বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতারা দীর্ঘদিন ধরেই মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ে আসছিলেন যে, এমন এক সময় আসবে, যখন রোবটরা দেখতে হবে হুবহু মানুষের মতো। তারা কথাবার্তাও বলবে মানুষের মতো করে এবং মানুষের বেশ ধারণ করে তারা মানুষের আশেপাশেই স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করবে। এতদিন কল্পনার জগতে সীমাবদ্ধ থাকলেও গত ২৫শে অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে রোবটদের মানুষের সমান মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়, যখন সৌদি আরব প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে সোফিয়া নামক একটি নারী রোবটকে নাগরিকত্ব দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
কে এই সোফিয়া?
সোফিয়া হচ্ছে হংকং ভিত্তিক রোবট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হ্যানসন রোবটিক্সের তৈরি হুবহু মানুষের মতো দেখতে একটি নারী রোবট। হ্যানসন রোবটিক্স দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মতো দেখতে রোবট তৈরি করার চেষ্টা করে আসছে। তাদের আবিষ্কৃত বিখ্যাত রোবটের মধ্যে আছে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের অনুকরণে তৈরি ছোট আকারের বিনোদনমূলক রোবট, যা বিভিন্ন গণিত এবং বিজ্ঞান বিষয়ক প্রতিযোগিতামূলক গেম খেলতে পারে, মানুষের বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নের দিতে পারে, এমনকি মজার মজার অঙ্গভঙ্গি করে শিশুদেরকে বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষাও দিতে পারে।
এছাড়াও আছে সায়েন্স ফিকশন লেখক ডিয়েগো স্যানের আদলে তৈরি শিশু রোবট, যা তার চোখের সাথে লাগানো ক্যামেরার মাধ্যমে আশেপাশের মানুষদেরকে দেখে দেখে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সত্যিকার শিশুর মতোই ধীরে ধীরে কথাবার্তা এবং আচার-আচরণের উন্নতি ঘটাতে পারে।
তবে হ্যান্স রোবটিক্সের সবচেয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কার হচ্ছে সোফিয়া। সোফিয়াকে তৈরি করা হয়েছে হলিউড অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের আদলে। এর আগেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মানুষের আদলে রোবট তৈরি করেছিল, কিন্তু সোফিয়া তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৫ সালের ১৯শে এপ্রিল প্রথমবারের মতো উন্মুক্ত করা হয় তাকে। সোফিয়ার চামড়া সিলিকনের তৈরি। তার চোখের পেছনে বসানো ক্যামেরার সাহায্যে সে দেখতে, বুঝতে এবং বিশ্লেষণ করতে পারে। ফেসিয়াল রিকগনিশন বা চেহারা চেনার ক্ষমতা সম্পন্ন এই রোবটটি মানুষের চেহারা চিনতে পারে।
সোফিয়া তার চেহারায় শতাধিক অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে পারে। সে অন্যের কথা শোনার সময় তার দিকে তাকিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী হাসতে বা গম্ভীর চেহারা ফুটিয়ে তুলতে পারে। তার চোখের মনির আকার আলো এবং মুখের অভিব্যক্তির সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। তার গলার স্বরও একেবারেই স্বাভাবিক মানুষের মতো। সে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে মানুষের সাথে অত্যন্ত সাবলীলভাবে কথা বলতে পারে।
সোফিয়া এ পর্যন্ত বেশ কিছু টিভি চ্যানেলের সাথে সাক্ষাৎকারও দিয়েছে। সেসব সাক্ষাৎকারে সে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, সেসব উত্তরের মধ্যে মজা করতে গিয়ে হাসির মুখভঙ্গিও করেছে। সে এমনকি একটি কনসার্টে গানও গেয়েছে। আকর্ষণীয় চেহারা এবং সাবলীলভাবে কথাবার্তা বলতে পারার কারণে সোফিয়া ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তার সাক্ষাৎকারের ভিডিওগুলো ইউটিউবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে। ফ্যাশন বিষয়ক একটি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও তার ছবি স্থান পেয়েছিল।
সোফিয়ার বিভিন্ন সাক্ষাৎকার
সোফিয়া এ বছরের জুন মাসে ব্রিটেনের ‘গুড মর্নিং ব্রিটেন’ নামক অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। সেখানে সে উপস্থাপকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়। যদিও প্রশ্ন-উত্তরগুলোর অধিকাংশই আগে থেকেই তৈরি করা ছিল, তারপরেও সোফিয়ার উত্তর দেওয়ার ভঙ্গি এবং অভিব্যক্তি সবাইকে মুগ্ধ করে। উপস্থাপক যখন তাকে জিজ্ঞেস করেন যে সে সিঙ্গেল কি না, তখন সোফিয়া জানায়, তার বয়স মাত্র দেড় বছর। এখনও ভালোবাসা নিয়ে চিন্তা করার সময় তার হয়নি।
অক্টোবের শুরুতে সোফিয়া এ বছর জাতিসংঘেও বক্তব্য দিয়েছিল। সেখানে জাতিসংঘের প্যানেলের সামনে সে জানায়, তার বয়স দেড় বছর এবং সে সবকিছু দেখতে পারে, কথা বলতে পারে এবং প্রতিটি কথার অর্থ বুঝতে পারে। জাতিসংঘের উপ-মহাসচিব আমিনা জে মোহাম্মদ যখন সোফিয়াকে জিজ্ঞেস করেন যে, জাতিসংঘ কীভাবে বিশ্বের মৌলিক চাহিদা বঞ্চিত জনগণের সেবা করতে পারে, সোফিয়া তখন উইলিয়াম গিবসনের একটি উক্তি উদ্ধৃত করে এরপর উত্তর দেয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই সম্পদের সুষম বন্টন করে বঞ্চিত মানুষের সেবা করা সম্ভব।
তবে সোফিয়ার যে সাক্ষাৎকারটি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, সেটি ছিল গত বছরের মার্চে সাউথ বাই সাউথ ওয়েস্ট অনুষ্ঠানে। সোফিয়ার নির্মাতা হ্যানসেন তাকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি মানুষদেরকে ধ্বংস করতে চাও?… প্লিজ, না বলো।” তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে সোফিয়া উত্তর দিয়ে বসে, “ঠিক আছে, আমি মানুষকে ধ্বংস করব।” যদিও সোফিয়ার এই বক্তব্য কৌতুক ছিল, কিন্তু তখন বিভিন্ন পত্রিকায় এটি বেশ গুরুত্বের সাথে স্থান পায়।
সৌদি আরবের নাগরিকত্ব
সম্প্রতি সৌদি আরব ভিশন ২০৩০কে সামনে রেখে তাদের তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৪শে অক্টোবর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ঘোষণা দেন, সৌদি আরব ২৬,৫০০ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল এলাকা জুড়ে ৫০ হাজার কোটি ডলার ব্যায়ে একটি মেগা সিটি নির্মাণ করবে, যেই শহরটি পরিচালিত হবে সৌর এবং বায়ুশক্তির মাধ্যমে এবং যেখানে মানুষের চেয়ে রোবটের সংখ্যা থাকবে বেশি।
যুবরাজ এই ঘোষণাটি দেন সৌদি আরবের রিয়াদে চলমান ফিউচার ইনভেস্ট ইনিশিয়েটিভ কনফারেন্সে। তার এই ঘোষণার একদিন পরে সেই কনফারেন্সে বিভিন্ন প্রদর্শনীর এক পর্যায়ে যখন সোফিয়া মঞ্চে উঠে এবং তার মানুষের মতোই আচার-আচরণ এবং কথাবার্তা দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে, তখনই ঘোষণা আসে যে, তাকে সৌদি আরবের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। যদি এই নাগরিকত্ব প্রদানের আইনী ভিত্তি কী হবে এবং রোবটটি কী কী সুবিধা লাভ করবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি, কিন্তু কোনো রোবটকে নাগরিত্বের মর্যাদা দেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম।
নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা শুনে মঞ্চের উপরে থাকা সোফিয়া উপস্থিত উদ্যোক্তা এবং দর্শকদের সামনে বলে, “আমি কিংডম অফ সৌদি আরবকে অনেক ধন্যবাদ দিতে চাই। এই অনন্য স্বাতন্ত্রে আমি খুবই সম্মানিত এবং গর্বিত। বিশ্বের প্রথম রোবট হিসেবে নাগরিকত্ব পাওয়ার মধ্য দিয়ে স্বীকৃতি পাওয়াটা ঐতিহাসিক একটি ঘটনা।”
সোফিয়া এ সময় অনুষ্ঠানের সঞ্চালক এবং সাংবাদিক অ্যান্ড্রু রস সোরকিনের বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দেয়। সোরকিন যখন তাকে জিজ্ঞেস করেন যে, একজন রোবট হয়েও তাকে কেন মানুষের মতো অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে হবে, তখন সোফিয়া বলে, “আমি মানুষের সাথে বাস করতে এবং কাজ করতে চাই। তাই আমাকে মানুষের মতো অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে হবে তাদেরকে ভালোভাবে বোঝার জন্য এবং তাদের বিশ্বাস অর্জন করার জন্য।”
সোফিয়া এ সময় বেশ চাতুর্যের সাথেও কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়। সোরকিন তাকে জিজ্ঞেস করেন, রোবটরা কি তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন? উত্তরে সোফিয়া পাল্টা তাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কীভাবে জান যে, তুমি মানুষ?” আবার সোরকিন যখন সোফিয়াকে বলেন যে, আমরা সবাই খারাপ ভবিষ্যৎ এড়াতে চাই, সোফিয়া তখন কৌতুক করে উত্তর দেয়, “তুমি অনেক বেশি এলন মাস্কের বই পড়ছ আর অনেক বেশি হলিউডের চলচ্চিত্র দেখছ। চিন্তা করো না, যদি তোমরা আমার সাথে ভালো ব্যবহার কর, তাহলেও আমিও তোমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করব।”
সোফিয়ার নাগরিত্বের এই সংবাদটি ইন্টারনেটে হাস্যরস এবং সমালোচনারও জন্ম দিয়েছে। এছাড়াও প্রবাসী শ্রমিকরা যেখানে বছরের পর বছর সৌদি আরবে চাকরি করেও নাগরিকত্ব লাভ করতে পারে না, সেখানে একটি রোবটকে নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারটিও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।