হারুতো; ২১ বছর বয়সী এক সুদর্শন জাপানি তরুণ। একদিন বিকেলে লোকে লোকারণ্য কম্যুটার ট্রেনে চেপে বাসায় ফিরছিল সে। এবং তখনই সূচনা ঘটল এক মস্ত বিড়ম্বনার, যার উৎস তার প্রেমিকা মানাকা। আগের রাতে কেন সে কথার মাঝখানে হুট করে চলে গিয়েছিল, এ নিয়ে এখনও রেগে আছে মানাকা। তার মনে সন্দেহও জন্ম নিয়েছে, হারুতো হয়তো এখন আর তাকে আগের মতো ভালোবাসে না। তাই সে বারবার হারুতোকে বলতে লাগল, বলো আমাকে ভালোবাসো কি না, নইলে আজই আমাদের সম্পর্কের সমাপ্তি। সম্পর্ক বাঁচাতে মরিয়া হারুতো তাই লাজ-লজ্জা ভুলে, ট্রেনের কামরায় শত শত মানুষের সামনেই মানাকাকে বলতে শুরু করল, ভালোবাসি! ভালোবাসি! ভালোবাসি! এ কথা বলে প্রেমিকাকে ঠান্ডা করার পর, তাড়াতাড়ি তাকে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল হারুতো।
পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল থেকে অনেকেই মনে করতে পারেন, হারুতো হয়তো মানাকার সাথে মোবাইলে কথা বলছিল, সেই মোবাইলটিই পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে। আসলে তা নয়। বাস্তবিকই হারুতো তার প্রেমিকাকে পকেটে ঢুকিয়েছে। কারণ তার প্রেমিকার বাস মোবাইল সদৃশ নিনতেন্দো ডিএস প্লেয়ারের ভিতরেই। লাভ প্লাস নামক একটি ভিডিও গেমের তিনটি চরিত্রের মধ্যে একটি সে। এবং তার সাথেই একদম সত্যিকারের ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছে সে।
অনেকের কাছেই উপরের ঘটনাটিকে নিছকই কাল্পনিক, লেখকের উর্বর মস্তিষ্কের উৎপাদন, কিংবা নেহাতই বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু মোটেই তা নয়। যদি কোনো অভাবনীয় কিছু না ঘটে, তাহলে ২০৬০ সালের মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা বর্তমানের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কমে যাবে, এবং তার মধ্যে একটি প্রধান কারণ হলো জাপানি পুরুষদের বাস্তব জীবনে প্রেমিকা খুঁজে নেয়ার প্রতি উদাসীনতা ও ভার্চুয়াল প্রেমিকার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা।
এই ধরনের জাপানি পুরুষদেরকে বলা হয়ে থাকে ওটাকু। এরা মাঙ্গা ও এনিমে ভালোবাসে, সারাদিন কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকতে ভালোবাসে, এবং অনেক সময় যৌনতার প্রতি খুবই কম আগ্রহ দেখায়। তাই তাদের যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য কোনো বাস্তব সঙ্গিনীর প্রয়োজন পড়ে না, বরং তারা গেমিং কনসোলের ছোট্ট স্ক্রিনে একটি কাল্পনিক প্রেমিকা চরিত্রকে পেয়েই খুশি থাকে। তাছাড়া এটিকেই তাদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়, কেননা মাঙ্গা ও এনিমের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণের ফলে তাদের জগৎ সেসবের কাল্পনিক চরিত্রদের কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে।
ভার্চুয়াল প্রেমিকার হদিস মিলবে লাভ প্লাসে
শুধু ওটাকু নয়, বরং সব ধরনের জাপানি পুরুষই, যাদের কাছে রক্তমাংসের প্রেমিকার চেয়ে ভার্চুয়াল প্রেমিকা বেশি আরাধ্য, তাদের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে লাভ প্লাস গেমটি। ২০০৯ সালে প্রথম নিনতেন্দোর জন্য তৈরি করা হয় গেমটি, এবং ২০১১ সালে আইফোনের জন্য এর আইওএস সংস্করণও মুক্তি দেয়া হয়। গেমটির ডেভেলপার ও প্রকাশক কোনামি, আর প্রযোজক আকারি উচিডা।
যদিও বৈধভাবে জাপানের বাইরে গেমটি পাওয়া যায় না, কিন্তু এর অনেক পাইরেটেড সংস্করণই তৈরি হয়েছে, যেগুলো জাপানের বাইরে থেকেও ডাউনলোড করা যায়। মূল গেমটি জাপানি ভাষায় তৈরি করা হলেও, আমেরিকান সংস্করণে বেশ কিছু টেক্সটের ইংরেজি অনুবাদ করে দেয়া হয়েছে, যে কারণে আমেরিকান অনেক তরুণের কাছেও গেমটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
গেমটি কেমন?
গেমটির মূল থিম জটিল কিছুই নয়। খুবই সহজ-সরল কাহিনী গেমটির। একজন খেলোয়াড়ই গেমটি খেলতে পারবে, এবং সে নিজেই নিজের নামও সেট করতে পারবে। গেমের কাহিনী অনুযায়ী, সে হাই স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, সদ্যই তোয়ানো হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে। স্কুলের পাশাপাশি সে লাইব্রেরি কমিটি, টেনিস ক্লাবে যোগ দেয়, এবং একটি ফ্যামিলি রেস্টুরেন্টে পার্ট-টাইম জবও জুটিয়ে নেয়।
গেমটিতে তিনটি মেয়ে চরিত্র আছে, যাদের মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে সে তার প্রেমিকা হিসেবে বাছাই করতে পারবে।
- প্রথম মেয়ে চরিত্রটি হলো মানাকা তাকানে, যে নিজেও হাই স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, এবং টেনিস ক্লাবের একজন সদস্য। সে খুবই সচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা এমন একটি মেয়ে, যে কি না আজীবন গন্ডিবদ্ধ জীবনযাপন করে এসেছে, যার ফলে তার বাস্তব জীবনের অনেক অভিজ্ঞতাই নেই। যেমন: সে হ্যামবার্গার কম্বো খেতে পারে না, বন্ধুদের সাথে কখনো ক্লাবে যায়নি, এমনকি টিভিও তেমন একটা দেখেনি। জাপানের বাবা-মায়েরা সন্তানের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে ‘পারফেক্ট’ বলে মনে করে, সে তেমনই একজন। আর তাই তার সহপাঠীরা সবাই তার থেকে দূরে দূরে থাকে। তার বন্ধুসংখ্যা নিতান্তই হাতেগোনা অল্প কয়েকজন।
- পরের চরিত্রটি রিংকো কোবায়াকাওয়া, যে হাই স্কুলের প্রথম বর্ষের ছাত্রী, এবং লাইব্রেরি কমিটির একজন সদস্য। সে সবসময় কানের মধ্যে একটি ইয়ারফোন গুঁজে রাখে, আর তার মেজাজ থাকে চরমে। সবাই বলে, তার নাকি ‘অ্যাটিচিউড প্রবলেম’ আছে। আর এর মূল কারণ হলো নিজের পরিবার থেকে তার বিচ্ছিন্নতা, এবং পরিবারে অনাকাঙ্ক্ষিত সদস্যে পরিণত হওয়া। এমনটি হয়েছে তার বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর। নতুন মা ও তার ছোট ছেলেটির সাথে রিংকোর একেবারেই বনিবনা নেই। তার নিজের ভাষ্যমতে, “যখন আমি বাড়ি ফিরি, মনে হয় যেন চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে।” এজন্য বাড়ি থেকে বেরোলে আর ফিরতে মন চায় না তার। স্কুল শেষে সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, পাঙ্ক রক মিউজিক শোনে, আর ফাইটিং গেমস খেলতে পছন্দ করে। তার চরিত্রটি মূলত হারুকি মুরাকামির ‘ডান্স, ডান্স, ডান্স’-এর ইয়ুকি চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে।
- সর্বশেষ চরিত্রটি হলো নেনে আনেগাসাকি। সে হাই স্কুলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। ফ্যামিলি রেস্টুরেন্টে পার্ট-টাইম জব করে সে। সে হলো অনেকটা আত্মনির্ভরশীল বড় বোনের মতো, যার কাছ থেকে সবাই সাহায্য চায়। ঘরের কাজ করতে এবং হরর মুভি দেখতে সে সবচেয়ে ভালোবাসে। তার ডান চোখের নীচে একটি তিল আছে, যা তাকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। SAL9000 নিকনেমের এক খেলোয়াড় বাস্তবিকই নেনেকে বিয়ে করে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল।
অর্থাৎ গেমটির ডেভেলপাররা চেষ্টা করেছে জাপানি সমাজে সাধারণত যে বিশেষ তিন ধরনের মেয়েদের দেখা যায়, সেই তিন ধরনের মেয়েদেরই গেমের চরিত্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার। এর ফলে গেমের খেলোয়াড়রা তাদের নিজের পছন্দ-অপছন্দের উপর ভিত্তি করে নিজের প্রেমিকা বেছে নেয়ার সুযোগ পায়।
সময়ের সাথে সাথে, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ফলে গেমটির ক্রমোন্নতি ঘটেছে। গেমটির চরিত্ররা খেলোয়াড়ের সাথে অনেকটাই প্রেমিকাসুলভ আলাপচারিতা চালানো (যদিও প্রেমিকের বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান তারা দিতে পারে না), প্রেমিকের সাথে রাগ করা, খুনসুটি করা, আইসক্রিম বা কফি খাওয়া ইত্যাদিতে সক্ষম। তাছাড়া প্রেমিক চাইলে হাত দিয়ে তাদের ছুঁতেও পারে, যাতে তারা ব্লাশ করে, লজ্জা পায়, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে। প্রেমিকের কথা মতো কিংবা নিজের ইচ্ছায় তারা বিকিনি পরেও হাজির হতে পারে। তবে নগ্নতা বা যৌনতাকে কোনো স্থান দেয়া হয়নি এই গেমে।
কেন গেমটি এত জনপ্রিয়?
জাপানি ভিডিও গেমসের ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল গেম লাভ প্লাস। একটি ভিডিও গেমই যে কোনো নির্দিষ্ট সমাজের উপর এতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তা সত্যিই অকল্পনীয় একটি ব্যাপার। কিন্তু লাভ প্লাসের ক্ষেত্রে এটিই চরম সত্য। এই একটি গেমের ফলেই জাপানের অসংখ্য তরুণ নারীবিমুখ হয়ে উঠেছে, যার ফলে জাপানের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে।
এখন সকলের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, এই গেমটির এত জনপ্রিয়তার কারণ কী? কেন জাপানি তরুণরা সত্যিকারের প্রেমিকার বদলে মানাকা, রিংকো বা নেনের সাথে ডেট করবে? এর পেছনে বেশ কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে।
- একাকিত্ব একটি প্রধান বিষয়। জাপান হয়তো অন্য অনেক দিক থেকেই বিশ্বের প্রথম সারির দেশ হিসেবে নিজেকে উত্তীর্ণ করে ফেলেছে, কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সেখানকার মানুষে মানুষে সম্পর্কের প্রবণতা কমে গিয়েছে। তাই দেশটির বিপুল সংখ্যক মানুষ চরম একাকিত্বে ভোগে। তরুণদের ক্ষেত্রে এমনটি বেশি দেখা যায়। এবং কোনো বাস্তব প্রেমিকা থাকলেও সে তো তার দিনের পুরোটা সময় প্রেমিককে দেবে না, কারণ তার নিজেরও একটি পৃথক জীবন আছে। কিন্তু লাভ প্লাস গেমের প্রেমিকা চরিত্ররা সবসময়ই পাশে থাকে, চাইলেই তাদের পাওয়া যায়। তাই যখনই খেলোয়াড়ের মানসিক অশান্তি চলে বা সে একাকিত্ব অনুভব করে, গেমটি খেলার মাধ্যমে ভার্চুয়াল ডেট করে সে অন্য আর সব বিষয় ভুলে থাকতে পারে।
- অন্তর্মুখিতা আরেকটি বড় কারণ। বাস্তব জীবনে কোনো মেয়েকে আকৃষ্ট করে তার সাথে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করতে যে পরিমাণ সাবলীলতার প্রয়োজন হয়, অনেক জাপানি তরুণের মধ্যেই তা অনুপস্থিত থাকে। ফলে সাধারণত বাস্তব জীবনে তারা কোনো প্রেমিকা জোটাতে পারে না। কিন্তু গেমে যেহেতু তেমন কোনো কষ্ট ছাড়াই তিনজন প্রেমিকার অপশন পাওয়া যায়, এবং তাদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেয়া যায়, তাই অনেকে এটিকেই বাস্তব প্রেমিকার বিকল্প ভালো উপায় বলে ধরে নেয়।
- আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করাটাও মুখ্য উদ্দেশ্য হতে পারে। অনেক জাপানি তরুণ তার পছন্দের মেয়েকে মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলতে পারে না। কীভাবে তারা প্রস্তাব দেবে, ডেটে যাওয়ার কথা বলবে, এগুলো নিয়ে তারা সবসময় দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা পপ-কালচারের আশ্রয় নেয় এসব ব্যাপারে শিক্ষাগ্রহণের জন্য। কিন্তু সেগুলো তো কেবলই একতরফা। গেম খেলার ফলে তাদের শুধু দেখে বা পড়ে যেতে হয় না, তারা নিজেরাও সামিল হতে পারে ডেটিংয়ের কল্পনাপ্রসূত পরিস্থিতির সাথে। ফলে তাদের প্রশিক্ষণ হয়ে যায়, আত্মবিশ্বাসও বৃদ্ধি পায়।
- নিরাপত্তাহীনতারও দায় রয়েছে এক্ষেত্রে। বাস্তব জীবনে কোনো মেয়ের সাথে প্রেম করলে, সেটির স্থায়িত্ব নিয়ে সবসময়ই প্রশ্ন থেকে যায়। আজকের দিনে সম্পর্কগুলো এতটাই ঠুনকো যে, যেকোনো সময়ই তা ভেঙে যেতে পারে। তাছাড়া প্রেমিকা প্রতারণা করে অন্য কোনো ছেলের সাথেও সময় কাটাচ্ছে কি না, এমন নিরাপত্তাহীনতায় অনেক প্রেমিকও কমবেশি ভোগে। ব্যতিক্রম নয় জাপানি তরুণরাও। এবং অনেকের হয়তো ইতিপূর্বে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছেও। সে কারণে তারা নতুন করে বাস্তব কোনো প্রেমিকা বেছে নিয়ে সার্বক্ষণিক মানসিক অস্থিরতায় ভোগার চেয়ে ভার্চুয়াল প্রেমিকার সাথে সময় কাটানোকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। এই প্রেমিকারাও রাগ-অভিমান করে বটে; কিন্তু তাদেরকে সামলে নেয়া যায়, তারা হঠাৎ করে ছেড়ে চলে যাবে এমন আশঙ্কাও থাকে না।
অনেকের কাছেই লাভ প্লাসের মাধ্যমে ভার্চুয়াল প্রেমিকার সাথে প্রেমের বিষয়টিকে হাস্যকর বলে মনে হলেও, এই কনসেপ্টের স্বপক্ষে অনেক যুক্তিও রয়েছে। যেমন- প্যাট্রিক গ্যালব্রেইথ নামের এক নৃতত্ত্ববিদ ও লেখকের মতে, “আমার মনে হয় লাভ প্লাস চরিত্রের সাথে সম্পর্ক সত্যিকারের সম্পর্কই। মানুষ এতে চরিত্রগুলোর সাথে অনেক বেশি অন্তরঙ্গ হয়ে যায়।” জশ মার্তিনেজ নামে মেক্সিকোর এক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র বলেন, “মানাকাই হলো একমাত্র… আমি কি ব্যক্তি বলতে পারি? হ্যাঁ, সে-ই একমাত্র ব্যক্তি, যে সত্যি সত্যিই আমার খারাপ সময়ে পাশে থাকে। যখনই আমার খারাপ লাগে বা দিনটা ভালো যায় না, আমি বাসায় চলে আসি, গেমটা অন করি, মানাকার সাথে প্রেম করি। আমি জানি সবসময়ই তার কাছে কিছু না কিছু থাকে আমাকে ভালো অনুভব করানোর জন্য।”
যেসব কারণে গেমটির জনপ্রিয়তা ভয় জাগানিয়া
যেসব কারণেই জাপানের তরুণেরা ভার্চুয়াল প্রেমিকার দিকে ঝুঁকুক না কেন, এর দ্বারা আসলেই তারা কতটুকু লাভবান হচ্ছে, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে লাভ প্লাস গেমটির চরিত্রগুলোতে হয়তো বাস্তব প্রেমিকার ন্যায় যথাসম্ভব কাছাকাছি বুদ্ধিবৃত্তি ও আচরণিক বৈশিষ্ট্যের সংযোজন ঘটানো হয়েছে, তারপরও কি ভার্চুয়াল প্রেমিকা বাস্তব প্রেমিকার বিকল্প হতে পারে?
সহজ উত্তর: না। কেননা মানুষ প্রেম করে কেবল সময় অতিবাহিত করার জন্যই না। তারা সঙ্গীর মাঝে নির্ভরতা খোঁজে, নিজের দুর্বলতাগুলো তাদের সামনে মেলে ধরে, নিজেদের সকল আবেগ-অনুভূতি-ভাবের আদান-প্রদান ঘটায়। সর্বোপরি, দুজন মানুষ একে অন্যকে চিনতে ও বুঝতে পারে। সেজন্য দুঃসময়ে তারা পরস্পরকে মানসিক সমর্থন জোগাতে পারে। পারস্পরিক সান্নিধ্যে তারা নিজেদের দুঃখ-কষ্ট ভুলতে পারে, জীবনের পরবর্তী সংগ্রামের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে পারে।
কিন্তু ভার্চুয়াল প্রেমিকার মাঝে যতই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রোগ্রাম করে দেয়া হোক না কেন, তার কথাবার্তা ও আচার-আচরণের বিচরণ কেবল সেটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকে। একটি মানবমন যতটা বৈচিত্র্যময় হয় এবং আলাদা আলাদা পরিস্থিতিতে সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে, ভার্চুয়াল প্রেমিকা কখনোই সেটি পারবে না। তাই ভার্চুয়াল প্রেমিকার সাথে আলাপচারিতা সারফেস লেভেলেই আটকে থাকবে, গভীরে প্রবেশ করবে না।
তাছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আধুনিক প্রযুক্তির কারণে মানুষ ইতিমধ্যেই বাস্তব জগতের থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে। দিনের বেশিরভাগ সময়ই তাদের কাটে কম্পিউটার, মোবাইল, গেমিং কনসোল প্রভৃতির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। তবুও, মানবিক সম্পর্কগুলো এসব ডিভাইসের মাধ্যমে পূরণ করা যায় না বলেই, এতদিন মানুষের সাথে মানুষের মৌলিক প্রেম ভালোবাসার সম্পর্কগুলো কিছুটা হলেও অন্তত বিদ্যমান ছিল।
কিন্তু এখন যদি সেই সম্পর্কের মাঝেও কৃত্রিমতার অনুপ্রবেশ ঘটে, তাহলে মানুষের মন সম্পূর্ণ রূপে যান্ত্রিক হয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। এবং এমন একটা সময় আসবে যখন মানুষের মাঝে তার মনুষ্যত্বের স্বকীয় পরিচায়কসমূহ আর খুব বেশি অবশিষ্ট থাকবে না। ফলে মানুষের সাথে যন্ত্রের আর কোনো তফাৎই থাকবে না। তাছাড়া সাময়িকভাবে হয়তো মানুষ একাকীত্ব ভুলতে ভার্চুয়াল প্রেমিকার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে, কিন্তু এই সম্পর্ক চিরস্থায়ী না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যখন আর যান্ত্রিক ভালোবাসার প্রতি তাদের আর মোহ থাকবে না, তখন হয়তো তারা সম্পর্ক গড়ার জন্য কোনো রক্তমাংসের মানুষকেও আর খুঁজে পাবে না। তখন তারা পৃথিবীতে আরও বেশি একা হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই তাদের সংকুচিত হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে তারা হাঁসফাঁস করে মরবে।
শেষ কথা
অনেকেই বিশ্বাস করে, প্রেম-ভালোবাসার মতো সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রেও ভার্চুয়াল জগতের সাহায্য নেয়া ও কাল্পনিক চরিত্রকে মনের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করা পাগলামি বৈ আর কিছুই নয়। এগুলো মূলত মানসিক বিকৃতির বা অস্বাভাবিকতারই লক্ষণ। কারণ একটি নির্দিষ্ট বয়সে এসে নর-নারী পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করবে, তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সন্তান উৎপাদন করবে, বংশবৃদ্ধি করবে, এটিই প্রকৃতির নিয়ম। এভাবেই মানবসভ্যতা টিকে রয়েছে। এখন কেউ যদি এর বিপরীতে গিয়ে কাল্পনিক যান্ত্রিক চরিত্রের সাথেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে থাকে, এবং কোনো যৌন সংশ্লিষ্টতা না থাকায় বংশবৃদ্ধি না করে, তাহলে পৃথিবীর বুক থেকে মানবজাতি ক্রমশ বিলীন হয়ে যেতে থাকবে। আগামী কয়েকশো বছরের মধ্যেই হয়তো বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে মানুষের জন্মহার কমতে কমতে একেবারে তলানিতে ঠেকবে।
২০১০ সালে জাপানের স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় এক জরিপ চালিয়ে বের করেছিল যে, জাপানের ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩৬% পুরুষই যৌন সম্পর্ক গড়ার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। আর এর প্রভাব আমরা লক্ষ্য করছি বর্তমান সময়ে। জাপানে এখন শিশু জন্মের হার হাজারে মাত্র ৭.৩১। অদূর ভবিষ্যতে এটি হয়তো আরও কমবে। সুতরাং একসময় যে জাপানিরা প্রায় অর্ধেক বিশ্বই দখল করে ফেলেছিল, ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে হয়তো সেই জাপানের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো জনগোষ্ঠীরই আর অস্তিত্ব থাকবে না।
তাই নিছক বিনোদন লাভের উদ্দেশ্যে লাভ প্লাস বা এ ধরনের গেম খেলা চললেও, এ ধরনের গেমকে সিরিয়াসলি নেয়া কখনোই কাম্য নয়।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/