দিন যাচ্ছে, তার সাথে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে সবকিছু। নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করছে মানুষ। দৈনন্দিন জীবনকে করছে আরো সহজ। আজ থেকে মাত্র কয়েক শত বছর আগের কথা। যখন খুব ছোটখাটো রোগেই শয়ে শয়ে মানুষ মারা যেত। এমনকি উনবিংশ শতাব্দীতেই পৃথিবীতে লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে কলেরা, পক্সের মতো বিভিন্ন মহামারীতে। আস্তে আস্তে মানুষ এসব রোগকে প্রতিরোধ করতে শিখেছে। আবিষ্কার করছে নানা প্রতিষেধক ও ঔষধ। ফলে এসব রোগে মানুষের মৃত্যুর হার কমে নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়।
কিন্তু তারপরও আবির্ভাব ঘটছে নতুন নতুন রোগের। এইডস, ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগের সাথে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ইবোলা ইত্যাদি রোগ মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে পৃথিবীর অনেক স্থানে। তাই এসব রোগের সাথে মানুষ যুদ্ধ করে চলছে নিরন্তর। মানুষ প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছে এসব অসুখ-বিসুখ ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে উতরে আরো উন্নত ও ঝামেলাহীন জীবন যাপন করতে। আর এসবের জন্য মানুষ সাহায্য নিচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ আজ বিভিন্ন অসুখ নির্ণয়, রোগের চিকিৎসা সহ মানব দেহের অনেক প্রতিবন্ধকতাকে দূর করছে। সামনের দিনগুলোতেও অনেক পরিবর্তন আসবে যা চিকিৎসা বিজ্ঞানকে নিয়ে যাবে আরো অনেক দূর। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এমনই কিছু চমকপ্রদ বিষয়ের খবর আজকে আপনাদের জানানো হবে, যেগুলো হয়তো আমরা সামনের বছরগুলোতেই দেখতে পাবো।
১. হিউম্যান হেড ট্রান্সপ্লান্ট
চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে চমকপ্রদ যে ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে এই বছরে সেটি হলো হিউম্যান হেড ট্রান্সপ্লান্ট বা মানব মস্তক প্রতিস্থাপন। এতদিন আমরা হার্ট, কিডনি সহ নানা রকম অঙ্গের প্রতিস্থাপনের কথা শুনেছি। কিন্তু সরাসরি পুরো মাথাটিই একজনের শরীর থেকে নিয়ে অন্যজনের শরীরে প্রতিস্থাপন করার ঘটনা মানুষের বেলায় এটাই প্রথম। সার্জিও ক্যানাভেরো নামের একজন ইতালিয়ান নিউরোসার্জন এই জটিল কাজটি করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। এ পর্যন্ত হেড ট্রান্সপ্লান্টের পর কোনো প্রাণীই বেশি দিন বাঁচেনি। কারণ প্রতিস্থাপিত মাথার সাথে শরীরের সবকিছু যুক্ত করা গেলেও যুক্ত করা যেত না স্পাইনাল কর্ড। কিন্তু সার্জিও ক্যানাভেরো এবার একটু ভিন্ন পথে এগোবেন। একটি বিশেষ ব্লেডের সাহায্যে তিনি এই প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন এবং এক্ষেত্রে তিনি একটি বিশেষ জৈব উপাদান যুক্ত গ্লু ব্যবহার করবেন স্পাইনাল কর্ডের নার্ভের বৃদ্ধির জন্য।
সমস্ত প্রক্রিয়াটি ঘটবে এভাবে- প্রথমে যিনি তার মাথাটি এই প্রতিস্থাপনের জন্য দান করতে রাজি হয়েছেন তার শরীর থেকে সার্জনরা মাথাটি বিশেষ ব্লেডের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করবেন। এরপর যে শরীরে মাথাটি স্থাপন করা হবে সেই শরীরের রক্তবাহী শিরা ও নার্ভের সাথে মাথাটির শিরা ও নার্ভ যুক্ত করা হবে। এরপর বিশেষ জৈব উপাদান দিয়ে তৈরি গ্লু দ্বারা মাথাটির সাথে শরীরের স্পাইনাল কর্ডকে যুক্ত করা হবে, যাতে স্পাইনাল কর্ডটি ধীরে ধীরে মাথার সাথে পুরোপুরি যুক্ত হয়ে যায়। এরপর শরীরের সাথে মাথাটি যাতে পুরোপুরি যুক্ত হয়ে যায় এজন্য রোগীকে ওষুধের মাধ্যমে চার সপ্তাহ ধরে অচেতন অবস্থায় রাখা হবে। এটাই এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এর আগে ডাক্তাররা স্পাইনাল কর্ডকে কখনো পুরোপুরি শরীরের সাথে যুক্ত করতে সমর্থ হননি। তবে এ ব্যাপারে ক্যানাভারোর নিজের উপর সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাস রয়েছে। তিনি বলেছেন, এ প্রক্রিয়ার জন্য তার যে প্রযুক্তি দরকার তার কোনোটাই এখন দুষ্প্রাপ্য নয়। তিনি জানিয়েছেন, প্রায় ৩৬ ঘন্টা ধরে ১৫০ জন বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সার্জন নিয়ে এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে। এক্ষেত্রে সফলতার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ এবং এই প্রতিস্থাপনের কয়েক মাস পরই রোগী হাটাচলা করতে পারবে বলে জানিয়েছেন তিনি। পুরো ঘটনাটাই শুনে হয়তো বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনী মনে হচ্ছে। কিন্তু এটা হতে যাচ্ছে এ বছরের ডিসেম্বর মাসে। ভ্যালেরি স্পাইরিদনভ ও ওয়ার্ডনিগ হফম্যান নামের দুজন রাশিয়ান ব্যক্তি বিশ্বের প্রথম এই হেড ট্রান্সপ্লাট প্রক্রিয়ায় নিজেদের মাথা ও শরীর দান করতে রাজি হয়েছেন।
২. মেডিক্যাল থ্রিডি প্রিন্টিং
থ্রিডি প্রিন্টার কিংবা থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের কথা হয়তো আমরা অনেকেই জানি। নরমাল পেপার প্রিন্টারের মাধ্যমে আমরা যেমন বিভিন্ন লেখা কম্পিউটারের মাধ্যমে কাগজে প্রিন্ট করি, ঠিক তেমন থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে কম্পিউটারে করা ডিজাইন থেকে সেই বস্তুর একটি কঠিন ত্রিমাত্রিক বাস্তব রূপ পাওয়া যায়। এর সাহায্যে বিভিন্ন ভাস্কর্য, পুতুল, আসবাবপত্র সহ প্রায় সব ধরনের জিনিসই তৈরি করা যায়। কিন্তু আগামী বছরগুলোতে এই থ্রিডি প্রিন্টার চিকিৎসার ক্ষেত্রে আনতে যাচ্ছে অভাবনীয় কিছু পরিবর্তন।
বায়োটেকনোলজি ইন্ডাস্ট্রিগুলো সম্প্রতি কাজ করছে থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে কীভাবে শরীরের কোষ তৈরি করা যায় তা নিয়ে। এই গবেষণায় যদি সফলতা আসে, তবে অদূর ভবিষ্যতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি করা সম্ভব হবে থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে। ইতিমধ্যেই এই প্রিন্টারের মাধ্যমে শরীরের হাড় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন গবেষকরা। এছাড়াও থ্রিডি প্রিন্টারের মাধ্যমে বিভিন্ন ওষুধ তৈরি করার প্রযুক্তি আসছে আগামী দিনগুলোতে। এর ফলে খুব সহজে তৈরি করা যাবে বিভিন্ন ঔষধ। যারা দুর্ঘটনায় হাত কিংবা পায়ের মতো শরীরের কোনো অঙ্গ হারিয়েছেন, তাদের জন্য কৃত্রিম অঙ্গও আজকাল তৈরি হচ্ছে থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে।
৩. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) এর বদৌলতে অভাবনীয় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে সামনের বছরগুলোতে। বর্তমানে স্মার্টফোনগুলোর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন অ্যাসিস্ট্যান্ট আমাদের জীবনকে করেছে অনেক সহজ। ঠিক এভাবেই আগামী দিনগুলোতে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে রাখবে অনন্য ভূমিকা। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? জ্বর, সর্দিকাশি কিংবা ছোটখাটো কোনো অসুখ হয়েছে? ভবিষ্যতে হয়তো আপনাকে আর এসব কারণে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না। বাড়িতে বসেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন অ্যাসিস্ট্যান্টের মাধ্যমে সহজেই আপনি পাবেন স্বাস্থ্যসেবা।
এছাড়াও সম্প্রতি গুগল এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নের জন্য গঠন করেছে গুগল ব্রেইন, যাদের কাজ এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নতুন নতুন ও আরো উন্নত ক্ষেত্রে কাজে লাগানো। এই প্রজেক্টের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রে কার্জওয়েল নামের বিশ্ববিখ্যাত একজন AI এক্সপার্ট। হয়তো খুব শীঘ্রই আমরা আমাদের মস্তিষ্কভিত্তিক ডিজিটাল স্টোরেজ দেখতে পাবো। অথাৎ আমরা আমাদের মস্তিস্কের তথ্যগুলোকে আপলোড করতে পারবো কম্পিউটারে!
৪. পরীক্ষাগারে তৈরি অঙ্গ
কোনো কারণে টিকটিকির লেজ খসে পড়লে কিংবা কেটে গেলে ধীরে ধীরে তা আবার গজায়। কিন্তু মানুষের বেলায় এমনটা হয় না। তবে আমাদের শরীরেও এমন কিছু কোষ রয়েছে যা প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে, আবার নতুন তৈরি হচ্ছে। যেমন আমাদের চামড়ার বহিরাবরণের কোষগুলো। আমাদের চামড়ার বহিরাবরণটি প্রতি দুই থেকে চার সপ্তাহ অন্তর অন্তর একবার সম্পূর্ণরূপে উঠে যায়। এরপর আবার নতুন কোষ জন্মায়। চামড়ার ক্ষেত্রে এমনটা হলেও শরীরের কোনো একটি অঙ্গ কিন্তু একবার হারিয়ে ফেললে পুনরায় জন্মায় না।
কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে শরীরের কোষ থেকে কান, নাক প্রভৃতি অঙ্গ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এক্ষেত্রে যার জন্য অঙ্গটি তৈরি করা হবে তার দেহ থেকে কিছু কোষ নেওয়া হয়। এরপর উপযুক্ত পরিবেশে কোষটির বিকাশ ঘটিয়ে একটি কোষ থেকে অনেকগুলো কোষ সৃষ্টির মাধ্যমে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ অঙ্গটি গঠিত হয়। এরপর এই কৃত্রিম অঙ্গটি স্থাপন করা হয় রোগীর শরীরে। কৃত্রিম অঙ্গটি জীবিত কোষ দ্বারা তৈরি বলে আস্তে আস্তে অঙ্গটির মধ্যে শরীরের শিরা-উপশিরা ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। ফলে কৃত্রিম এই অঙ্গটি হয়ে ওঠে দেহের একটি অংশ।
বর্তমানে এই প্রযুক্তিতে ছোটো ছোটো কিছু অঙ্গ তৈরি করা সক্ষম হলেও ভবিষ্যতে এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে আনতে যাচ্ছে ব্যাপক এক পরিবর্তন। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে এই পদ্ধতিতে হৃদপেশী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে আগামী বছরগুলোতে এই হৃদপেশীর মাধ্যমে তৈরি করা হবে একটি সম্পূর্ণ হৃদপিন্ড! অর্থাৎ হৃদপিন্ড প্রতিস্থাপনের জন্য আর অন্য কোনো দাতা খোঁজার প্রয়োজন হবে না। হৃদপিন্ড ছাড়াও এ পদ্ধতিতে ভবিষ্যতে তৈরি হবে শরীরের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
৫. পোর্টেবল ডায়াগনস্টিক ডিভাইস
বর্তমানে রক্তের ব্লাড সুগার বা ডায়াবেটিক টেস্ট, রক্তচাপ নির্ণয় ইত্যাদি আমরা ঘরে বসেই করতে পারি। কিন্তু কয়েক দশক আগেও এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আমাদেরকে ডাক্তারের কাছে এবং বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দৌড়াদৌড়ি করতে হতো। বর্তমানে আমরা ইসিজি, এক্স-রে ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শরণাপন্ন হই। কিন্তু আগামী বছরগুলোতে আমাদের আর এসবের জন্য বাইরে যেতে হবে না। ঘরে বসেই আমরা এসব পরীক্ষা করতে পারবো পোর্টেবল ডিভাইসের মাধ্যমে। সম্প্রতি গবেষকরা পোর্টেবল ইসিজি মেশিন উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন।
এছাড়াও কয়েক বছর আগে ইউজিন চ্যান নামক একজন ডাক্তার ও তার দল মিলে তৈরি করেছিলেন এমন একটি বহনযোগ্য যন্ত্র যেটিতে শুধু এক ফোঁটা রক্ত প্রবেশ করালেই কয়েকশ রোগ নির্ণয় করা যাবে। ডিভাইসটি এতই ছোট যে তা পকেটে করে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। ভবিষ্যতেও আসতে যাচ্ছে ঠিক এমনই অনেক যন্ত্র।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নয়নের সাথে সাথে ভবিষ্যতে নতুন অনেক অজানা রোগেরও জন্ম হবে। এসব রোগ থেকে বাঁচতে হলে আমাদের হতে হবে আরো স্বাস্থ্য সচেতন। পরিবেশকে রাখতে হবে দূষণমুক্ত। তবেই আগামীর পৃথিবীতে আমরা বিভিন্ন শারীরিক বিপর্যয় থেকে বেঁচে থাকতে পারবো।