একটা সময় কম্পিউটার ছিল আমাদের কাছে আশ্চর্য এক যন্ত্র। এরপর ধীরে ধীরে কম্পিউটার প্রায় ঘরের নিয়মিত সদস্য হয়ে গেল। প্রথমদিকে ডেস্কটপই ছিল, এরপর এল ল্যাপটপ। তখনও হাত ব্যবহার না করে কম্পিউটার পরিচালনার ব্যাপারটি আমাদের কাছে প্রায় অবিশ্বাস্যই। এখন সেই প্রযুক্তিও আমাদের হাতের নাগালে। আর কতটা সামনে এগোবে মানব সভ্যতা? আমাদের এই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কি ভালো, নাকি খারাপ?
প্রশ্নটির খুব যুতসই উত্তর হতে পারে ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আপগ্রেড’ চলচ্চিত্রটি। মুভির মূল চরিত্র প্রাথমিকভাবে নিজের শরীরকে পরিচালনার জন্য যন্ত্রের সাহায্য নিলেও, পরবর্তী সময়ে সেই যন্ত্র তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। বাস্তবেও কি এমন কিছু ঘটতে পারে? এত কষ্ট আর চেষ্টার ফল যে প্রযুক্তি, একটা সময় সেটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে না তো? একটা সময় সাইবর্গ আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কথাগুলো শুনতে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর কোনো অংশ বলে মনে হতো। এখন ব্যাপারটা তেমন নয়। ২০১২ সালে ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গের বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জেনিফার কলিনগার সরকারের সহায়তায় একটি গবেষণামূলক পরীক্ষা চালান।
এই পরীক্ষায় জ্যান শরমানের ভাগ্য বদলে দেওয়া হয়। ৫৩ বছর বয়সী এই নারী এখন মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত কিছু তারের সহায়তায় নিজের যান্ত্রিক হাতকে পরিচালিত করতে পারেন। এভাবে তিনি বিশাল এক প্লেনও চালিয়েছেন। ২০১৯ সালে এসে তাই ভবিষ্যতে সাইবর্গ তৈরি করা যাবে কিনা, সে প্রশ্ন শুনলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এই প্রক্রিয়া ১৯৭০ সাল থেকেই চলছে। প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে প্রযুক্তি। এ বছর নেক্সট-জেনারেশন ননসার্জিকাল নিউরোটেকনোলজি প্রোগ্রামের মূল লক্ষ্যই হলো ইলেক্ট্রোড, তার আর সার্জারির প্রয়োজনীয়তা দূর করা। প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সাধারণ ক্যাপের ভেতরে সংযুক্ত করা যাবে, এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই যন্ত্রের কাজ হবে অনেকটা টেলিপ্যাথির মতো, মস্তিষ্ক যেটিকে খুব সহজেই বুঝতে পারে। বলতে গেলে আমাদের মস্তিষ্ক তখন আক্ষরিক অর্থেই কম্পিউটারের মতো কাজ করা শুরু করবে। এর আগে ইলন মাস্কও নিউরালিঙ্ক নামক একটি পরীক্ষা চালানোর চেষ্টা করেছেন।
তবে তাতে সার্জারি আর যোগাযোগ স্থাপনের ঝুঁকি ছিল আগের মতোই। অন্যদিকে, নতুন প্রযুক্তিতে এমন কোন সমস্যার সুযোগ রাখা হয়নি। গবেষকেরা এই পুরো ব্যাপারটা নিয়ে বেশ আশান্বিত। তারা ভাবছেন, এই প্রযুক্তি স্থাপন করা গেলে যন্ত্রের সাথেও কোনো বাড়তি ঝামেলা ছাড়া সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবো আমরা।
গবেষকদের মতে, মানুষ সবসময় যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমেই নিজেকে আরও উন্নত করে তুলেছে। তাই এই ব্যাপারে আরও বেশি উৎকর্ষ ঘটলে তার প্রভাব মানব সভ্যতার উপরে আরও ইতিবাচকভাবে পড়বে। সীমিত যে গণ্ডির মধ্যে একটা সময় মানুষ আটকে ছিল, সেটি অতিক্রম করা যাবে। ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেসের যাত্রা কিন্তু শুরু হয়েছিল আরও অনেক আগে। ১৮০০ শতকের কথা। সেসময় প্রাণীদের মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের কার্যক্রম দেখতে পান গবেষকেরা। সেখান থেকে ১৯২০ সালে হ্যান্স বার্জার একই প্রক্রিয়ায় মানুষের মস্তিষ্কেও খুঁজে বের করেন।
আর এর ঠিক ৫০ বছর ইউনিভার্সিটি ক্যালিফর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলসের কম্পিউটার বিজ্ঞানী জ্যাকুইস ভিডাল এ ব্যাপারে গবেষণা করে নামকরণ করেন ‘ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস’। তবে সেটা তখন নামকরণ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। এরপর অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও অনেক খুঁটিনাটি ব্যাপারের জন্য। কম্পিউটিং পাওয়ার, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আর ন্যানোটেকনোলজি উন্নত হয়েছে। ধীরে ধীরে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকেরা চলৎশক্তিহীন মানুষকেও কম্পিউটার ইন্টারফেসের মাধ্যমে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছেন।
তবে এক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা রয়ে গয়েছে। গবেষকদের মতে, এই পদ্ধতিতে যোগাযোগ স্থাপন এবং তথ্য সরবরাহ করা পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছে না। যোগাযোগ স্থাপন শতভাগ নিশ্চিত করতে প্রয়োজন মানুষের খুলিতে ছোট্ট একটি ছিদ্র করা এবং ইলেক্ট্রোডের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করা। সেটা না করলে কিছু সীমাবদ্ধতা এখানে চলে আসতেই পারে।
এই সীমাবদ্ধতাকে দূর করার জন্যই নতুন করে ভেবেছেন বিজ্ঞানীরা। দুটো উপায় বের করেছেন তারা। প্রথমত, ভাইরাসের মাধ্যমে শরীরে ডিএনএ প্রবেশ করিয়ে এবং দ্বিতীয়ত, মৌখিকভাবে অত্যন্ত ছোট কোনো যন্ত্রকে শরীরে প্রবেশ করিয়ে। এতে করে সার্জারি ছাড়াই মস্তিষ্কের খুব কাছে গিয়ে মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। তবে সেখানেও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। আর সেটি হলো সময়। আপনি কম্পিউটারে কোনো একটি ফাইল খুলতে চাইলে মাউস দিয়ে তাতে ক্লিক করলে কিছুক্ষণ সময় নেয় ফাইলটি চালু হতে। একজন মানুষ এদিক দিয়ে অনেক দ্রুত তার যান্ত্রিক অঙ্গকে পরিচালিত করতে চাইবে। কিছু একটা করতে চাওয়ার চিন্তা করার সাথে সাথেই তার অঙ্গটিকে কাজ শুরু করে দিতে হবে। আর এজন্যই মস্তিষ্ক এবং যন্ত্রের কার্যক্রমকে আরও দ্রুত করার চেষ্টা করছেন গবেষক দল।
একইসাথে আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন তারা। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে একজন মানুষ একইসাথে অনেকগুলো কাজ করতে পারবে কিনা, অক্ষম নন এমন কোনো মানুষের শরীর এই যন্ত্রের সাহায্য নিলে সেটা কতটা কার্যকরী হবে- এই প্রশ্নগুলোর উত্তরও জানার প্রয়োজন আছে।
মানুষের মস্তিষ্কে এই যন্ত্র স্থাপন করলে সেক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকি যে একেবারেই থাকবে না তা নয়। এক্ষেত্রে-
অতি ব্যবহারে মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে
কোন মানুষের মস্তিষ্ক ঠিক কতটা আল্ট্রাসাউন্ড এবং অন্যান্য যান্ত্রিক চাপগুলো নিতে পারবে, তা দেখার প্রয়োজন আছে। কারণ, মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতা আছে। বাড়তি চাপ প্রয়োগের ফলে এর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
মস্তিষ্ক নিজস্বতা হারিয়ে ফেলতে পারে
মস্তিষ্কের নিজস্ব একটি পরিচালনা ব্যবস্থা আছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষ মস্তিষ্ককে তুলনামূলকভাবে কম ব্যবহার করা শুরু করেছে। এরপর যদি কম্পিউটার-ব্রেইন ইন্টারফেস ব্যবহার করা হয়, তাহলে একটা সময় আমাদের মস্তিষ্ক এর নিজস্ব কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে।
তবে এমনটা যে হবেই, তা নয়। হতেই পারে যে, আর দশটা সাধারণ যন্ত্রের মতোই এই যন্ত্রটিও মানুষের কার্যক্ষমতাকে একটু বাড়িয়ে দেবে শুধু। বিজ্ঞানীরাও তা-ই ভাবছেন। খুব ভালো কিছু পাওয়ার জন্য খানিকটা ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক তারা। তবে হ্যাঁ, এখানে কতটা ঝুঁকি কতটুকু আর ইতিবাচক ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। গবেষণা সম্পন্ন হওয়ার আগে হয়তো এই বিতর্ক থেকেই যাবে। আর ভবিষ্যতে কী হবে? তা জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে আরও অনেকগুলো দিন।