প্রযুক্তির বদৌলতে বৃহৎ এই পৃথিবী খুব সহজে ছোট হয়ে গেছে আর সেটির জায়গা হয়েছে আধুনিক পৃথিবীর মানুষের হাতের মুঠোয়। যা কয়েক দশক আগেও ছিলো মানুষের কল্পনার বাইরে, যা করা ছিলো মানুষের কাছে খুবই দুরূহ সেসব কাজ এখন মানুষ ঘরে বসে খুব সহজে করে ফেলতে পারে। সময় ও শক্তির অপচয়ও হয় অনেক কম।
সায়েন্স ফিকশন সিনেমা দেখে যারা অভ্যস্ত, তারা এসব সিনেমাতে সাধারণত প্রযুক্তির অভিনব সব ব্যবহার দেখে থাকেন। যদিও সেসব মোটেও সত্য জিনিস নয়। হয়তো গল্পের নায়কের একটি ঘড়ি আছে, যা মুহূর্তের মধ্যে একটি ছোটখাট অস্ত্রে পরিণত হতে পারে। কিংবা কোনো গাড়ি হঠাৎ পরিণত হতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোনো রোবটে। যেমনটা আমরা দেখে থাকি ট্রান্সফর্মার মুভিতে কিংবা আয়রন ম্যান, অ্যাভেঞ্জার্স মুভি সিরিজে।
মজার ব্যাপার হলো, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের এতটাই সমৃদ্ধ করেছে এবং এখনো করছে যে পূর্বে যা ছিলো আমাদের কল্পনার বস্তু অর্থাৎ ফিকশন, সেসব এখন বাস্তবে আমাদের হাতে এসে ধরা দিয়েছে। তৈরী হয়েছে বৃহৎ বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান যারা প্রতিনিয়ত গবেষণা ও কাজের দ্বারা তৈরি করে যাচ্ছে নানা ধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। তেমনই এক প্রজেক্টের নাম প্রজেক্ট জ্যাকার্ড। কল্পনা করুন তো কেমন হয় যদি আপনার পোশাকে এমন সব প্রযুক্তি জুড়ে দেওয়া হলো, যার সাহায্যে আপনি আপনার কাজগুলো আরো একটু গুছিয়ে নিতে পারলেন? সে গল্পের দিকেই আমরা যাবো এখন।
প্রযুক্তি জগতে জায়ান্ট গুগলের নাম শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজতে যাওয়া বোকামি। একের পর এক বিভিন্ন প্রযুক্তির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান। তো গুগল এবার পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি বা খুব সহজে বলতে গেলে যেসব প্রযুক্তি আমরা আমাদের পরিধেয় পোশাকের সাথে ব্যবহার করতে পারি সেসব প্রযুক্তি নিয়েই কাজ শুরু করেছে। সাথে আছে টেক্সটাইল মার্কেটিং এর আরেক শক্তি লিভাই’স। দুই দলের সমন্বিত প্রচেষ্টার নামই হচ্ছে প্রজেক্ট জ্যাকার্ড। আসুন সেই সম্পর্কে জানা যাক।
প্রথমত প্রশ্ন আসে যে ‘জ্যাকার্ড’ নাম কেন এলো? জ্যাকার্ড মূলত একপ্রকার উন্নত তাঁতযন্ত্র, যেখানে অন্যান্য তাঁতযন্ত্রের থেকে সুযোগ সুবিধাটা একটু বেশি পাওয়া যায়। অন্যান্য তাঁতযন্ত্রের মধ্যে ফেব্রিকের ডিজাইনের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা পাওয়া যায় এবং সবসময় চাহিদামতো ডিজাইন তৈরি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু জ্যাকার্ডের ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই বললেও চলে। কারণ এই যন্ত্রে প্রতিটি সুতার জন্য আছে আলাদা করে ডিজাইন করার ব্যবস্থা। বুঝতেই পারছেন, যেখানে প্রতিটি সুতাকেই আলাদা করে ডিজাইনে আনা যায়, সেখানে প্রযুক্তির যোগসাধন করা সহজই হয়ে যাবে। মূলত জ্যাকার্ড মেশিনে নতুন এই ওয়্যারেবল টেকনোলজি বুননের কাজ করা হয় বিধায় এই প্রজেক্টের নাম হয়েছে প্রজেক্ট জ্যাকার্ড।
গ্লোবাল ডিজাইন এন্ড স্ট্রাটেজি ফার্ম ফ্রগ-এর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ভবিষ্যদ্বাণী ছিলো যে ২০১৫ সাল নাগাদ টেক্সটাইল বা বস্ত্রকৌশলে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হবে সর্বতভাবে এবং যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনকে প্রভাবিত করবে অনেকখানি। হয়তো ফ্রগ এই প্রজেক্ট জ্যাকার্ড-এরই প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলো। আর সেই স্বপ্নই এখন দেখছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুগল। তারা চাচ্ছে পরিধানযোগ্য পোশাকে প্রযুক্তির সংযোগ করে বস্ত্রকৌশলকে এক ভিন্ন মাত্রা প্রদান করতে।
প্রজেক্ট জ্যাকার্ড মূলত গুগলের একজন পুরষ্কারপ্রাপ্ত ডিজাইনার এবং বিজ্ঞানী ইভান পপিরেভ এর নেতৃত্বে পরিচালনা করা হচ্ছে। ইভান হচ্ছেন গুগলের অ্যাডভান্স টেকনোলজি এন্ড প্রজেক্ট (এটিএপি) এর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং প্রজেক্ট জ্যাকার্ড-এর প্রতিষ্ঠাতা। গুগল এটিএপি-এর মতে, প্রজেক্ট জ্যাকার্ড বস্ত্রকৌশলে এক ভিন্নমাত্রা যোগ করবে, যেখানে বস্ত্রবয়নের ক্ষেত্রে নতুন ধরনের পরিবাহী ব্রেইডেড সুতার ব্যবহার করা হবে। সহজ করে বলতে গেলে, যখন ফেব্রিক বুনন করা হবে তাঁতযন্ত্রে, তখন সেখানে সাধারণ সুতার সাথে সাথে পরিবাহী সুতাও ব্যবহার করা হবে। তবে সাধারণ পরিবাহী সুতা, যেমন হতে পারে হ্যান্ড গ্লাভসের টাচস্ক্রিন পরিচালনায় ব্যবহৃত সুতার সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে এই ধরনের সুতা যেকোনো রঙের হতে পারে। ফলে তা সহজে যেকোনো পোশাক বুননের সময় ব্যবহার করা যাবে। সেই সাথে তাঁতযন্ত্রে বুননের ক্ষেত্রেও সেটি কোনো সমস্যার সৃষ্টি করবে না।
কিন্তু এখানেও কিছু সমস্যা থেকেই যায়। যেমন পরিসংখ্যানে জানা যায়, প্রতি বছর টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি থেকে প্রায় ১৯ বিলিয়নের মতো গার্মেন্ট প্রস্তুত করা হয়, অথচ সেই তুলনায় স্মার্ট ফোন তৈরী হয় অনেক কম। কাজেই বৃহৎ পরিসরে এরকম স্মার্ট পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা থেকেই যায়। কারণ সাধারণ পোশাকের মতই এই পোশাক তৈরি করা হবে তাঁতযন্ত্রে এবং সাধারণ পোশাকের মতোই হতে হবে এর বিপণন ও ব্যবহার। আবার তাঁতযন্ত্রে বুননের সময় সেখানকার চাপ ও আঘাতে কন্ডাকটিভ থ্রেডের কোনো সমস্যা হবে কিনা, সেদিকেও রাখতে হবে বিশেষ খেয়াল।
তো ভাবুন একবার যদি এই স্মার্ট পোশাকের কোনো একটি পকেটে ছোট ব্লুটুথ ডিভাইস রেখে দেওয়া হয়, যা কিনা সাধারণ ঘড়ির ব্যাটারি দিয়ে চলে এবং আপনার পোশাকের মধ্যে আছে ইলেক্ট্রো কন্ডাক্টিভ থ্রেড বা পরিবাহী সুতা, তখন এটি কাজ করবে অনেকটা টাচস্ক্রিনের মতো এবং এর সাহায্যে পরিচালনা করা যাবে আরো অনেকে গেজেটের, যা আপনার স্মার্ট ফোনেই ইনস্টল করা আছে। অর্থাৎ আপনি আপনার ওই পরিহিত পোশাকের কন্ডাক্টিভ অংশে স্পর্শ করে আপনার স্মার্ট ফোন চালাতে পারবেন অনায়াসে।
কিংবা যদি এমন হয় যে, আপনার বিশেষ ওই জিন্সের জ্যাকেটের সাহায্যে আপনি অদৃশ্যভাবে আপনার ফোনের মিডিয়া প্লেব্যাক কিংবা ইনকামিং কলের সময়ে সাইলেন্স মুড নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আবার আপনার বাড়ির সামনে লাগানো বাতিটি নিয়ন্ত্রণ করতে কিংবা কাছের বন্ধুদের সাধারণ কোনো মেসেজ পাঠাতে পারেন, তাহলে ব্যাপারটা কিন্তু একইসাথে অনেক চমকপ্রদ হবে এবং আপনার সময়ও সাশ্রয় হবে। কিন্তু ব্যাপারটা যতটা না চমকপ্রদ, ততটাই জটিল।
তবে সেটি এখন আর আমাদের কল্পনাতেই অবস্থান করছে না, কারণ এরই মধ্যে বিশিষ্ট ডেনিম বা জিনসের পোশাক প্রস্তুতকারক লিভাই’স এই ধরনেরই পোশাক তৈরি করেছে। এটি মূলত ডেনিমের তৈরী জ্যাকেট, যা বাইক রাইডারদের জন্য ডিজাইন করা। কারণ আপনি যখন বাইক চালাবেন, তখন যদি আপনার ফোনে কল আসে কিংবা কোনো মেসেজ আসে, তবে সেটার উত্তর দেবার জন্য অবশ্যই আপনাকে থামতে হবে আগে। কিন্তু যদি এই স্মার্ট জ্যাকেট থাকে আপনার গায়ে, তাহলে আপনি বাইকে থাকা অবস্থাতেই আপনার ফোন কল রিসিভ করতে পারবেন কিংবা মেসেজে জানিয়ে দিতে পারবেন যে আপনি এখন বাইকের উপর আছেন এবং এখন কল রিসিভ করা সম্ভব না। তবে সাধারণ মানুষের জন্যেও এটি সমানভাবে কার্যকর। জ্যাকেটটিকে বলা কম্যুটার ট্র্যাকার জ্যাকেট।
তো কীভাবে এই স্মার্ট জ্যাকেট তৈরি করা হলো চলুন জানা যাক।
প্রথমত, প্রথমদিকে গুগল যখন জ্যাকেটের সাথে টাচ সেন্সিটিভ অংশে কন্ডাকটিভ থ্রেড বা পরিবাহী সুতার সংযোগ করলো, তখন সেটি সাদা বর্ণের সুতা দিয়ে তৈরি করা হয়। কারণ গুগল ভেবেছিলো যে সাদা রঙের কারণে সেটি ব্যবহারকারীর দেখার জন্য সুবিধা হবে। কিন্তু লিভাই’স এক্ষেত্রে বাধ সাধলে পরে গুগল তখন কন্ডাকটিভ থ্রেডগুলো জ্যাকেটের সুতার সাথে মিশিয়ে দিলো, কিন্তু এক বিশেষ ধরনের বয়নকৌশলের মাধ্যমে। বস্ত্রকৌশলের ভাষায় একে বলা হয় ‘Missed Pick’ ডিজাইন, যার কারণে ফেব্রিকে কিছুটা অসমান পৃষ্ঠ তৈরী হয়। এর ফলে আর ব্যবহারকারীর জন্য কোনো সমস্যা রইলো না, কারণ এখন সে এই অসমান জায়গাটি খুব সহজে স্পর্শ করে অথচ না দেখেই খুঁজে পাবে।
এরপরে দ্বিতীয় যে চ্যালেঞ্জটি আসে সেটি হচ্ছে, জ্যাকেটের ঠিক কোন অংশে এই সেন্সিটিভ টাচপ্যাড বুনন করা হবে। ডিজাইনার টিম অনেক ভেবেচিন্তে জ্যাকেটের স্লিভকে বেছে নিলো। কারণ একদিকে এটি বাইক রাইডারদের জন্য খুঁজে পেতে যেমন সহজ, তেমনই অন্যদিকে কোনো কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে এই অংশে ক্ষতি না হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।
তৃতীয় চ্যালেঞ্জটি ছিলো সংযোগ সাধন। অর্থাৎ ব্লুটুথ ডিভাইসের সাথে মোবাইল অ্যাপের মধ্যে যোগাযোগ ঘটানো। এর জন্য জ্যাকেটে স্থাপন করতে হবে একটি ছোটখাটো মাইক্রোপ্রসেসর। এই উদ্দেশ্যে গুগল এবং লিভাই’স উভয়ে যৌথ উদ্যোগে ডিজাইন করলো বিশেষ একধরনের স্ন্যাপ বাটন, যা একইসাথে মাইক্রোপ্রসেসর ও রিচার্জেবল ব্যাটারি ধারণ করে। ফলে এটি ইচ্ছামতো জ্যাকেটে লাগানো যায় এবং প্রয়োজনে খুলে রেখে দেয়া যায়।
এখন সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই জ্যাকেটের মার্কেটিং প্ল্যান কেমন হবে। কারণ এটি তৈরি করা যেমন কঠিন কাজ, ঠিক তেমনি এর বিক্রয়মূল্যও সাধারণ ডেনিমের জ্যাকেটের থেকে দুই-তিন গুণ বেশি হতে পারে। পরীক্ষামূলকভাবে লিভাই’স এই জ্যাকেট বাজারে ছেড়েছে। যারা বাইক রাইডিং করে, তাদের সুবিধা দেওয়াই এর উদ্দেশ্য। ফলে বাইক রাইডারগণ এই জ্যাকেটের উপর কেমন চাহিদা পোষণ করেন, সেটি অবশ্যই একটি চিন্তার বিষয়।
যদিও ইতোমধ্যে এটুকু আমরা জেনেছি যে এই বিশেষ স্মার্ট জ্যাকেটের সাহায্যে আমরা খুব সহজে মোবাইল অ্যাপকে কন্ট্রোল করতে পারি এবং এর সাহায্যে কল রিসিভ করা কিংবা মিউজিক প্লেব্যাক নিয়ন্ত্রণ সহ লোকেশন ট্র্যাকিং কিংবা মেসেজিং করাও খুব সহজে করা সম্ভব।
এখন দেখা যাক কীভাবে এই জ্যাকেট কাজ করে।
জ্যাকেটের স্লিভে যখন বিশেষ ধরনের সেই মিসড পিক ডিজাইনের মাধ্যমে কন্ডাকটিভ থ্রেড বুনন করা হয়, তখন সেই অংশটি মূলত একটি টাচপ্যাডের মতো কাজ করে। অর্থাৎ সেখানে স্পর্শ করার মাধ্যমেই আমরা স্মার্টফোনের অ্যাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তো এই টাচপ্যাড অংশে আমরা যখন স্পর্শ করবো, তখন সেই সিগন্যাল সরাসরি কন্ডাকটিভ থ্রেডের মাধ্যমে পৌঁছে যাবে মাইক্রোপ্রসেসরে। এই টাচপ্যাড কাজ করে অনেকটা স্মার্ট ফোনে ব্যবহৃত ক্যাপাসিটিভ টাচপ্যাডের মতোই। মাইক্রোপ্রসেসরে প্রয়োজনমত এই সিগন্যাল প্রক্রিয়াকৃত হয়ে ব্লুটুথ ডিভাইসের সাহায্যে এর সাথে ব্লুটুথ কানেকশনে সংযুক্ত স্মার্ট ফোনে সিগন্যাল প্রেরণ করবে। আর এই প্রেরিত সিগন্যালের দ্বারাই নিয়ন্ত্রণ করা হয় ফোনের প্রয়োজনীয় অ্যাপ ও এদের বিভিন্ন কাজ।
প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের কথা যদি বলতে হয় তো একথা অনস্বীকার্য যে পরিধানযোগ্য পোশাকে যখন প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়, তখন তা নিঃসন্দেহে অন্যমাত্রার সৃষ্টি করে। আর এই কাজটাই করতে চেয়েছে সফটওয়্যার জায়ান্ট গুগল আর অন্যতম টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠান লিভাই’স। যদিও কিছু প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে এখনো পূর্ণমাত্রায় মার্কেটিং করা সম্ভব হচ্ছে না এই পণ্যের। পরীক্ষামূলকভাবে কিছু জ্যাকেট বাজারে ছাড়া হয়েছিলো যেখানে এর সফটওয়্যারের বেটা ভার্সন ইনস্টল করা হয়েছিলো। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এই প্রযুক্তির পূর্ণ বাজারজাতকরণের জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করা লাগবে না।
ফিচার ইমেজ: aroundjournal.com