১৭ ডিসেম্বর, ১৯০৩; কুয়াশায় ঢাকা শীতের এক সকালের কথা। ইতিহাস সৃষ্টিকারী একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে আজকের এই সকালটিতে। স্থান নর্থ ক্যারোলাইনার কিটি হকের বালুময় সমুদ্র সৈকত। সময় সকাল ১০টা ৩৫ মিনিট। ডিসেম্বরের তীব্র শীতের সকাল। আর তাই এ তীব্র শীত উপেক্ষা করে হাতেগোনা অল্প কিছু লোকই উপস্থিত হয়েছেন ঘটনাটি দেখতে। ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনাটি ঘটাতে যাচ্ছেন দুই সহোদর। ইতিহাসে যারা রাইট ব্রাদার্স নামে বেশি পরিচিত- অরভিল রাইট এবং উইলবার রাইট। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি ইঞ্জিন চালিত উড়োজাহাজ ওড়াতে যাচ্ছেন তারা!
বলছিলাম রাইট ব্রাদার্সের সেই ঐতিহাসিক ফ্লাইটটির কথা। মাত্র ১২ সেকেন্ডের একটি ফ্লাইট আর ২৬০ মিটার দূরত্ব অতিক্রম, আপাতদৃষ্টিতে অতি সামান্য এই ঘটনাটি ভবিষ্যৎ পৃথিবীর চেহারাই পাল্টে দেয়। প্রাচীন চীন দেশের সামান্য ঘুড়ি থেকে যার শুরু, তারপর স্পেনের আব্বাস ইবনে ফিরনাস, ফিরনাস থেকে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিফল ডিজাইন, তারপর উসমানীয় সালতানাতের সেলেবী ব্রাদার্স (হেজারাফেন আহমেদ সেলেবী এবং লাগারী আহমেদ সেলেবী), জর্জ ক্যালী, অটো লিলিয়েন্থালের হাত ধরে ভারতের শিভকার তালপাদে হয়ে সেই উড়োজাহাজই রাইট ব্রাদার্সের হাতে পূর্ণতা পায়। মানুষের অদম্য আকাঙ্ক্ষার কাছে পরাজয় হয় সময়ের।
সেই থেকে শুরু। এরপর আরো উন্নত ডিজাইনের উড়োজাহাজের আবিষ্কার হয়ে চলেছে। রাইট ব্রাদার্সের সফলতা বেশ ভালোভাবেই প্রচার পায়। আর তাদের এ সফলতায় উৎসাহী হয়ে আরো অনেকেই এ ব্যাপারে আগ্রহী হন, চলতে থাকে এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা। কার থেকে কে বেশি উন্নত আর ভালো ডিজাইনের এয়ারক্রাফট বানাতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা। এ সময় ধনী ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন কোম্পানী আর পত্রপত্রিকা উৎসাহ দেয়ার জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে শুরু করেন। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের বেশ ভালো অঙ্কের অর্থ পুরষ্কার দেয়া হতো। এরকম একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ডেইলি মেইল পত্রিকাটি। ১৯০৯ সালের দিকে ডেইলি মেইল ১,০০০ পাউন্ডের একটি পুরষ্কার ঘোষণা করে সেই ব্যক্তির জন্য, যিনি উড়োজাহাজে করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে পারবেন। লুইস ব্লেরিওট নামের একজন বৈমানিক সর্বপ্রথম উড়োজাহাজে করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে এ পুরষ্কারটি জিতে নেন। পুরষ্কারটি বাংলাদেশী টাকায় সেই সময়ের হিসেবে প্রায় ১ লাখ টাকার সমপরিমাণ!
এ ধরনের প্রতিযোগিতা ঘন ঘন আয়োজন করা হতে থাকে, আর তাদের দেয়া পুরষ্কারের এ টাকাটা যেন আরো উন্নত ডিজাইনের এয়ারক্রাফট আবিষ্কারের প্রতিযোগিতার আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। কারণ পুরষ্কার জিততে পারলে আরো উন্নত ডিজাইনের উড়োজাহাজ তৈরির জন্য বাজেট পাওয়া যেত। তবে সত্যিকার অর্থে উড়োজাহাজ আধুনিক যুগে প্রবেশ করে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে। যুদ্ধক্ষেত্রে বিমান দিয়ে খুব সহজেই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সফলতার সাথে শত্রুঘাঁটিতে আক্রমণ করা যেতো। আবার শত্রুর গোপন তথ্যও সংগ্রহ করা যেতো, যার ফলে জেনারেল আর রাষ্ট্রনায়করা উড়োজাহাজের উন্নতিতে অনেকটা প্রতিযোগিতার সাথেই মনোনিবেশ করেন। ব্যাপারটা আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শুধুমাত্র ব্রিটেনের তৈরি বিমানের সংখ্যা দেখে। এ যুদ্ধে ব্রিটেন ৭৫,০০০ এয়ারক্রাফট তৈরি করে, যার ভেতরে যুদ্ধ শেষে মাত্র ৩,৩০০টি অক্ষত ছিলো, আর বাকিগুলো যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়!
শুরুর দিকে উড়োজাহাজ কিন্তু শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর কাজের জন্যই ব্যবহার করা হতো। জনসাধারণের জন্য উড়োজাহাজ ব্যবহার করা যেতে পারে, এই ধারণাটিই তখন কারো মাথায় আসেনি। এমনকি রাইট ব্রাদার্সও এর বাইরে যেতে পারেননি। ব্যাপারটি উইলবার রাইটের একটি উক্তিতে পরিষ্কার হয়। তিনি বলেন,
“আমি মনে করি না যে উড়োজাহাজ ভবিষ্যতে বিশ্বের স্থল যোগাযোগের বিকল্প হবে। আমি বিশ্বাস করি এটা শুধু বিশেষ উদ্দেশ্যে সীমিত থাকবে। এটা যুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। এটা ভবিষ্যতে ডাক-যোগাযোগের কাজেও ব্যবহার হতে পারে।”
তবে শুরুর দিকে ব্যাপারটা এমন মনে হলেও, জনসাধারণ যে একেবারেই উড়োজাহাজ ব্যবহার করেনি, এটি পুরোপুরি ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহন শুরু হয়ে গিয়েছিলো, তাও আবার উইলবার রাইটের উপরের উক্তির নয় বছরের মাথাতেই!
১ জানুয়ারী, ১৯১৪; এ দিনটিও উড়োজাহাজের ইতিহাসের এক স্মরণীয় দিন। কারণ এ দিনেই প্রথম যাত্রীবাহী বাণিজ্যিক বিমানটি আকাশে ডানা মেলে। ২৩ মিনিটব্যাপী পরিচালিত এ ফ্লাইটটি সেইন্ট পিটার্সবার্গ থেকে যাত্রা শুরু করে টাম্পাতে গিয়ে শেষ করে তার উড্ডয়ন। ২১ মাইলের এ যাত্রার পুরোটাই ছিলো পানির ওপর দিয়ে, আর এ সময় বিমানটি মাত্র ১৫ ফুট অল্টিচ্যুড বজায় রেখেছিলো।
ফ্লাইটটি পরিচালনা করা হয় Benoist XIV মডেলের উড়োজাহাজ দিয়ে, যা আসলে ছোট বাইপ্লেন জাতীয় ফ্লাইং বোট। বাইপ্লেন বলতে উপরে এবং নিচে দুটি পাখাসমৃদ্ধ উড়োজাহাজকে বোঝায়। এ ফ্লাইটটির পাইলট ছিলেন টনি জানুস।
দুই সিটের এ বিমানটিতে পাইলটের পাশে মাত্র একজন যাত্রীই আরোহণ করতে পেরেছিলেন। আর বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী এই উড়োজাহাজ ভ্রমণে সৌভাগ্যবান যাত্রীটি কে হবেন, সেটা নিয়েও ঘটে যায় এক মজার ঘটনা।
পৃথিবীর প্রথম যাত্রীবাহী বিমানযাত্রার যাত্রী হিসেবে এই ফ্লাইটটিতে অনেকেই উঠতে চেয়েছিলেন। কেউই সুযোগ হারাতে চাচ্ছিলেন না। কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পেরে তাই আয়োজন করা হয় নিলামের! নিলামে যিনি বেশি ভাড়া দিতে পারবেন, তিনিই হবেন এই ফ্লাইটের আরোহী। এই নিলামে জয়ী হয়েছিলেন আবরাম ফিল নামের এক ব্যক্তি। তিনি সেইন্ট পিটার্সবার্গের প্রাক্তন একজন মেয়র ছিলেন। এ ফ্লাইটের আরোহী হতে আবরাম ফিলকে গুনতে হয় মোট ৪০০ ডলার, যা আজকের এই সময়ে প্রায় ৫,০০০ ডলারের সমমূল্যের। অর্থাৎ মাত্র ২৩ মিনিটের এ ফ্লাইটটির যাত্রী হতে মেয়র সাহেবকে বর্তমান সময়ের হিসেবে বাংলাদেশি টাকায় গুনতে হয়েছিলো প্রায় ৪ লাখ টাকা! তার খরচের ব্যাপারটি দেখলেই বোঝা যায় বিশ্বের প্রথম যাত্রীবাহী বিমানের যাত্রী হতে তিনি কতটা আগ্রহী ছিলেন।
বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহনের ব্যাপারটি এই সাড়া জাগানো ঘটনার পর বেশ ভালোভাবেই শুরু হতে পারতো। কিন্তু ইতোমধ্যে শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর। বিশ্বযুদ্ধের উত্তেজনাময় সময়গুলোতে এ ব্যাপারগুলো নিয়ে মাথা ঘামানোর খুব একটা সুযোগ পাওয়া যায় না। তবে মন্দের ভালো হিসেবে এ বিশ্বযুদ্ধই আবার বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের জন্য এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে দেয়।
যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য এ সময় অসংখ্য যুদ্ধবিমান তৈরি করা হয়। যুদ্ধশেষে দেখা যায় এ বিপুল সংখ্যক বিমান রাতারাতিই অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়। এদের সার্ভিসে রাখতে হলে বিশাল পরিমাণের বাজেটের প্রয়োজন, যা আবার অর্থনৈতিকভাবে খুব একটা লাভজনক হবে না। তাই এসব যুদ্ধবিমানকেই যাত্রীবাহী বিমানে পরিণত করার চিন্তা মানুষের মাথায় আসে।
বিশ্বযুদ্ধ শেষে অর্থাৎ ১৯১৯ সালেই এ ধরনের যাত্রীবাহী ফ্লাইট পরিচালনা শুরু হতে থাকে। বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম যাত্রীবাহী বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনা করা হয় একটি বোমারু বিমান দিয়ে! এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট পিএইচ-৪ বোমারু বিমানটি লন্ডন থেকে যাত্রা শুরু করে প্যারিসে তার যাত্রা শেষ করে।
এরপর আসে যাত্রীবাহী এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠার ব্যাপার। প্রথম যাত্রীবাহী বাণিজ্যিক এয়ারলাইন শুরু হয় ১৯২০ সালে, নাম দেয়া হয় রয়্যাল ডাচ এয়ারলাইন্স, যদিও ১৯০৯ সালেই জার্মানি এয়ারশিপের মাধ্যমে এ ধরনের যাত্রীবাহী বাণিজ্যিক এয়ারলাইন পরিচালনা করতো। পিএইচ-৯ মডেলের উড়োজাহাজ দিয়ে পরিচালিত তাদের এ ফ্লাইটের প্রথম যাত্রী ছিলেন মাত্র ৩ জন। এ ফ্লাইটটি তার যাত্রা শুরু করে নেদারল্যান্ডের আমস্টারড্যাম থেকে এবং শেষ করে লন্ডনে। এ সময় উড়োজাহাজগুলোর উপরের দিকটা ছিলো খোলা, তাই তীব্র বাতাস আর ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য যাত্রীদের মোটা গরম পোশাক পরিধান করতে হতো। ১৯২৭ সালে শুরু হয় প্যান আমেরিকান ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজের ফ্লাইট। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে কিউবার হাভানা পর্যন্ত তাদের ফ্লাইট পরিচালনা করতো।
এভাবেই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে যাত্রী পরিবহনের জন্য এয়ারলাইন্সের সংখ্যা আর বাড়তে থাকে তাদের সেবার মানও। আজ, সে সময় থেকে প্রায় এক শতাব্দী পর, আমরা এখন খুব সহজেই একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে পারি, আগের থেকেও দ্রুত আর আগের থেকেও বেশ আরামে। এমনকি যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ খরচ করতে পারলে যাত্রার মাঝেই একজন যাত্রী বিমানে সেরে নিতে পারেন তার গোসলটিও!