স্মার্টফোন ফটোগ্রাফি এখন হালের ক্রেজ। দিনের বেলায় ঠিকঠাক ছবি আসলেও স্মার্টফোন দিয়ে রাতের বেলায় অপেক্ষাকৃত স্বল্প আলোতে সুন্দর ছবি তোলা কিন্তু খুব একটা সহজ বিষয় নয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বল্প আলোতে তোলা ছবিতে নয়েজ আসে, ছবি কালো হয়ে যায়, অনেক ক্ষেত্রেই আবার বাড়তি আলো চলে আসে কিংবা মোশন ব্লার সমস্যা চলে আসে। তাই রাতে স্বল্প আলোতে তোলা ছবি বেশিরভাগ সময়ই আমাদের খুব একটা সন্তুষ্ট করতে পারে না।
অথচ কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো খেয়াল রাখলে আমরা আমাদের স্মার্টফোনটি থেকে রাতের বেলায় কিংবা অপেক্ষাকৃত স্বল্প আলোতেও চমৎকার ছবি পেতে পারি। সে সমস্ত কারিকুরি জেনে আপনিও হতে পারেন দারুণ একজন স্মার্টফোন ফটোগ্রাফার। রাতের বেলা বা স্বল্প আলোতে ছবি তোলা, অর্থাৎ ফটোফটোগ্রাফির ভাষায়, লো লাইট স্মার্টফোন ফটোগ্রাফির নানা দিক নিয়েই আজকের আয়োজন।
নাইট মোড
আধুনিক স্মার্টফোনগুলোতে স্বল্প আলোতে কিংবা রাতের বেলায় অপেক্ষাকৃত ভালো মানের ছবির জন্য ক্যামেরা অ্যাপে সাধারণত আলাদা একটি ক্যামেরা মোড দেওয়া থাকে। ব্র্যান্ডভেদে এই মোডের ভিন্ন ভিন্ন নাম হলেও এদের কাজ মোটামুটিভাবে একই রকম।
গুগল পিক্সেল স্মার্টফোনে একে ‘নাইট সাইট’ বলা হয়ে থাকে। স্যামসাং স্মার্টফোনগুলোর ক্ষেত্রে একে ‘ব্রাইট নাইট’, হুয়াওয়ের ক্ষেত্রে ‘নাইট মোড’ এবং ওয়ান প্লাস স্মার্টফোনগুলোতে একে ‘নাইটস্কেপ’ বলা হয়।
ব্যবহারকারীর স্মার্টফোনে যদি এরকম কোন নাইট মোড থেকে থাকে, তবে স্বল্প আলোতে সেরা ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে এই অপশনটি ব্যবহার করতে পারেন।
‘নাইট সাইট’ মোড মূলত ছবির ক্ষেত্রে সাধারণভাবে এইচডিআরের মতো করে কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে ক্যামেরা সেন্সরটি ভিন্নভিন্ন এক্সপোজারে বেশ কয়েকটি ছবি নিয়ে পরবর্তীকালে এই ছবিগুলো থেকে ডিটেইল একত্রিত করে চূড়ান্ত একটি ছবি প্রদান করে।
কৃত্রিম আলোর ব্যবহার
রাতের বেলায় স্মার্টফোনে ছবি তোলার ক্ষেত্রে কৃত্রিম আলো কিংবা স্মার্টফোনের ফ্ল্যাশলাইটটি তোলা ছবির গুণগত মান নষ্ট করার জন্য অনেকাংশেই দায়ী। ফ্ল্যাশলাইট ছবি তোলার সময়ে তীব্র এক হাইলাইট তৈরি করে ছবির ডিটেইলের ক্ষতি করে থাকে। তাই কম আলোতে ছবি তুলতে স্মার্টফোনের ফ্ল্যাশলাইট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাড়তি সর্তকতা অবলম্বন জরুরী।
এক্ষেত্রে কম বা স্বল্প আলোতে প্রথমে ফ্লাশলাইট ছাড়াই ছবি তুলে ছবির গুণগতমান যাচাই করে দেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে পরিবেশ থেকে একদমই যদি আলো পাওয়া না যায়, তবে সেক্ষেত্রে সতর্কভাবে ফ্ল্যাশলাইট চালু করে ছবি তোলা উচিত।
এক্ষেত্রে ছবি তোলার ক্ষেত্রে বাড়তি একটি ফ্ল্যাশলাইট ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ। ভালো ফলাফল পেতে ওএলইডি ফ্ল্যাশলাইট ব্যবহার করা উচিত। বর্তমানে ওএলইডি ফ্ল্যাশ লাইটগুলো বেশ সাশ্রয়ী এবং এই ফ্ল্যাশলাইটগুলো ব্যবহার করে রাতের বেলায় বেশ ভালো মানের ছবি তোলা যায়।
কম আলোর কিংবা রাতের বেলায় স্মার্টফোনে ব্যবহারের জন্য এ ধরনের একটি প্রোফেশনাল মানের ফ্ল্যাশলাইট হচ্ছে মেইকি এস১৫০।
স্বল্প আলোতে বা রাতের বেলায় এই ধরনের ফ্ল্যাশলাইটের ব্যবহার ছবি তোলায় ব্যবহারকারীকে বাড়তি স্বাধীনতা দিতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো দেয়ালে ফ্ল্যাশলাইটের আলোর প্রতিফলন ঘটিয়ে কিংবা সাথে দেওয়া ডিফিউজার (diffuser) ব্যবহার করে অপেক্ষাকৃত নমনীয় আলো পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে অনেকদিনের নিরন্তর প্রচেষ্টাই একজন আগ্রহী স্মার্টফোন ফটোগ্রাফারকে রাতের বেলায় ছবি তোলার ক্ষেত্রে দক্ষ করে তোলে।
ম্যানুয়াল মোডের ব্যবহার
স্মার্টফোনে ছবি তোলার সময়ে দিনে অটো মোড থেকে ঠিকঠাক ছবি পাওয়া গেলেও বিপত্তি ঘটে মূলত রাতের বেলায়। স্বল্প আলোতে ছবি তোলার ক্ষেত্রে স্মার্টফোন ক্যামেরার অটোমোড কখনোই পুরোপুরি কার্যকর নয়, কেননা এক্ষেত্রে অটোমোডে স্মার্টফোন ক্যামেরা সেন্সর ঠিকঠাকভাবে এক্সপোজার নির্ধারণ করতে পারে না। এক্ষেত্রে ক্যামেরা অ্যাপ্লিকেশনটির ম্যানুয়াল মোড বেশ ভালো ফলাফল দিতে পারে।
আজকাল মোটামুটি ভালো স্মার্টফোনগুলোর ক্যামেরায় সাধারণত ম্যানুয়াল মোড দেওয়া থাকে। এই সেটিংস থেকে অ্যাপার্চার, আইএসও এবং শাটারস্পিড পছন্দমত নির্ধারণ করে নেওয়া সম্ভব। এই তিন সেটিংস্-কে একত্রে ‘এক্সপোজার ত্রিভূজ’ বলা হয়ে থাকে।
আলো বাড়িয়ে-কমিয়ে নেওয়া, ফোকাসের তারতম্যসহ বেশকিছু বিষয় এই সেটিংস থেকে পছন্দমত নির্ধারণ করে নিলে অটো মোডের থেকে অনেক ভালো মানের ছবি পাওয়া সম্ভব।
বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ভালো ছবি তোলার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে- প্রকৃতিতে পাওয়া আলো ছবি তোলার বিষয়বস্তুর উপর যথাযথভাবে এক্সপোজ করা।
এই কাজটি প্রাথমিকভাবে আইএসও নিয়ন্ত্রণ এবং শাটারস্পিড কমিয়ে-বাড়িয়ে করা যায়। এক্ষেত্রে ঠিক মাত্রার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কেননা আইএসও বেশি বাড়াতে গেলে একদিকে যেমন ছবিতে ডিজিটাল নয়েজ আসতে পারে, আবার শাটারস্পিড সঠিক না হলে কাঙ্ক্ষিত ছবিতে মোশন ব্লার আসতে পারে।
ভালো ছবি পাওয়ার জন্য স্মার্টফোন ফটোগ্রাফারের নিজস্ব অনুভূতিকে কাজে লাগাতে হবে। শাটারস্পিডের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ছবি তোলার বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে।
ছবি তোলার বিষয়বস্তুটি যদি কোন স্থির ব্যক্তি বা বস্তু হয়ে থাকে, তবে এক্ষেত্রে কয়েক সেকেন্ড ধরে শাটার নিয়ন্ত্রণ করা ছবি তোলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, স্মার্টফোনটি যেন কোনক্রমেই না নড়ে। এক্ষেত্রে ভালোমানের স্মার্টফোন ট্রাইপড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।
অধিকাংশ স্মার্টফোন ক্যামেরার অ্যাপার্চার নির্দিষ্ট করে দেওয়া থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু আধুনিক স্মার্টফোনে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ- স্যামসাং এবং ওপো ব্র্যান্ডের কয়েকটি স্মার্টফোনের কথা বলা যায়।
স্মার্টফোনের অ্যাপার্চার যদি পরিবর্তনযোগ্য হয়, তবে ছবি তোলার ক্ষেত্রে যথাসম্ভব চওড়া প্রেক্ষাপট ধারণের চেষ্টা করা উচিত। এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত যে, বড় অ্যাপার্চার অপেক্ষাকৃত ছোট সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা হয়। F1.8 এক্ষেত্রে F2.8 থেকে প্রশস্ত/বড় অ্যাপার্চার।
র (RAW) মোডে ছবি তোলা
ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোনে সাধারণত র ফরম্যাটে ছবি তোলার সুযোগ থাকে। ছবি তোলার ক্ষেত্রে র ইমেজ (Raw Image) হচ্ছে মূলত ক্যামেরা অ্যালগারিদম পর্যায়ে সম্পাদনাবিহীন এক ধরণের অসংকুচিত ছবি। র’ ছবিতে ক্যামেরা সেন্সরে প্রাপ্ত ছবির সব ধরণের তথ্য অটুট থাকে।
সাধারণ ছবি থেকে এই ধরনের ছবির ফাইল অনেক বড় হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ছবির কোন ধরনের গুণগত মান কমে না, বরং এ ধরনের ছবি সম্পাদনা বা এডিটের ক্ষেত্রে বাড়তি অনেক সুবিধা পাওয়া যায়।
স্মার্টফোন ক্যামেরা সমর্থন করলে স্বল্প আলোতে ছবি তোলার ক্ষেত্রে এই মোডটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণ ছবির থেকে অনেক বেশি ডিটেইল-সম্পন্ন ছবি পাওয়া যায় এবং পরবর্তীকালে এই র’ ফরম্যাটের ছবি সঠিকভাবে এডিট করে সাধারণ মোডের থেকে অপেক্ষাকৃত মানসম্পন্ন ছবি পাওয়া যায়।
ছবি তোলা পরবর্তী সম্পাদনা বা এডিট
মানসম্পন্ন ছবির ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ছবি তোলাটা যেমন জরুরী, ঠিক তেমনি ছবি তোলা পরবর্তী ছবির সঠিক সম্পাদনা বা এডিট করাটাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কম আলোতে কিংবা রাতের বেলায় তোলা ছবি সঠিকভাবে সম্পাদনা করা ভালো মানের ছবির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক ভূমিকা পালন করে।
অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনে কিংবা আইওএসে ছবি সম্পাদনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু ভালো মানের অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্নাপসীড, অ্যাডোবি ফটোশপ, লাইটরুম, পিক্সআর্ট ইত্যাদি।
স্ন্যাপসিডসহ অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশনে ছবি সম্পাদনার সময়ে এক্সপোজার, লাইট ইত্যাদি দিকগুলো ঠিক করে নেওয়া যায়। এডিট বা ছবি সম্পাদনের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোকে ‘টিউনিং’ বলা হয়।
মানসম্পন্ন ছবি পেতে বিশেষ করে রাতের বেলায় তোলা ছবি ঠিক করতে এডিট করার অ্যাপটি থেকে এই টিউনিংগুলো ঠিকঠাকভাবে করে নেওয়া উচিত। তবে এক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে, কেননা এক্ষেত্রে সম্পাদনায় ত্রুটি হলে ছবির গুণগত মান নষ্ট হয়ে যেতে পারে।