আপনার একটি মোটামুটি ভালো মানের স্মার্টফোন আছে। আপনি মিউজিক পছন্দ করেন। আপনি সংগীতপ্রেমী। আজকের এই লেখা তাহলে আপনার জন্যই।
প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের যুগে দিন দিন আমাদের সামনে আসছে নতুন নতুন জিনিস। এক সময় আমাদের ফোনটিতে ছিল শুধুই ভিজিএ ক্যামেরা। আজ মোবাইল ফোনেই পাওয়া যাচ্ছে Sony IMX ক্যামেরা। আমাদের স্মার্টফোনটি আজ হাজার হাজার ফিচারের এক কারখানাই বটে! এসব ফিচারের অনেকগুলো আমরা যেমন জানি, ঠিক তেমনি অজানা থেকে যায় কত কিছু। আমাদের অনেকের স্মার্টফোনই এখন ডলবি সাপোর্ট করে, HiFi সাপোর্ট করে। আপনার স্মার্টফোনটি যদি 24-bit/192kHz audio সাপোর্ট করে, খুব সহজেই আপনি পেতে পারেন শ্রুতিমধুর মিউজিক সেবা, চালাতে পারেন FLAC মিউজিক।
ফ্লাক (FLAC) কি?
ইংরেজি Free Lossless Audio Codec এর সংক্ষিপ্ত রুপ হচ্ছে FLAC। নামেই হয়তো কিছুটা বুঝে নিয়েছেন কী এটি! FLAC হলো একধরনের অডিও কোডেক যেখানে কোনো ধরনের লস বা রিপ ছাড়াই গান বা মিউজিকের সব ধরনের গুণাবলী অক্ষুণ্ন রাখা হয়। আমরা সচরাচর যে ধরনের অডিও ফরম্যাটে (যেমন MP3, VBR, ACC) কোনো গান বা মিউজিক শুনে থাকি এটি তা থেকে পুরোপুরি আলাদা। সাধারণ অডিও ফরম্যাটে গান বা মিউজিকের সাইজ কমাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে পিচ, মাত্রা (উচ্চ, মধ্যম, নিম্ন), ট্রেবল ইত্যাদি কমিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু FLAC এর ক্ষেত্রে আপনি একটি গান বা মিউজিককে স্টুডিওতে যে কোয়ালিটি বজায় রেখে প্রস্তুত করা হয়, প্রায় সেই কোয়ালিটিতেই শুনতে পাবেন। বরং এক্ষেত্রে তা হবে সাধারণ MP3‘র থেকে অনেক বেশি শ্রুতিমধুর, আপনি হারিয়ে যাবেন সুরের আরও গভীরে। এখানে উল্লেখ্য, মুক্ত এই অডিও মাধ্যমটি Xiph.Org দ্বারা আবিষ্কৃত।
FLAC এর ইতিহাস
১৯৯৩ সালে MP3 অডিও কোডেক আবিষ্কৃত হবার পরে মিউজিকের জগতে এক আমূল পরিবর্তন আসে। অপেক্ষাকৃত কম সাইজে শুরু হয় অডিও রিপিং। ফলে প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই অডিও ফরম্যাটটি। তখন ইন্টারনেট ছিল এক সোনার হরিণ, ফলে সিডিতে বা ফ্লপি ডিস্কে এই ফরম্যাটে অডিও রিপ করা শুরু হল সবখানেই। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন পৃথিবীতে ইন্টারনেটের ব্যবহার একটু সহজতর হল, আস্তে আস্তে যখন বড় বড় স্টোরেজের ডিভাইস এবং স্মার্টফোন আসতে শুরু করলো, তখন মানুষ ভলিউম বা সাইজের তুলনায় অগ্রাধিকার দেওয়া শুরু করলো গুণের দিকে। এরকম এক বিবেচনায়, ২০০১ সালে Xiph.Org ফাউন্ডেশনের জশ কোয়ালসন এবং এরিক ডি ক্যাস্ট্রো লোপো নামের দুজন নির্মাতা মিউজিকের সব ধরনের গুণাবলী অক্ষুণ্ণ রেখে আবিষ্কার করে ফেলেন এই অডিও ফরম্যাটটি। শুরুর দিকে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ততটা জনপ্রিয় না হলেও আস্তে আস্তে সময় যতটা এগোতে শুরু করলো, ফরম্যাটটি ঠিক জনপ্রিয় হতে শুরু করলো। আজ বিশ্বের লক্ষ লক্ষ সংগীতপ্রেমী থেকে শুরু করে বড় বড় সংগীত প্রতিষ্ঠান, সুরকার এবং সংগীত প্রকৌশলীদের কাছে কাজ করার জনপ্রিয় এক অডিও ফরম্যাট বা কোডেক এই FLAC।সময়ের সাথে সাথে আমাদের মতো ৩য় বিশ্বের দেশগুলোতেও এই অডিও কোডেকটি দিন দিন জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
FLAC এর সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য
লসলেস
আগেই বলেছি, FLAC মিউজিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে রিপিংয়ের ক্ষেত্রে মিউজিকের সাথে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজ করা হয় না। ফলে নির্মাণের সব ধরনের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলিই অক্ষুণ্ণ থাকে এই FLAC এ। সাধারণ MP3 ফরম্যাটে যেখানে একটি গান বা মিউজিক ১৬ বিটে তৈরি করা হয়, সেখানে FLAC মিউজিক ফরম্যাটে একটি গান বা মিউজিক তৈরি হয় কমপক্ষে ২৪ বিটে। কাজেই সাধারণ MP3 ফরম্যাটের তুলনায় FLAC অনেক বেশি লসলেস এবং শ্রুতিমধুর।
দ্রুত
সাধারণ MP3 ফরম্যাটের তুলনায় FLAC অনেক বেশি দ্রুত। গতিশীল এবং অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক কোডেক অ্যালগারিদমে তৈরি বলে এক্ষেত্রে FLAC মিউজিকে আপনি অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতি সমৃদ্ধ মিউজিকের অভিজ্ঞতা পারবেন।
হার্ডওয়্যার সাপোর্ট
সাধারণ MP3 চালাতে যে হার্ডওয়্যার দরকার হয়, তার তুলনায় একটু ভালোমানের হার্ডওয়্যার দরকার হয় FLAC ফাইল চালাতে। অপেক্ষাকৃত ভারী হবার কারণে এক্ষেত্রে একটু ভালো মানের ডিভাইসও দরকার পড়ে FLAC চালাতে। ভালো মিউজিকের অভিজ্ঞতা পেতে একটু ভালো মানের ডিভাইস তো লাগবেই। এছাড়া সর্বোচ্চ পর্যায়ের অভিজ্ঞতার জন্য ভালো মানের হাই-ফাই হেডফোনেরও দরকার আছে।
ফ্লেক্সিবেল মেটাডাটা
অনেক বেশি সমৃদ্ধ হবার কারণে আপনি চাইলেই এখানে আপনার ইচ্ছামত এখানে মেটাডাটা এডিটের মাধ্যমে পরিবর্তন করে নিতে পারবেন। এছাড়া এই ফরম্যাট সহজেই স্ট্রিমযোগ্য। কেউ চাইলেই এটি এডিটের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত রেজ্যুলেশনে নিয়ে আসতে পারেন। তবে তার জন্য আপনার নির্মাতা হওয়াটাও বেশ জরুরি।
ওপেন সোর্স
ওপেন সোর্স হবার কারণে এই মিউজিক ফরম্যাট নিয়ে আইনি ঝামেলা নেই কোনো। সংরক্ষণ, সিডি রিপিং এবং বার্নিংয়ের জন্য এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
কীভাবে FLAC মিউজিক চালাবেন
সাধারণত স্মার্টফোনের ডিফল্ট মিউজিক প্লেয়ার FLAC ফাইল ফরম্যাট সাপোর্ট করে না। এক্ষেত্রে FLAC ফাইল চালাতে হলে আপনাকে একটি FLAC ফাইল সাপোর্ট করে এমন একটি মিউজিক প্লেয়ার ডাউনলোড করে নিতে হবে। বিভিন্ন ওএস’এ FLAC চালানোর উপায় নিয়ে এখন তবে কথা হয়ে যাক।
অ্যান্ড্রয়েড
চিন্তার কিছু নেই। অ্যান্ড্রয়েডেই FLAC মিউজিক প্লে করা সবথেকে সহজ। অ্যান্ড্রয়েড হানিকম্ব (৩.১) থেকে উপরের যেকোনো অ্যান্ড্রয়েড সংস্করণ ন্যাটিভভাবে FLAC ফাইল কোডেক সাপোর্ট করে। এক্ষেত্রে যদি আপনার ফোনের মিউজিক প্লেয়ারটি এই ফাইল ফরম্যাট সাপোর্ট না করে তাহলে আপনি খুব সহজেই গুগল প্লে স্টোর থেকে এই ফাইল ফরম্যাট সাপোর্ট করে এমন একটি মিউজিক প্লেয়ার ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। বেশিরভাগ পেইড মিউজিক প্লেয়ার এই ফাইল ফরম্যাট সাপোর্ট করে। এছাড়া ফ্রিতে পাবেন Player Pro, Bubble UPnP ইত্যাদি অ্যাপ।
আইওএস
আইওএস এর ডিফল্ট প্লেয়ার FLAC ফাইল ফরম্যাট সাপোর্ট করে না। কেননা এক্ষেত্রে আইটিউন্স সংক্রান্ত জটিলতা আছে। আপনি চাইলে FLAC Player, MediaConnect, Capriccio এসব প্লেয়ার অ্যাপল স্টোর থেকে ডাউনলোড করে সহজেই FLAC মিউজিক চালাতে পারবেন।
উইন্ডোজ
উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ১০ এর ডিফল্ট মিউজিক প্লেয়ার FLAC মিউজিক প্লে সাপোর্ট করে।
FLAC মিউজিকের ভবিষ্যৎ
দিনকে দিন FLAC মিউজিকের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এখন সবার হাতে হাতেই ভালো মানের স্মার্টফোন। কাজেই এই মিউজিক চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যারসম্পন্ন মোবাইল ফোনটি মানুষের ক্রয় ক্ষমতার নাগালেই রয়েছে। এখনকার অনেক স্মার্টফোনই 24-bit/192kHz audio সাপোর্ট করে। এক্ষেত্রে আপনার লাগবে শুধু একটি ভালো মানের (Hi-Res) হেডফোন।
FLAC যেহেতু স্টুডিও পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন, কাজেই অনেক মিউজিকপ্রেমী দিন দিন এই ফরম্যাটের দিকে ঝুঁকছেন। এছাড়া একটি সাধারণ MP3 ফাইলকে যদি আপনি অন্য কোনো মাধ্যমে কনভার্ট করতে চান, সেক্ষেত্রে আপনি এর পিচ লেভেল আরো হারাবেন। কিন্তু FLAC ‘এর ক্ষেত্রে এমন হবার সম্ভাবনা নেই। কাজেই মিউজিক নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষণ চালাতে FLAC এর তুলনা নেই।
ফিচার ইমেজ- Wikimedia.org