যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (FBI) এর নাম অনেকেই শুনেছেন। শুরুতে কাগজে-কলমে তাদের কাজের ক্ষেত্র যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে তারা সারাবিশ্বেই অন্যান্য দেশের পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সাথে হাত মিলিয়ে অপরাধী পাকড়াও করতে ভূমিকা রাখছে। গত ৮ জুন এফবিআই এর নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী পরিচালিত একটি স্টিং অপারেশনে একযোগে ১৬টি দেশের ৮০০ অপরাধী পুলিশের হাতে ধরা পড়ে! আরো কয়েক হাজার অপরাধীর ধরা পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
রোর বাংলার পাঠকদের জন্য আজকে তুলে ধরা হবে সম্প্রতি বহুল আলোচিত ‘অপারেশন ট্রোজান শিল্ড’ এর বিস্তারিত ঘটনা।
স্টিং অপারেশন
মনে করুন, একজন লোক মাদকদ্রব্য বিক্রি করে। পুলিশ বিষয়টি জানে, কিন্তু তথ্য-প্রমাণের অভাবে তাকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই মাদকের ক্রেতা সেজে তাকে সুযোগ বুঝে হাতেনাতে গ্রেফতার করে। এভাবে ফাঁদ পেতে অপরাধী ধরার কাজ বিশ্বের সব দেশেই হয়ে থাকে।
এফবিআই-এর কাজের ধরন একটু ভিন্ন। তারা সম্ভাব্য অপরাধীকেও (যে এখনও অপরাধ করেনি কিন্তু করতে আগ্রহী) ফাঁদে ফেলে প্রমাণসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করে। যেমন- কয়েক বছর আগে পৃথক ঘটনায় দুই প্রবাসী বাঙালি যুবককে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতার করা হয়। অনলাইনে নজরদারি করে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হতে দেখে স্টিং অপারেশনের ফাঁদ পাতে এফবিআই। তাদের একজনকে (বাতিল) অস্ত্র ও গ্রেনেড কিনতে সহায়তা করে এক ছদ্মবেশী এজেন্ট। আরেক এজেন্টকে এক্সপ্লোসিভ ডিলার সাজিয়ে ঐ যুবককে অকেজো বিস্ফোরক সরবরাহ করা হয়। তারা যখন অপরাধ সংগঠন করতে যায় তখনই হাতেনাতে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। এ ধরনের অপারেশনকেই মূলত স্টিং অপারেশন বলে। অর্থাৎ সম্ভাব্য বা প্রকৃত অপরাধীদের প্রথমে অপরাধ করতে সহযোগিতা করা, পরে তাদেরকে প্রমাণসহ গ্রেফতার করাই এই অপারেশনের মূল উদ্দেশ্য।
অপরাধ করার আগেই কোনো কোনো ব্যক্তিকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয় বিধায় স্টিং অপারেশন নিয়ে বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়ে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি নেতিবাচক হলেও সব ক্ষেত্রে নেতিবাচক নয়। সুইডেন, ফ্রান্সসহ আরো কিছু দেশে এ ধরনের স্টিং অপারেশন নিষিদ্ধ। অন্যদিকে ফিলিপাইন নির্দিষ্ট ধরনের (যেমন: ড্রাগ ডিলার সেজে মাদক বিক্রি করা) স্টিং অপারেশনকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে। এছাড়া স্টিং অপারেশনের আরো কয়েকটি ধরন আছে। যেমন- পলাতক অপরাধীকে ভ্রমণে যাওয়ার বিমান টিকেট পাঠানো, গাড়িচোরকে বিলাসবহুল গাড়ির টোপ দেয়া, হ্যাকারদের হানিট্র্যাপে (সুন্দরী নারীর ফাঁদ) ফেলে বাস্তব জীবনের পরিচয় বের করা, অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে মদ, গাঁজা বিক্রির প্রলোভন দেয়া, অনলাইন চ্যাটরুমে শিশু যৌন নিপীড়নকারীদের জন্য টোপ ফেলা, কাস্টমার সেজে অবৈধ দেহব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হানা দেয়া কিংবা ভুয়া টার্গেট দেখিয়ে অনলাইনে হিটম্যান (ভাড়াটে খুনি) ভাড়া করা ইত্যাদি।
অপারেশন ট্রোজান শিল্ড এমন একটি স্টিং অপারেশন যেখানে অপরাধীদের শতভাগ নিরাপদ মেসেজিং আশ্বাস দিয়ে বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে তাদের হাতে স্পুফিং অ্যাপ ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। এর মাধ্যমে তাদের কর্মকান্ডের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারী করা সম্ভব হয়।
ডিজিটাল নজরদারি
আজকের ডিজিটাল যুগে কারো উপর নজরদারি করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য এখন বেশ সহজ হয়ে গেছে। আপনার অজান্তেই আপনার ডিজিটাল ডিভাইসের তথ্য চুরি করা সম্ভব। স্মার্টফোন, ল্যাপটপের ক্যামেরা, স্পিকারের ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণ আপনার অজান্তে নেয়াও অসম্ভব কিছু নয়। তবে অপরাধীরা সাধারণত ডিভাইস ব্যবহারে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করে। তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য এনক্রিপ্টেড ডিভাইস বা ‘এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন’ সুবিধা সম্পন্ন মেসেজিং অ্যাপ/সফটওয়্যার ব্যবহার করে থাকে। এসব ডিভাইস ক্র্যাক করা বা গোপন তথ্য উদ্ধারের জন্য মেসেজগুলো হ্যাক করা বেশ কঠিন।
যেমন- আমাদের বহুল পরিচিত হোয়াটস অ্যাপ বা টেলিগ্রাম অ্যাপে ‘এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন’ পদ্ধতি আছে। অর্থাৎ (ডেভলপারদের দাবি অনুযায়ী) এর মেসেজগুলো আদানপ্রদানের সময় মাঝপথে ইন্টারসেপ্ট করে পড়ে ফেলা সম্ভব নয়। এছাড়া আইফোন, ব্ল্যাকবেরির মতো আধুনিক ফোনগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই শক্তিশালী হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষ আইটি এক্সপার্টদের জন্যও এগুলো ক্র্যাক করা খুবই কষ্টসাধ্য বিষয়। কিন্তু তারপরও এসব অ্যাপ বা ডিভাইস অপরাধীদের কাছে শতভাগ নিরাপদ নয়। অ্যাপ নির্মাতারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য ফাঁস করে কিনা তা ব্যবহারকারীদের জানার সুযোগ নেই।
কয়েক বছর আগে এফবিআই অ্যাপলের কাছে এক অপরাধীর আইফোন ক্র্যাক করতে সাহায্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। পরে তারা থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিয়ে ঠিকই নিজেদের কাজ সম্পন্ন করে। অর্থাৎ আধুনিক স্মার্টফোনগুলোও অপরাধীদের কাছে শতভাগ নিরাপদ নয়।
ফ্যান্টম সিকিউর
এটি একটি কানাডিয়ান কোম্পানি যারা হাইলি এনক্রিপ্টেড মডিফাইড ফোন বানাত। এর মালিক ভিনসেন্ট রামোসের সাথে কুখ্যাত মেক্সিকান মাফিয়া সংগঠন ‘সিনালোয়া কার্টেল‘ এর খাতির ছিল। তিনি কার্টেলের মাদক পাচারকারীদের যোগাযোগের সুবিধার্থে ‘ফ্যান্টম সিকিউর’ ফোন তৈরি করেন।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে বিশেষ কাজে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া থেকে ওয়াশিংটনে আসেন ভিনসেন্ট রামোস। খবর পেয়ে তার উপরেও স্টিং অপারেশন পদ্ধতি প্রয়োগ করে এফবিআই। এ ধরনের এনক্রিপ্টেড ডিভাইস বানানো ও সেটার বিক্রি আইনের দৃষ্টিতে মোটেও কোনো অন্যায় নয়। তাই রামোসকে গ্রেফতার করা সম্ভব নয়। কিন্তু তার ক্লায়েন্ট সেজে তার কাছে যাওয়া আন্ডারকভার এজেন্টের কাছে তিনি স্বীকার করেন যে মাদক পাচারকারীদের জন্যই তিনি এই ডিভাইস বানিয়েছেন। ব্যস, আর যায় কোথায়? এফবিআই এবার অডিও-ভিডিও তথ্য-প্রমাণের সাপেক্ষে তাকে গ্রেফতার করে।
আইনের ফাঁদ হাত থেকে বাঁচতে নিজের ‘ফ্যান্টম সিকিউর’ এর এডমিন লগইন ডিটেইলস হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। এফবিআই এর আইটি এক্সপার্টরা ফ্যান্টম সিকিউরের পুরো অপারেশনের কন্ট্রোল হাতে পেলেও তার ক্লায়েন্টদের পরিচয় সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানতে পারেনি। রামোস এমনভাবে সেটি ডিজাইন করেছেন যেন গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ না পায়। তবে তাকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে নিজেদের ভেতর একজন ডাবল এজেন্ট খুঁজে পায়! ফ্যান্টম সিকিউরের কাছে তথ্য পাঠাতেন ক্যামেরন অর্টিস। অর্টিস ছিলেন কানাডার পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ‘ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (NICC)’ এর ডিরেক্টর জেনারেল!
২০১৯ সালে ভিনসেন্ট রামোসকে নয় বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু এফবিআই কর্মকর্তারা তার সাজা মওকুফ করে মুক্তি দেয়ার বিনিময়ে ‘ফ্যান্টম সিকিউর’ সিস্টেমে একটি ব্যাকডোর তৈরি করে দেয়ার অফার দেন। অর্থাৎ পুরো সিস্টেমে এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করে দেয়া যা ব্যবহারকারীদের মেসেজ আদানপ্রদানের তথ্য এফবিআই-এর কাছে পাঠাবে। কিন্তু রামোস এই কাজ করতে কোনোভাবেই রাজি হননি। তাকে এফবিআই-এর প্রটেক্টিভ কাস্টডিতে নেয়ার প্রলোভন দেয়া হয়। অর্থাৎ তার নাম-পরিচয় একেবারে মুছে দিয়ে নতুন নামে নতুন স্থানে নতুন করে জীবন শুরুর নিশ্চয়তা। কিন্তু তার বদলে রামোস জেলে যাওয়াকেই ভালো মনে করলেন।
এফবিআইকে সাহায্য করলে মেক্সিকান মাফিয়ারা তার পরিবারের সবাইকে শেষ করে দেবে। এমনকি জেলের ভেতর তাকে খুন করাও কার্টেলের জন্য অসম্ভব কিছু না। ফলে অন্যান্য এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপের পর ফ্যান্টম সিকিউরও বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় এফবিআই-এর মাথায় দুষ্টবুদ্ধি (!) ভর করে। যেহেতু একটি অ্যাপ বন্ধ করলে তার জায়গা দখল করে আরেক অ্যাপ, তাহলে তারা নিজেই কেন এরকম একটি অ্যাপ বানাচ্ছে না? তাদের অ্যাপকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে সারা বিশ্বে। নিরাপদ মনে করে ব্যবহার করবে সব শ্রেণীর অপরাধী। সময়-সুযোগ অনুযায়ী ঝোপ বুঝে কোপ দেবে এফবিআই। তারা জানতো এই অপারেশনে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু দিন শেষে বিরাট আকারে সফলতা আসবেই।
অপারেশন ট্রোজান শিল্ড
এফবিআই-এর লক্ষ্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে গ্লোবাল অফেন্সিভ অপারেশন চালানো। এজন্য বিভিন্ন দেশের পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যৌথ অপারেশন শুরু করে তারা। এজন্য শুরুতেই তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ‘ফাইভ আই’ ও ইউরোপের পুলিশ নেটওয়ার্ক ‘ইউরোপোল’ এর সাথে যুক্ত হয়। এটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের বিশটি গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে গঠিত। ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোর এফবিআই ব্রাঞ্চ এরই মধ্যে এক ব্যক্তিকে পাকড়াও করেছে যে কিনা ফ্যান্টম সিকিউরের মতো ডিভাইস বানাতে কেবল শুরু করেছিল।
তাকে শাস্তি দেওয়া হবে এই প্রলোভন দেখিয়ে এফবিআই তাদের নিজস্ব এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপের ডেভেলপমেন্ট শুরু করে। এই অ্যাপ ও ফোনের বাজারজাত করার জন্য ‘ফ্যান্টম সিকিউর’ এর প্রথম সারির তিনজন ডিস্ট্রিবিউটরকে কাজে লাগানো হয়। এসব ফোনের তথ্য একমাত্র এফবিআই পাবে এই মর্মে কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ একাধিক দেশের সাথে চুক্তি করা হয়। এরই মাধ্যমে শুরু হয় অপারেশন ট্রোজান শিল্ড। একই অপারেশন অস্ট্রেলিয়ান পুলিশের কাছে অপারেশন আয়রনসাইড নামে পরিচিত।
প্রজেক্ট অ্যানম
এফবিআই-এর এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ ANOM। এটি যে ফোনে ইনস্টল করা থাকে তা দেখতে সাধারণ ফোনের মতোই। কিন্তু এই ফোনে ই-মেইল বা এসএমএস করা যায় না। নেই কোনো ডাটা ট্রান্সফার সিস্টেম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ট্র্যাকিং এড়াতে এর লোকেশন সার্ভিসও বাদ দেয়া হয়েছে। এমনকি এই ফোন দিয়ে কথাও বলা যায় না! ক্যামেরা ও স্পিকার অপশন ডিজেবল করে শুধুমাত্র অ্যানম মেসেঞ্জারের মাধ্যমে নিরাপদ মেসেজিং করা সম্ভব হয়। তবে এফবিআই এমন ব্যবস্থা করে যে এই ফোন থেকে যে মেসেজই পাঠানো হোক না কেন তার একটি কপি জমা হয়ে যাবে তাদের প্রক্সি সার্ভারে! ফলে ফোনের মালিকের উপর সবসময় নজরদারি করার দরকার নেই। মেসেজগুলো এনক্রিপ্টেড হবে ঠিকই, কিন্তু এফবিআই নির্দিষ্ট ‘Private Key‘ এর সাহায্যে সেগুলো ডিক্রিপ্ট করে পড়তে পারবে। প্রত্যেক ডিভাইসের নিজস্ব আইডি নাম্বার থাকায় মেসেজগুলোকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা সম্ভব। তবে এই অপারেশনের শুরুতেই এফবিআই একটি ভুল করে। তারা নিজস্ব সার্ভারের বদলে একাধিক ভাড়াটে সার্ভার ব্যবহার করেছিল।
অ্যানম ফোন গণ-উৎপাদনের পূর্বে বেটা টেস্টিংয়ের সময় ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে অস্ট্রেলিয়ায় ৫০টি ডিভাইস কালোবাজারে বিক্রি করা হয়। এর সবগুলোই ঠিকমতো কাজ করছিল। অস্ট্রেলিয়ার একটি অর্গানাইজড ক্রাইম সিন্ডিকেটের সদস্যদের কাজকারবার পর্যবেক্ষণ সম্ভব হয়। পরে ফোনের উৎপাদন বাড়ানো হয়। এর বিক্রি বাড়াতে আন্ডারকভার এজেন্টদের নিয়োগ দেয়া হয় যারা ফোনটির প্রশংসা করে বিক্রি বৃদ্ধি তে সক্ষম হয়। সবচেয়ে বড় সফলতা আসে অপরাধীদের কাছে আস্থাভাজন ‘হাকান আইক’ নামের এক প্রাক্তন মাদক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে। এফবিআই তার অজান্তেই তাকে অ্যানম ফোনের সেলসম্যান হিসেবে ব্যবহার করে।
এভাবে বিজ্ঞাপন ছাড়াই অপরাধ জগতে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে অ্যানম মেসেঞ্জারের খবর। অপরাধীরা হুমড়ি খেয়ে এই ফোন কিনতে শুরু করে। পরবর্তী আড়াই বছরে একশোটি দেশে ১১, ৮০০ ডিভাইস বিক্রি হয়। আর সেগুলো সাধারণ মানুষ যে কিনতো তা কিন্তু নয়। একেকটি ফোনের দাম প্রায় দুই হাজার ডলার, সার্ভিস চার্জও প্রায় বারশো ডলার, যা কেনার সক্ষমতা ও ইচ্ছা কেবলমাত্র অপরাধীদেরই আছে। তাদের উপর নজর রাখতে ইউরোপের পুলিশ নেটওয়ার্ক ‘ইউরোপোল’সহ অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোও কাজ শুরু করে। পুরো অপারেশনে এফবিআই প্রায় ২৭ মিলিয়ন মেসেজ পর্যালোচনা করে।
ফাঁস হয়ে গেলো গোমর
কথায় আছে যে ‘বাবারও বাবা আছে’! এফবিআই আইটি এক্সপার্টদের চেয়েও বড় বড় হ্যাকার বিভিন্ন দেশের অপরাধী সংগঠনের সাথে যুক্ত। তাদের কেউ ফোনটি ক্র্যাক করে দেখে যে এটি অচেনা সার্ভারে তথ্য পাঠাচ্ছে! ২০২১ সালের মার্চে এই খবর ডার্কওয়েবে ছড়িয়ে পড়ে। এফবিআই বুঝতে পারে যে সত্যকে আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তখনও প্রায় নয় হাজারের বেশি অ্যানম ডিভাইস এক্টিভ ছিল। ফলে নির্ধারিত সময়ের আগেই জাল গুটাতে বাধ্য হয় এফবিআই।
অপরাধীরা পুরোপুরি টের পাওয়ার আগেই গত ৮ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নয় হাজার সদস্যের সমন্বয়ে বিশ্বব্যাপী শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। এফবিআই-এর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৬টি দেশে প্রায় ৮০০ জনকে গ্রেফতার করে সেসব দেশের পুলিশ। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ কয়েকটি দেশ তথ্য প্রকাশ না করায় আটককৃতদের একদম সঠিক সংখ্যাটি বলা যাচ্ছে না। তবে অস্ট্রেলিয়ায় ২২৪ জন, নিউজিল্যান্ডে ৩৫ জন, সুইডেনে ১৫৫ জন, স্পেনে ৫ জন, ফিনল্যান্ডে ১০০ জন, নেদারল্যান্ডে ৪৯ জন ও জার্মানিতে ৭০ জন গ্রেফতারের খবর পাওয়া যায়। এদের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া থাকা একটি ইতালিয়ান মাফিয়া সংগঠন, আলবেনিয়ান অর্গানাইজড ক্রাইম সিন্ডিকেট, মেক্সিকান ড্রাগ কার্টেল, বাইকার গ্যাংসহ অনেক অপরাধী সংগঠনের সদস্যরা গ্রেফতার হয়েছে।
জব্দ হওয়া মালামালের তালিকাও বেশ চমকপ্রদ। একদিনের এই গ্লোবাল অপারেশনে ২৫টি মাদক উৎপাদন কারখানা ও গুদামে ২২ টন ক্যানাবিস, ৮ টন কোকেনসহ মোট ৪০ টন বিভিন্ন ধরনের মাদক, ২৫০টি বিভিন্ন রকমের অবৈধ অস্ত্র, ৫৫টি বিলাসবহুল গাড়ি, নগদ ও ক্রিপ্টোকারেন্সি (ভার্চুয়াল মুদ্রা) মিলিয়ে প্রায় ৪৮ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার ও ৩.৭ মিলিয়ন ডলারের স্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
এই অপারেশনের দ্বারা অন্তত ১৮০টি খুন এড়ানো সম্ভব হয়েছে ও একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘ডাবল এজেন্ট’ গ্রেফতার হয়েছেন। নির্ধারিত সময়ের আগেই অপারেশনটি বন্ধ হয়ে গেলেও যে পরিমাণ তথ্য এফবিআই-এর কাছে আছে তা দিয়ে কয়েক হাজার অপরাধী ও এ ধরনের অনেক সংগঠনকে ধ্বংস করা যাবে। তার চেয়েও বড় কথা হলো, অপরাধীরা এখন থেকে এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপের উপর আস্থা রাখতে ভয় পাবে। এমনও হতে পারে নতুন মেসেজিং অ্যাপ নিয়ে হাজির এফবিআই বা অন্য কোনো গোয়েন্দা সংগঠন। সব মিলিয়ে অপরাধীদের উপর ডিজিটাল নজরদারির নতুন যুদ্ধকৌশল হচ্ছে অপারেশন ট্রোজান শিল্ড।