যাটাস, ছবি, নিউজ ফিড তো দূরের কথা, ইউনিভার্সিটির সার্ভারে থাকা তথ্যের বাইরে এতে বাড়তি তেমন কিছুই ছিল না। এ সময় সাইটটির নাম ছিল The Facebook। ওয়েবসাইটের ব্যানারে ছিল প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের ছবি এবং নিচে ছিল তার নাম। আর হোমপেজেই হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির নাম বড় হাতের অক্ষরে লেখা ছিল।
প্রথমে হার্ভার্ডে শুরু হলেও কয়েক মাসের মধ্যেই এটি স্ট্যানফোর্ড, কলম্বিয়া, ইয়েল সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৪ সালের শেষ নাগাদ এর ব্যবহারকারী ১০ লাখে পৌঁছে যায়।
২০০৫: ফেসবুকে ফেস সংযোজন
নামে ফেসবুক হলেও প্রথম বছর এটি ছিল মূলত ব্যবহারকারীদের তথ্য সম্বলিত একটি ডেটাবেজ। কোনো ব্যবহারকারীর ফেস বা চেহারার কোনো ছবি সেখানে ছিল না। ২০০৫ সালের অক্টোবরে ফেসবুক প্রথমবারের মতো তথ্যের পাশাপাশি ব্যবহারকারীকে তার একটি পরিচয়মূলক ছবি আপলোড করার সুযোগ দেয়। সার্থকতা পায় ফেসবুক নামটি।
সে বছরই দ্য ফেসবুক সাইটটি নিজের নাম থেকে The শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু ফেসবুক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই নামে ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন করতে সাইটটি খরচ করে ২ লাখ ডলার। এ বছর ফেসবুক ইউনিভার্সিটি ছাড়িয়ে হাই স্কুলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।
২০০৬: নিউজ ফিড
সে বছর ফেসবুককে সব ধরনের ব্যবহারকারীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ন্যূনতম ১৩ বছর বয়সী যে কেউ একটি ইমেইল আইডির মালিক হলেই ফেসবুকে রেজিস্ট্রেশন করতে পারত।
সেবারই প্রথম নিউজ ফিড চালু করা হয়। বন্ধুরা কে কার সাথে নতুন বন্ধুত্ব পাতিয়েছে, কে কী ছবি আপলোড করেছে- সেগুলো ব্যবহারকারীদের নিউজ ফিডে ভেসে আসা শুরু হয়। সে সময় এটি নিয়ে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়। অনেকের মতে এটি ছিল ব্যক্তিগত নিরাপত্তার লঙ্ঘন- একজন কী ছবি আপলোড করছে, কাকে বন্ধু বানাচ্ছে, কার সাথে সম্পর্কে জড়াচ্ছে- সেটা কেন অন্যরা জানবে?
সে বছর প্রাক্তন সহপাঠী এবং বন্ধুদেরকে খুঁজে বের করার জন্য সার্চ বক্স চালু করা হয়। সেসময় মাত্র একটি স্ট্যাটাস আপডেট করা যেতো, কিন্তু সেটি নিজের প্রোফাইলেই সীমাবদ্ধ থাকত, অন্যের নিউজ ফিডে প্রদর্শিত হতো না। এ সময় প্রথমবারের মতো একাধিক ছবি আপলোড করার সুযোগ তৈরি হয়। সে বছরে ফেসবুকের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যায়।
২০০৭: গিফট
২০০৭ সালে ফেসবুকে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে এ সময় ফেসবুক বন্ধুদেরকে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে গিফট পাঠানোর সুবিধা প্রচলন করে। পরে অবশ্য ২০১০ সালে এই গিফট সুবিধাটি বাতিল করা হয়। এ বছরই প্রথমবারের মতো ভিডিও পোস্ট করার এবং ভিডিও চালু করার সুবিধা যুক্ত হয়।
এ বছর সর্বোচ্চ তিনটি স্ট্যাটাস হোমপেজে প্রদর্শনের সুবিধা চালু হয়। তবে স্ট্যাটাসগুলো is দিয়ে শুরু করতে হতো, কারণ ফেসবুক প্রতিটি স্ট্যাটাসের আগে ব্যবহারকারীর নাম যুক্ত করে দিত। যেমন আপনি (User) যদি লিখতেন I am watching a movie, তাহলে সেটা প্রদর্শিত হতো User I am watching a movie- এভাবে। কাজেই ব্যবহারকারীদেরকে স্ট্যাটাস দিতে হতো এভাবে- is watching a movie, ফলে তা প্রদর্শিত হতো – User is watching a movie।
২০০৮: চ্যাটবক্স
সেসময় চ্যাট বলতেই মানুষ বুঝত ইয়াহু অথবা এমএসএন ম্যাসেঞ্জার। কিন্তু আজ যে বিশ্বব্যাপী ফেসবুক চ্যাট এবং মেসেঞ্জারের বিপুল ব্যবহার, তার শুরুটা হয়েছিল ২০০৮ সালে। এ বছর ফেসবুক উপরের দিকে একটি মেনুবার এবং একাধিক ট্যাব প্রচলনের মাধ্যমে আরো ব্যবহার-বান্ধব এবং গোছানো সাইটে পরিণত হয়।
২০০৮ সাল পর্যন্তও ফেসবুক সত্যিকার অর্থে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠতে পারেনি, বরং তা ছিল বন্ধুদের সম্পর্কে তথ্য জানার মাধ্যম। সে বছর ফেসবুক ১০ কোটি ব্যবহারকারীর মাইলফলক অর্জন করে।
২০০৯: লাইক ও কমেন্ট
২০০৯ সালের আগেও স্ট্যাটাস আপডেট করা যেত, কিন্তু সেগুলোতে লাইক দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। সে বছরই ফেসবুক প্রথম লাইক এবং কমেন্ট সুবিধা চালু করে। বর্তমানে আমরা ফেসবুক বলতে যা বুঝি, তার প্রথম যাত্রা হয় এ সময় থেকেই। সেসময় স্ট্যাটাস বক্স অনেকটা বর্তমানের চেহারা লাভ করে। এর মাধ্যমে স্ট্যাটাস, ছবি ছাড়াও বিভিন্ন লিংক এবং ভিডিও পোস্ট করার সুযোগ তৈরি হয়। এ বছরই স্ট্যাটাসে বন্ধুদেরকে ট্যাগ করার সুযোগ চালু হয়।
এ সময় রিয়েল-টাইম স্ট্রিম নিউজ ফিড চালু হয়। অর্থাৎ কেউ কোনো তথ্য হালনাগাদ করলে মুহূর্তের মধ্যেই তার বন্ধুরা সেটি জানতে পারবে এবং গুরুত্বপূর্ণ আপডেটগুলো নোটিফিকেশনের মাধ্যমে হাজির হবে। এ বছর থেকে ফেসবুক ব্যবহারকারীদেরকে তাদের বন্ধুদের জন্মদিন মনে করিয়ে দিতে থাকে। এ বছরই ফেসবুক প্রথম ইংরেজির বাইরে আরবি এবং হিব্রু ভাষায় ব্যবহারের সুবিধা চালু হয়। সে বছর ফেসবুক ৫০ কোটি ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে যায়।
২০১০: চেকইন, ফেস রিকগনিশন ও অন্যান্য
২০১০ সালে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি ফেসবুকে। এ সময় ছবির কোয়ালিটি আরও উন্নত করে ৭২০ পিক্সেল উইডথে নিয়ে যাওয়া হয়। সে বছরই প্রথম দুর্বল ইন্টারনেট স্পিডের মোবাইল ফোনের জন্য জিরো ফেসবুক চালু করা হয়। এর আগে স্ট্যাটাসে লাইক দেওয়ার সুযোগ চালু হলেও, এ বছরই প্রথম কমেন্টে লাইক দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
ফেসবুকের অত্যন্ত জনপ্রিয় ফিচার চেকইন এ বছরই প্রথম আসে। এ সময় ফেস রিকগনিশন ফটো ট্যাগিং সুবিধা যুক্ত হয়, যার ফলে ফেসবুক নিজে থেকেই ছবিতে বন্ধুদের চেহারা শনাক্ত করে ট্যাগ করে দিতে পারে।
২০১১: টাইমলাইন
এ বছর ফেসবুক তার ডিজাইনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। টাইমলাইনের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যের চেয়ে তারা কী শেয়ার করছে, কী স্ট্যাটাস দিচ্ছে, সেগুলো প্রকাশের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়। তখন থেকে যেকোনো ব্যবহারকারীর টাইমলাইনে গিয়ে তার সর্বশেষ শেয়ার করা স্ট্যাটাস, ছবি, ভিডিও, লিংক থেকে শুরু করে পেছনের দিকে তার ফেসবুকে রেজিস্ট্রেশনের দিন পর্যন্ত সব পোস্ট দেখার সুযোগ হয়।
এ সময়ই টাইমলাইনে কভার ফটো যুক্ত করার সুযোগ তৈরি হয়। ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি এবং বন্ধুতালিকা বামপাশে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারে স্থান পায়। এ বছর থেকেই ফেসবকু চ্যাটে ভিডিও কলিং সুবিধা চালু হয়। এ বছরই প্রথম সাবস্ক্রাইব (পরবর্তীতে ফলো) অপশন চালু হয়, যার ফলে বন্ধু নয় এমন ব্যক্তিদের পাবলিক পোস্টের আপডেট পাওয়া যায়।
২০১২: স্পনসর্ড স্টোরি
২০১১ সালের টাইমলাইন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে এ বছর ফেসবুকে তেমন কোনো নতুন পরিবর্তন আসেনি। এ সময় ফেসবুক ছবিগুলোর আকার আরো বড় করে। তবে এ সময় থেকেই বিরক্তিকর বিজ্ঞাপন ভিত্তিক স্পনসর্ড স্টোরি ব্যবহারকারীর সামনে হাজির হতে থাকে। আর সে বছরই ৭০০ কোটি মানুষের পৃথিবীতে ফেসবুক ১০০ কোটি ব্যবহারকারীর মাইলফলক অর্জন করে।
২০১৩: ইনস্টাগ্রাম ইফেক্ট
এ বছর ফেসবুক টুইটার সহ অন্যান্য জনপ্রিয় সাইট থেকে কিছু আইডিয়া ধার করে। যেমন- টুইটারের অনুকরণে হ্যাশট্যাগ চালু, অ্যাকাউন্ট ভেরিফাই করা ইত্যাদি। এর আগের বছর ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম কিনে নেয় এবং সম্ভবত ইনস্টাগ্রামের ইন্টারফেস দ্বারা প্রভাবিত হয়েই অল্প কিছুদিনের জন্য টাইমলাইন থেকে অনেক অপ্রয়োজনীয় তথ্য সরিয়ে এবং বড় আকারের ছবিকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন ধরনের ডিজাইনের প্রচলন করে। তবে ফেসবুকের এ পরিবর্তন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
এর আগ পর্যন্ত কারো কমেন্টের প্রতি-উত্তর দিতে হলে পাল্টা কমেন্ট করতে হতো। এ বছর প্রথমবারের মতো ফেসবুক কমেন্টের নিচে রিপ্লাইয়ের সুযোগ চালু করে।
২০১৪: সেভ পোস্ট
এ বছর ফেসবুকে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। ফেসবুক ভিডিওতে ভিউ কাউন্ট চালু করে। ফলে ইউটিউবের পাশাপাশি ভিডিও কন্টেন্ট প্রস্তুতকারকরা ফেসবুকেও ভিডিও পোস্ট করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এ বছর ফেসবুক তাদের অ্যালগরিদমে কিছু পরিবর্তন আনে যেন ক্লিক বেইট আর্টিকেল, যাদের শিরোনাম আকর্ষণীয় কিন্তু ভেতরে সম্পূর্ণ ভিন্ন আর্টিকেল, এরকম লিংকগুলো কম ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে। এ বছরই ফেসবুক ‘সেভ’ সুবিধাটি চালু করে, যার ফলে কোনো পোস্ট পরবর্তীতে পড়া বা দেখার জন্য সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
২০১৫: ইনস্ট্যান্ট আর্টিকেল
এ বছর থেকে ফেসবুক ইনস্ট্যান্ট আর্টিকেল সুবিধা চালু করে। এর ফলে বাছাইকৃত কিছু ওয়েব সাইট, যারা ফেসবুকের এ সুবিধা গ্রহণ করে, তাদের নিউজ আর্টিকেলগুলো মোবাইলে ফেসবুক অ্যাপ থেকে বের না হয়েই পড়া যায়। এ পদ্ধতিতে যেকোনো আর্টিকেল অন্যান্য ওয়েসাইটের তুলনায় ১০ গুণ দ্রুতগতিতে ওপেন হয়।
এ বছর ফেসবুক GIF ফরম্যাটের অ্যানিমেটেড ছবি সাপোর্ট করা শুরু করে। এ বছর থেকেই ফেসবুক 360 ডিগ্রি ভিডিও চালু করে। এছাড়া এ বছরই ফেসবুক নস্টালজিক ‘অন দিস ডে’ ফিচার চালু করে, যেটি এই দিনে ব্যবহারকারী কী কী পোস্ট করেছিল, তা মনে করিয়ে দেয়। এ বছর থেকে প্রতিদিন ১০০ কোটি মানুষ ফেসবুকে বিচরণ করতে থাকে।
২০১৬: রিঅ্যাকশন
দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবহারকারীরা লাইক বাটনের পাশাপাশি একটি আনলাইক বাটন চালুর দাবি করে আসছিল। কিন্তু ফেসবুক আনলাইক চালু না করে ২০১৬ সালে ৬টি রিঅ্যাকশন বাটন চালু করে। এর ফলে ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন ধরনের পোস্টে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করার সুযোগ পায়। এ বছরই ফেসবুক লাইভ ভিডিও ফিচার চালু করে, যার ফলে ব্যবহারকারী সরাসরি ফেসবুকে ভিডিও সম্প্রচার করতে পারে।
ফেসবুকের অভিযোজন এখনও চলমান আছে। ২০১৭ সালেও ফেসবুকে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে এবং বাকি মাসগুলোতেও নিঃসন্দেহে এই ধারা অব্যাহত থাকবে।