“হ্যালো! আমরা খুব উচ্চ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন একজনকে খুঁজছি। কিন্তু তা বের করা খুব সহজ নয়। তাই আমরা একটি ধাঁধার পরীক্ষা নিচ্ছি। এই বার্তার শেষে একটি ছবি জুড়ে দেয়া হয়েছে। এই ছবির ভেতর আরেকটি গোপন বার্তা লুকানো রয়েছে। যদি নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করো, তাহলে সেটা বের করো। এই ধাঁধার সমাধান তোমাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসবে। আমরা তোমার অপেক্ষায় আছি। শুভ কামনায়, ৩৩০১”
৫ জানুয়ারি, ২০১২ সাল। আজ থেকে মাত্র ৯ বছর পূর্বে 4Chan নামক এক ওয়েবসাইটে একটি রহস্যময় ছবির সাথে এরকম একটি বার্তা জুড়ে দেয়া হয়। ওয়েবসাইটের নীতিমালা অনুযায়ী ছবি প্রকাশকারীর নাম-পরিচয় গোপন রাখা হয়। তাই প্রকাশকারীর পরিচয়ের দিকে কারো নজর ছিল না। হঠাৎ করে যেন ইন্টারনেটের হাওয়া বদল হয়ে গেলো। পৃথিবীর সেরা হ্যাকার এবং কোড সমাধানকারীরা নিজেদের বুদ্ধিমত্তা প্রমাণের এক অদ্ভুত পরীক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়লো। সেদিন থেকে এই রহস্যময় ধাঁধার নাম দেয়া হয় ‘সিকাডা ৩৩০১’। এই ধাঁধা সমাধান করা যেন অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে এগিয়ে যাওয়া। কারণ, কেউ জানে না এর শেষ গন্তব্য কী! কিংবা কারা অপেক্ষা করছে পর্দার ওপারে। এই ধাঁধাকে বর্তমান ইন্টারনেট জগতের সবচেয়ে বড় রহস্যজট হিসেবে গণ্য করা হয়। চলুন, আমরাও নেমে পড়ি এই রহস্য সমাধানের এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে।
সিকাডা ৩৩০১ এর শুরু
“ঘটনাক্রমে আমি ২০১২ সালে প্রকাশিত সেই সিকাডা ৩৩০১ এর ধাঁধার সন্ধান পাই। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমি সবার থেকে পিছিয়ে ছিলাম। কারণ, আমি ছবি প্রকাশিত হওয়ার অনেক পরে এটি দেখতে পাই। প্রথমদিকে আমি ব্যাপারটা বেশ সহজভাবে নিয়েছিলাম। যেন কোনো সহজ ধাঁধা সমাধান করছি। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা এত সহজ হবে না। কিন্তু আমি কখনো হাল ছেড়ে দেইনি। সবসময় এমন কিছু চাইতাম যা আমার ঘাম ছুটিয়ে দেবে। তাই সিকাডা আমার জন্য খুব আকর্ষণীয় ছিল।”
বলছিলেন সিকাডা ৩৩০১ এর সমাধানে অগ্রদূত জুয়েল এরিকসন। পেশায় একজন ক্রিপ্টোগ্রাফি গবেষক এরিকসন আজ পর্যন্ত সিকাডা ধাঁধা সমাধানকারীদের মাঝে অন্যতম হিসেবে গণ্য হন। এই ধাঁধা সমাধান অভিযানে তাকে স্টেগানোগ্রাফি, ক্রিপ্টোগ্রাফি, সাহিত্যতত্ত্বসহ আরো বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে পদচারণা করতে হয়েছিলো। একেকটি ধাঁধার সমাধান যেন আরেকটি রহস্যের শুরু। এরিকসন সিকাডার সর্বপ্রথম প্রকাশিত ছবি থেকে স্টেগানোগ্রাফি সফটওয়্যারের সাহায্যে একটি ক্ষুদে বার্তার সন্ধান লাভ করেন। শিফট সাইফারের সাহায্যে নিবন্ধিত সেই কোড সমাধানের পর তিনি একটি ওয়েবসাইটের লিংকের সন্ধান পান। বেশ উত্তেজনার সাথে তিনি সেই ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেন। কিন্তু সেখানে একটি পাতিহাঁসের ছবি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না।
কিন্তু এরিকসন বুঝতে পেরেছিলেন, এই হাঁসের ছবির মাঝেই আরেকটি বার্তা লুকিয়ে আছে। তিনি ফের স্টেগানোগ্রাফি সফটওয়্যারের সহায়তা নিলেন। কিন্তু এরপর যেন তিনি হারিয়ে গেলেন সংখ্যার ভিড়ে। কোলন দিয়ে আলাদা করা বেশ কিছু সংখ্যার সমন্বয়ে তৈরি এই নতুন ধাঁধা যেন এরিকসনকে ফাঁদে ফেলে দিয়েছিলো। কোডের শুরুতে লেখা আছে, এই কোডের সমাধান কোনো বইয়ের পাতায় লুকানো রয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর কোটি কোটি বইয়ের ভিড়ে ঠিক কোথায় এর সমাধান পাওয়া যাবে, তা বের করা সহজ হবে না।
বইয়ের কোডের সাথে সংযুক্ত একটি লিংকের মাধ্যমে তিনি Reddit ওয়েবসাইটের একটি পেজে চলে গেলেন। সেখানে পড়লেন আরেক বিপাকে। পুরো পেজে সব অদ্ভুত সাংকেতিক ভাষায় কিছু পোস্ট করা হয়েছে। এখানে সবাই নিজের ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে। কিন্তু এই পেইজের উপরে মায়া সভ্যতার সংখ্যা ব্যবহার করে কিছু একটা লেখা রয়েছে। তিনি সেই সংখ্যাধাঁধা পরীক্ষা করে বুঝতে পারলেন, এই ধাঁধা সমাধান করতে হলে তার প্রয়োজন একটি সহায়ক চাবি (Key)। আর সেই চাবি লুকিয়ে আছে সেই অজানা বইয়ের ভেতর। এরিকসন এবার তার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সফটওয়্যারের সহায়তা নিলেন এবং তিনি একদিন সেই রহস্য সমাধান করে ফেললেন। তাছাড়া সিকাডা ফোরামে অন্যান্য হ্যাকাররাও বইটি বের করতে সহায়তা করেছিলো। আর সেই বইটির নাম The Mabinogion বা দ্য মাবিনোজিয়ন। মধ্যযুগীয় কাব্যমালার সমন্বয়ে রচিত এই পুস্তকটির সাহায্যে তিনি কাজে লেগে গেলেন।
এতদূর চলে আসা এরিকসনের কিন্তু সেই চাবি বের করতে তেমন সময় লাগেনি। সেই সহায়ক চাবি ব্যবহার করে তিনি গুপ্ত বার্তার সন্ধান পেলেন। Reddit-এর পেজ থেকে তিনি পেলেন আরো দুটো ছবি এবং বরাবরের মতো এই দুটো ছবির মাঝে লুকিয়ে ছিলো পরবর্তী ধাঁধার সমাধান। এরিকসন তার স্টেগানোগ্রাফির সাহায্যে দুটো ছবির মাঝে লুকনো বার্তার সন্ধান পেলেন। কিন্তু এবার তিনি ফের বিপাকে পড়লেন। কারণ, এই বার্তার মাঝে বেশ কিছু ধাঁধা লুকিয়ে আছে, যার উত্তরে বেরিয়ে আসবে কিছু সংখ্যা। সিকাডার নির্দেশনা অনুযায়ী, এই সংখ্যাগুলো টেক্সাস শহরের একটি ফোন নাম্বারের অংশ। টেক্সাসের ফোন সহায়িকা ঘেঁটে এরিকসন বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য নাম্বারের তালিকা তৈরি করলেন। সেগুলোতে বার বার ফোন দিয়ে তিনি কাঙ্ক্ষিত ফোন নাম্বার বের করলেন। সিকাডার সেই নাম্বারে বেশ কয়েকবার ফোন দেয়ার পর যান্ত্রিক স্বরে একটি রেকর্ডকৃত ভয়েস মেইল ভেসে আসলো,
“সাবাস! তুমি অনেকদূর পর্যন্ত চলে এসেছো। খুব ভালো বুদ্ধি আছে তোমার। এবার আমাদের প্রথম ছবিতে ফিরে যাও। সেখানে আরো তিনটি সংখ্যা লুকিয়ে আছে। প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে ৩৩০১। বাকি দুটো সংখ্যা বের করার দায়িত্ব তোমার। এরপর তিনটি সংখ্যা একত্রে গুণ করে গুণফলের পরে .com বসিয়ে চলে যাও তোমার পরবর্তী ধাঁধার জগতে। শুভ কামনা থাকলো। বিদায়।”
ধাঁধার সমাধানে পৃথিবীর পথে
জুয়েল এরিকসনের ভ্রূ কুঁচকে গেলো। কী মুশকিল! এই ধাঁধার কি কোনো শেষ আছে? কিন্তু তিনি হাল ছাড়বেন না। স্টেগানোগ্রাফি ব্যবহার করেও তিনি নতুন কিছু বের করতে পারলেন না। এবার তিনি সফটওয়্যার ব্যবহার ছেড়ে নিজ চোখে ছবিখানা পরখ করতে থাকলেন। বেশ কিছুদিন পরখ করার পর তিনি পরবর্তী দুটো সংখ্যা বের করার খুব সহজ একটি উপায় বের করলেন। কিন্তু তা কাজে দিবে কিনা তা সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। তবুও চেষ্টা করতে তো দোষ নেই! তিনি পাতিহাঁসের ছবির দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ বের করলেন। এরপর ৩৩০১ এর সাথে গুণ দিয়ে গুণফল বের করে সিকাডার নির্দেশনা অনুযায়ী চেষ্টা করলেন। তার ভাগ্য সহায় হলো। তার সামনে উন্মোচিত হলো আরেকটি ওয়েবসাইট। সেখানে সিকাডার বহুল পরিচিত ছবির নিচে একটি ঘড়িতে সময় গণনা হচ্ছিলো। এরিকসন ঘড়ির ডিজিট শূন্যতে নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। তারপর হঠাৎ করে পুরো ওয়েবসাইটের চেহারা বদলে গেলো। সিকাডার মথ বদলে গিয়ে সেখানে হাজির হলো কয়েকগুচ্ছ সংখ্যাধাঁধা। কিন্তু এরিকসন এবার ঘাবড়ালেন না। সংখ্যাগুলো দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন, এগুলো জিপিএস যন্ত্রের সাহায্যে বের করা ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক। তিনি মানচিত্র বের করে যখন জিপিএস স্থানাঙ্ক মিলিয়ে দেখলেন, তখন কিন্তু ঠিকই ঘাবড়ে গেলেন।
স্পেন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং পোল্যাণ্ডের বিভিন্ন স্থান নির্দেশ করা আছে সেই স্থানাঙ্কগুলোতে। কিন্তু এরিকসনের পক্ষে এতগুলো দেশ ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। তাই তিনি সিকাডা সমাধানকারীদের নিজস্ব ব্লগে চোখ রাখলেন। ততদিনে মানুষ যেন বাস্তবতায় ফিরে আসার চেষ্টা করছে। আসলে ‘কারা এই সিকাডা ৩৩০১’, ‘কী তাদের উদ্দেশ্য’ এরূপ হাজারো প্রশ্নে মুখরিত ছিল সেই ব্লগ। তখন অনেক বিশ্লেষক নতুন তত্ত্ব প্রদান করলেন, সিকাডা ৩৩০১ হয়তো কোনো গোপন সংঘের ভর্তি ফরম। কিন্তু এরিকসন জানতেন, হাজারো অপপ্রচারেও তিনি থামবেন না। শেষপর্যন্ত তিনি চেষ্টা করে যাবেন। স্থানীয় সিকাডা সমাধানকারীরা সেই স্থানগুলোতে একটি টেলিফোন বুথের স্তম্ভে সিকাডা চিহ্ন সম্বলিত একটি পোস্টার আবিষ্কার করলো। সিকাডার চিহ্নের নিচে একটি কিউ আর কোড যুক্ত করা ছিল।
সিকাডার হতাশা
“পুরো ব্যাপারটি খুবই হতাশাজনক ছিল। বিশেষ করে যখন মানুষজন সমাধান বের করে অন্যজনকে জানিয়ে দিচ্ছিলো। সবাই যেন সিকাডার সাথে মজা নিচ্ছিলো। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা অনেকেই নিজের প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তাই খুব বিরক্ত হয়েছিলাম মানুষের বোকামিতে”- জুয়েল এরিকসন।
নিজের হতাশার কথা জানান দিলেন এরিকসন। তিনি একা নন, ততদিনে অনেক সমাধানকারী মানুষের বোকামিতে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছিলো। তবে এসব আবেগে সময় নষ্ট করতে রাজি ছিলেন না তিনি। তাই পুনরায় শুরু করলেন ধাঁধা সমাধান। কিউ আর কোডগুলোর মাধ্যমে এরিকসন আরো দুটো ছবির ধাঁধার সন্ধান লাভ করলেন। শুরুর দিকে তিনি বিরক্ত হলেও, এবার তিনি খুশি হলেন। কারণ, ততদিনে তিনি সিকাডার নেশায় ডুবে গেছেন। স্টেগানোগ্রাফির মাধ্যমে দুটো ছবি থেকে বেরিয়ে আসলো দুটো গুপ্ত বার্তা। এর মধ্যে একটি ছিল উইলিয়াম গিবসন রচিত ‘আগ্রিপ্পা’ কবিতার একটি পঙক্তি। এরিকসন অবাক হলেন কারণ এই বার্তার মাধ্যমে তিনি কোনো সংখ্যা পেলেন না। এখন কী উপায়?
তিনি দুশ্চিন্তায় নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন। তাহলে কি এখানেই থেমে যাবে তার যাত্রা? অনিশ্চয়তার মাঝে একপর্যায়ে তিনি স্রেফ পরীক্ষা করার জন্য পূর্ব বইয়ের সহায়ক চাবি ব্যবহার করলেন এই পঙক্তির উপর। হঠাৎ করে তিনি যেন হারানো আশা ফিরে গেলেন। সেই চাবির মাধ্যমে বেরিয়ে আসলো এক নতুন লিংক। কিন্তু সেই লিংকে প্রবেশ করতে প্রয়োজন টর ব্রাউজার। তিনি বেশ উৎসাহ নিয়ে টর ব্রাউজার দিয়ে সেই লিংকে প্রবেশ করতেই বুঝে গেলেন ‘গেম ওভার’! তিনি হেরে গেছেন। হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকা এরিকসনের সামনের মনিটরে ভেসে উঠলো, “আমরা সেরা বুদ্ধিমানকে চেয়েছিলাম। তার অনুসারীকে নয়।”
সিকাডা ৩৩০১ এর প্রথমদিকে মাত্র কয়েকজনকে সেই লিংকে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। তাই সময়ের দৌড়ে হেরে গেলেন জুয়েল এরিকসন। দীর্ঘ ২১ দিন যাবৎ তার সিকাডা যাত্রার তাই এখানেই যবনিকাপাত হলো।
পর্দার ওপারে
এরিকসন না পারলেও অনেকেই সেই টর ব্রাউজার লিংকে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। এই প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের সেই একজন হলেন Tekknolagi (তেকনোলাজি) নামক এক ছাত্র। এই নাম ব্যবহার করে তিনি সিকাডা ৩৩০১ এর রহস্যজট খুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমাদের পরবর্তী যাত্রা শুরু হচ্ছে তেকনোলাজির সাথে। টর ব্রাউজারে সেই লিংকে প্রবেশ করার পর নতুন ছবিধাঁধার সন্ধান পাওয়া যায়। সেই ছবিতে সিকাডা ৩৩০১ একটি বইয়ের কথা ইঙ্গিত করছিলো। সেটি হচ্ছে উইলিয়াম ব্লাক রচিত ‘দ্য ম্যারেজ অফ হেভেন এন্ড হেল’। সেখান থেকে সহায়ক চাবি বের করে তিনি আরেকটি টর ব্রাউজার লিংকের সন্ধান পান। এরপর আরো কয়েক ধাপে আরো কয়েকটি ধাঁধা সমাধানের পর তার নিকট একটি MIDI ফাইল প্রেরণ করা হয়। এতদূর চলে আসা তেকনোলাজির নিকট এই ফাইলের সংকেত ভেঙে লুকানো বার্তা বের করা কোনো কষ্টের কাজ ছিল না। এই ফাইল থেকে তিনি ASCII কোডে রূপান্তরিত আরেকটি বার্তা পেলেন। তাকে সিকাডা থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো এই কোডটি একটি নির্দিষ্ট জিমেইল ঠিকানায় প্রেরণ করতে হবে। তিনি তাই করার পর তাকে সুসংবাদ প্রেরণ করা হলো– “আর কোনো ধাঁধা নেই। তুমি বিজয়ী হয়েছো।”
এর সাথে তাকে একটি গোপন পাসওয়ার্ড সম্বলিত একটি অদ্ভুত মেইল আইডি প্রদান করা হয়। সেটির সাহায্যে তেকনোলাজি এবং অন্যান্য বিজয়ীরা ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে সর্বপ্রথম সিকাডা সংঘের সাথে বৈঠক করতে সক্ষম হন। কিন্তু যেহেতু পুরো বৈঠকটি ডার্ক ওয়েবের সুরক্ষিত সার্ভারে সম্পন্ন হয়েছিলো, তাই কারো চেহারা দেখার সুযোগ মেলেনি তার। কিন্তু কী হয়েছিলো সেখানে? এর উত্তরে তেকনোলাজি জানান,
“সেখানে বেশ কিছু লোক ছিল। আমি জানি না তারা কারা কিংবা কী চায়। সবকিছুই কেমন অদ্ভুত লাগছিলো। তারা যা বলছিলো, তা আমরা নিজেরাও ভালোভাবে বুঝতে পারছিলাম না।”
শুধু তেকনোলাজি একা নন, এই প্রতিযোগিতার প্রথম বিজয়ী মার্কাস ওয়েনারও একই মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। তারা কী চায় কিংবা কেন চায়, তা জানা যায়নি। পরবর্তীতে এক ইমেইলের মাধ্যমে তারা বিজয়ীদের সাথে যোগাযোগ করে। সেই ইমেইলের সারমর্ম ছিল,
“আমরা একটি আন্তর্জাতিক সংঘ যাদের কোনো নাম, চিহ্ন কিংবা পরিচয় নেই। আমাদের সদস্যদের কোনো তালিকাও আমরা তৈরি করিনি। আমাদের কোনো বিজ্ঞাপন নেই। তোমরা হয়তো ভাবছো আমরা কী করতে চাচ্ছি…শুধু এতটুকুই বলবো, আমরা তোমাদের মতো মেধাবী এবং চিন্তাবিদ। আমরা ইন্টারনেট মুক্তিতে বিশ্বাস করি। আমরা কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছি এবং তোমরা সম্মতি প্রদান করলে আমাদের পরবর্তী প্রকল্পের অংশীদার হতে পারবে।”
ইমেইল পেয়ে অনেকেই সরে দাঁড়ালেন। মনে হচ্ছিলো কোনো সফটওয়্যার বানানোর জন্য কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে। তাই অনেকেই হতাশ হয়ে পড়লেন। তবে যারা সম্মতি প্রদান করেছিলেন, তাদের কী হয়েছিলো? অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, তাদের সাথেও সিকাডা ৩৩০১ এর কেউ পুনরায় যোগাযোগ করেনি। নিমিষেই যেন হাওয়া হয়ে গেলো তারা!
এক বছর এক দিন পর
এই ঘটনার ঠিক এক বছর এক দিন পরেই পুনরায় সবাইকে অবাক করে দিয়ে আরো কয়েক ডজন জটিল রহস্যজট নিয়ে হাজির হলো ‘সিকাডা ৩৩০১’ এর দ্বিতীয় ধাঁধা। ধাঁধার শুরুতে একটি শুভেচ্ছা বার্তায় লেখা ছিল,
“হ্যালো। তোমাদের অবতার সন্নিকটে। তোমাদের তীর্থযাত্রার শুরু এখান থেকেই। সকল রহস্যের উত্তর মেলবে ধাঁধার শেষে। শুভ কামনায়, ৩৩০১”
অনেকেই চটে গেলেন। কিন্তু এবারও বহু মানুষ এই ধাঁধার নেশায় মেতে উঠলেন। প্রথম ধাঁধার মতোই তা বেশ রোমাঞ্চকর ছিল বলে মন্তব্য করেন ধাঁধা সমাধানকারীদের একজন। এই ধাঁধায় বিজয়ী একজনের ছদ্মনাম Nox Populi (নক্স পপুলি)। কিছুদিন পর এক টকশোতে প্রথম ধাঁধার বিজয়ী মার্কাস ওয়েনার জানান, তার সাথে নক্স পপুলি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। নক্স পপুলির মতে, এবারও তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। এক অজ্ঞাত কারণে তারা হঠাৎ করে বিজয়ীদের সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। এই অদ্ভুত আচরণের কারণ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত বিশেষজ্ঞরা কিছুই জানতে পারেননি।
পুরো ঘটনা এখানে শেষ হলেও হয়তো হতো। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরবর্তী বছরে পুনরায় নতুন ধাঁধা নিয়ে হাজির হয় সিকাডা ৩৩০১। এখন পর্যন্ত ২০১৪ সালে প্রকাশিত সেই ধাঁধার কোনো বিজয়ীর নাম জানা যায়নি। প্রথম ধাঁধার সমাধানকারী জুয়েল এরিকসন আর কোনো ধাঁধায় অংশ নেবেন না বলে জানিয়েছেন। জুয়েল এরিকসন জানান, তার আইটি সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার জন্য স্টেগানোগ্রাফি, ক্রিপ্টোগ্রাফির কাজগুলো করা খুব সহজ ছিল। কিন্তু অন্যান্য সাহিত্যভিত্তিক অংশে তাকে বেশ ভুগতে হয়েছিলো। তাই এবার তিনি আর চেষ্টা করবেন না। হয়তো এরিকসনের মতো অনেকেই বৃথা সময় অপচয়ের ভয়ে সিকাডা ৩৩০১ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
ইন্টারনেট আধুনিক যুগের এক বিস্ময়। আর সিকাডা ৩৩০১ ইন্টারনেটের জগতের অন্যতম প্রধান বিস্ময়। এর পেছনে কারা আছে, কী তাদের উদ্দেশ্য কিংবা কেন তারা হঠাৎ করে চুপ হয়ে যায়- এসব প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। কিন্তু অনেকের মতে, হয়তো এসব রহস্যময় অদ্ভুত আচরণের কারণেই সিকাডা ৩৩০১ বহুকাল পর্যন্ত ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় রহস্যজট হিসেবে টিকে থাকবে।
ফিচার ইমেজ: Steemit