ইন্টারনেটকে নানান ধরনের কাজে ব্যবহার করা হলেও শুরু থেকেই আমরা একে পুরো পৃথিবীব্যাপী আন্তঃযোগাযোগের স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে জানি। বিশ্বায়নের মতো বহু পরিচিত বিষয়টিকে আরো সহজভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেও ইন্টারনেটের ভূমিকা বর্ণনা করা হয়। বিভিন্ন বিষয়াদি সম্পর্কে জানার সবচাইতে তথ্যবহুল মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট পুরো পৃথিবীর কাছে জনপ্রিয়। বিভিন্ন দল, মত, সংস্কৃতি, সভ্যতার সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগাযোগ স্থাপনও ইন্টারনেটের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে। তবে মাঝখানে বাধ সাধছে ইন্টারনেটের কল্যাণে এগিয়ে যাওয়া গুগল, ফেসবুকের মতো বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো।
কোম্পানিগুলো নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে তাদের প্রযুক্তিগুলোতে এমন সব অ্যালগরিদম ব্যবহার করছে, যেগুলো দীর্ঘ সময় ধরে আমরা ইন্টারনেটে যা সার্চ করছি, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত যেসব জিনিসের সাথে সংযুক্ত থাকছি, বৈশ্বিক অবস্থান, জেন্ডার, বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়ায় ব্যবহার করা তথ্য সহ নানান জিনিস বিশ্লেষণ করে আমাদের শ্রেণীভুক্ত করে ফেলে এবং সে অনুযায়ী আমাদের জন্য শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু ফিল্টার করা তথ্য সরবরাহ করে। অর্থাৎ, ঐ সকল অ্যালগরিদমগুলো আমাদের আগোচরেই ইন্টারনেটে আমাদের করা কর্মকান্ডের উপর চোখ রাখে এবং পরবর্তীতে আমাদের জন্য কী ধরনের নিউজ বা সার্চ রেজাল্ট ভালো হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। বর্তমানে পুরো ধারণাটি ‘ফিল্টার বাবল’ নামে পরিচিত।
‘ফিল্টার বাবল’ ধারণাটি সবার নজরে আনে আমেরিকান অনলাইন এক্টিভিস্ট ‘এলি প্যারিসার’। তিনি ২০১১ সালে টেড টকসে সর্বপ্রথম এটি নিয়ে আলোচনা করেন এবং একই বছরে ‘দ্য ফিল্টার বাবল: হ্যোয়াট দ্য ইন্টারনেট ইজ হাইডিং ফ্রম ইউ’ নামে একটি বই বের করেন।
ফিল্টার বাবল ধারণাটিকে আরো সহজভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে এলি প্যারিসার একটি পরীক্ষার ফলাফল বর্ণনা করেন, যেখানে তিনি তার কিছু বন্ধুকে ‘Egypt’ কি-ওয়ার্ডটি দিয়ে গুগল করে ফলাফলগুলোর স্ক্রিনশট পাঠাতে বলেন। তিনি স্কট এবং ডেনিয়েলস নামের দুজন বন্ধুর স্ক্রিনশটের মাঝে পার্থক্য করে দেখান যে, স্কটের সার্চ রেজাল্টে সেই সময়কার ইজিপ্টের রাজনৈতিক সঙ্কট, প্রটেস্ট, সাউথ আফ্রিকান জার্নালিস্ট ‘লারা লোগান’ নিয়ে তথ্য এসেছে। অপরদিকে ডেনিয়েলসের সার্চ রেজাল্টে ইজিপ্টে ট্রাভেল, ইজিপ্টের ডেইলি নিউজ আর সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির ফ্যাক্টবুক শিরোনামে নিয়ে তথ্য এসেছে, যেগুলো আশ্চর্যজনকভাবে একে অপরের বিপরীত।
এ থেকে অনেকাংশেই ধারণা পাওয়া যায় যে, অ্যালগরিদমগুলো প্রত্যেককে কীভাবে আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করে প্রত্যেকের জন্য নিজেদের ইচ্ছেমতো সার্চ রেজাল্ট উপস্থাপন করছে। ফিল্টার বাবল সম্পর্কে আরো সুস্পষ্টভাবে ধারণা প্রদানের জন্য এলি প্যারিসার বলেন,
“Your filter bubble is your own personal, unique universe of information that you live in online. What’s in your filter bubble depends on who you are, and it depends on what you do. But you don’t decide what gets in – and more importantly, you don’t see what gets edited out.”
বর্তমান পৃথিবীতে আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল। এমনকি নির্বাচনের সময় কোন প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবো, সে ব্যাপারে ধারণা তৈরির জন্যও আমরা ইন্টারনেটে খোঁজ করি। এমনকি, ‘কোন প্রার্থীকে কেন ভোট দেওয়া উচিত নয়’ সে ব্যাপারে ধারণা পেতেও আমরা ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হই। ইন্টারনেট থেকে প্রচুর পরিমাণে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণা করার পর সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে তেমন বেগ পেতে হয় না। কিন্তু সত্যিই কি আমরা সঠিক সিদ্ধান্তটি নিয়েছি?
ধরুন, আপনি একজন ডেমোক্র্যাট। আপনার পূর্ববর্তী সার্চ হিস্টোরি, অনলাইনে খোঁজাখুঁজি, সোশ্যাল মিডিয়ায় উল্লেখিত পলিটিকাল স্ট্যাটাস, বিভিন্ন ফোরামে নিজের দল সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা নিয়ে কথা বলার দরুন খুব সহজেই আপনার সম্পর্কে সবসময় ব্যবহার করা সার্চ ইঞ্জিনটির অ্যালগরিদমগুলো পর্যাপ্ত ধারণা তৈরি করে নিলো। অর্থাৎ, আপনাকে অ্যালগরিদমগুলো একজন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করে ফেললো। এখন যদি ঐ সার্চ ইঞ্জিনের ব্যবস্থাপকেরা রিপাবলিকানদের সমর্থন করে বা তাদের প্রচার মাধ্যম হিসেবে বেতনভুক্ত হয়, তাহলে কী হবে ভাবুন একবার! আপনাকে সার্চ ইঞ্জিন কর্তৃপক্ষ এমন এক বাবলের আওতায় নিয়ে আসবে, যেখানে ডেমোক্র্যাট নিয়ে নেতিবাচক সার্চ রেজাল্ট আসবে। এর ফলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর হয়তো আপনি আপনার ভোট অন্য কোনো দল বা রিপাবলিকানদের দেওয়ার ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। পুরো ব্যাপারটি শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও অনেক গবেষকদের মতে, ২০১৬ সালে আমেরিকার নির্বাচনে ঠিক এটিই ঘটেছে।
ইন্টারনেটের কল্যাণে যেখানে আমাদের পুরো পৃথিবীর সকল কিছুর সাথে সংযুক্ত থাকার কথা, সেখানে ফিল্টার বাবল আমাদের একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলছে। যাকে এলি প্যারিসার ‘পার্সোনাল ইকো-সিস্টেম অফ ইনফরমেশন’ হিসেবে উল্লেখ্য করেছেন। এই ইকো-সিস্টেমে আপনি শুধুমাত্র আপনার পছন্দের জিনিসগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবেন। যেমন, দিন দিন সংবাদ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের ব্যবহার বেড়েই চলছে। এখন যদি আপনি শুধুমাত্র বিনোদনের সংবাদ দেখে, লাইক দিয়ে, শেয়ার করে সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা সময়গুলো অতিবাহিত করতে থাকেন, তাহলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর আপনার নিউজ ফিডে শুধুমাত্র বিনোদনের খবরই আসতে থাকবে। যার ফলে চলমান বিশ্বের সাথে আপনার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অপ্রয়োজনীয় জিনিসের ভিড়ে আপনি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হারিয়ে ফেলবেন।
বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও ইয়াহু নিউজ, হাফিংটন পোস্ট, ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস সহ আরো জনপ্রিয় নিউজ পোর্টালগুলোও ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভর করে সংবাদ প্রদান করে থাকে।
একটা সময় ছিল যখন ওপরওয়ালাদের নির্দেশে পত্রিকায় প্রকাশের জন্য সংবাদ বাছাই করা হতো। ক্ষমতাসীনদের নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ, প্রবন্ধগুলোকে প্রকাশ করা হতো না। যার ফলে প্রয়োজনীয় অসংখ্য সংবাদ, প্রবন্ধ সাধারণ মানুষের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যেতো। অনলাইন ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর কল্যাণে অনেকাংশে এই সমস্যার লাঘব হলেও, আমরা বর্তমানে নিজেদের পছন্দ, অপছন্দের মাঝে আটকে গেছি। অ্যালগরিদমগুলো অতিরিক্ত সময় নিয়ে পড়া, শেয়ার করা সংবাদ, প্রবন্ধগুলোতে উল্লেখিত বিষয়াদিই আমাদের প্রদান করে থাকে।
“If you are not paying for it, you’re not the customer; you’re the product being sold.” – Andrew Lewis
আমরা প্রত্যেকদিন নিজেদের অজান্তেই নানান ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য ইন্টারনেটে শেয়ার করছি। আমাদের প্রত্যেকটি ক্লিক আমাদের ব্যাপারে নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহে বিভিন্ন কোম্পানিকে সাহায্য করে। বিশেষ করে গুগল, ফেসবুক সহ এ ধরনের কোম্পানিগুলো যেহেতু অনেকাংশেই বিজ্ঞাপন ব্যবসা থেকে মুনাফা অর্জন করে থাকে, সেহেতু ধরেই নেয়া যায় আমাদের তথ্যগুলো তাদের কাছে সুরক্ষিত থাকে না। আমাদের পছন্দ, অপছন্দ, সাম্প্রতিক খোঁজ করা কোনো নির্দিষ্ট পণ্য সহ বিভিন্ন জিনিস ফিল্টার করে আমাদের আমাদের একটি নির্দিষ্ট ধরনের পণ্যের ভোক্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং সেই তথ্য সংশ্লিষ্ট কোনো কোম্পানির কাছে বিক্রয় করে দেওয়া হয়। আর এভাবেই ফেসবুক, গুগল, টুইটারের বিভিন্ন সেবার বিনিময়ে আমরা নিজেদের তথ্য দিচ্ছি। আর তারা সেগুলো বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করছে। অর্থাৎ, আমাদের সুকৌশলে পণ্য হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। পুরো ব্যাপারটি তেমন সুখকর নয়!
তথ্য ফিল্টারিংয়ে ব্যবহৃত অ্যালগরিদমগুলো পুরোপুরি এড়িয়ে চলতে না পারলেও কিছু সতর্কতার মাধ্যমে অনেকাংশেই রক্ষা পেতে পারি। ব্যক্তিগত বিশ্বাস, দল, মত বা স্পর্শকাতর বিষয়াদি নিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে গবেষণার প্রয়োজন হলে এমন কিছু সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করতে পারি, যেগুলো ব্যবহারকারীদের প্রাইভেসি সংরক্ষণ করার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যেমন: DuckDuckGo, WolframAlpha, Startpage। তাছাড়া, বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্রাউজিং এর সময় ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টগুলো থেকে বের হয়ে থাকা উত্তম। সব সময় ব্রাউজার কুকিজ যেন মুছে ফেলা হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত। এছাড়াও, সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউবে যেন শুধুমাত্র বিনোদনের কন্টেন্টগুলোতেই পড়ে না থাকি। সর্বোপরি, অনলাইন ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যমগুলোকে অনুসরণ করার পূর্বে আমরা যেন নিশ্চিত হয়ে নিই যে, সংবাদ মাধ্যমটি সব ধরনের সংবাদ পরিবেশন করে। এর মাধ্যমে যেমন নিজেদের ইন্টারনেট ভিত্তিক স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারবো, তেমনি নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্যের ইকো-সিস্টেম থেকে বের হয়ে পুরো পৃথিবীর ব্যাপারে সব সময় ওয়াকিবহাল থাকতে পারবো।
ফিচার ছবি- found.co.uk