কেমন হত যদি আপনার সকল তারবিহীন সংযোগ তারের মাধ্যমে পরিবর্তন করে দেয়া হত। আপনাদের বাসার টেলিভিশন, ল্যাপটপ প্রতিটির সাথে তার লাগানো থাকত যার দৈর্ঘ্য হত শত শত মাইল। আর ফোন করার জন্য আপনার রাস্তার পিলারের সাথে সংযুক্ত করতে হত। এমনকি আপনি উড়োজাহাজ চালাতে সক্ষম হতেন না, কেননা পাইলটদের দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য সংকেত পাঠানো সম্ভব হত না। জানালা দিয়ে দেখলে খালি চারদিকে তার আর তার দেখতে পেতেন। এর মধ্যেই তারবিহীন সংযোগের সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। তারবিহীন সংযোগের যে মাধ্যমটি আপনি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে চলেছেন তা হল ওয়াই-ফাই। ঘরে এবং বাইরে আমাদের ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত থাকার জন্য ওয়াই-ফাই অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করছে বা করে এসেছে।
ওয়াই-ফাই কী সেটা সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে চাইলে বলা যায় তা একধরনের তরঙ্গ। রেডিও তরঙ্গ তথ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বাতাসের মাধ্যমে বহন করে নিয়ে যায়। তবে বিভিন্ন বাধা ওয়াই-ফাই এর পরিসর এবং কার্যক্ষমতার উপরে প্রভাব ফেলতে পারে। তাছাড়া রেডিও তরঙ্গ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন নিয়ম নীতি মেনে চলতে হয়। এখন শুরু করার আগে রেডিও তরঙ্গের কিছু পরিভাষা নিয়ে হালকা আলোচনা করা যাক।
রেডিও তরঙ্গ একধরনের তড়িৎচুম্বকীয় সংকেত যা বাতাসের মধ্য দিয়ে লম্বা দূরত্বে তথ্য বহন করে নিয়ে যায়। এই তরঙ্গকে অনেক সময় রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি সিগন্যাল বলেও আখ্যায়িত করা হয়। এই সংকেতগুলো খুব উচ্চ কম্পাংকে কম্পনশীল হয়, যার কারণে তরঙ্গগুলোকে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে তুলনা করা যায়। রেডিও তরঙ্গগুলো বাতাসের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করতে থাকে। আমরা এই তরঙ্গ অনেক বছর ধরেই ব্যবহার করে এসেছি। আমাদের এফএম রেডিওতে গান এবং টেলিভিশনে ভিডিও বহন করার জন্য এই রেডিও তরঙ্গই দায়ী। তথ্য সরবরাহ করার ক্ষেত্রে এর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ভিন্নতা দেখা দেয় সময়ের সাথে সাথে।
বিস্তার(Amplitude): রেডিও তরঙ্গের বিস্তারের মাধ্যমে তার শক্তি বিবেচনা করা হয় সাধারণত। এ কারণেই হয়ত বিস্তার মাপা হয় শক্তির এককের মাধ্যমে। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের শক্তি বিবেচনা করা যায় একটি তরঙ্গকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হবে তার দ্বারা। শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিসরও বৃদ্ধি পায়।
কম্পাংক(Frequency): তরঙ্গের কম্পাংক বোঝানো হয় কোনো সংকেত প্রতি সেকেন্ডে কী পরিমাণে পুনরাবৃত্তি হয়েছে তার মাধ্যমে। ওয়াই-ফাই এর জন্য যে তরঙ্গ ব্যবহার করা হয় তা সাধারণত ২.৪ গিগাহার্জ (সেকেন্ডে দুই হাজার চার শত কোটি বার স্পন্দিত) এবং ৫ গিগাহার্জের (সেকেন্ডে পাঁচ হাজার কোটি বার স্পন্দিত) হয়ে থাকে। এত উঁচু কম্পাংকের শব্দ বা আলো কোনোটিই মানুষ শুনতে বা দেখতে পারে না। এই কারণে রেডিও তরঙ্গ মানুষ লক্ষ্য করে না।
ওয়াই-ফাই যেকোনো স্থানে খুব দ্রুত ডেটা এনকোডেড স্পন্দন বা তরঙ্গ হিসেবে সঞ্চালিত হয়। এই স্পন্দনগুলোর একটি ছবি ফ্রেমবন্দী করা গেলে দেখা যাবে যে, স্পন্দনগুলোর মধ্যে প্রায় ৬ ইঞ্চি ব্যবধান রয়েছে (নিচের এই ছবিতে তা হালকা রঙিন ব্যান্ড দ্বারা দেখানো হয়েছে)। ওয়াইফাই রাউটার মূলত একটি অ্যান্টেনা, যা একই সময়ে একাধিক ফ্রিকোয়েন্সি উপর তথ্য পাঠাতে পারে। এই বহুবিধ ফ্রিকোয়েন্সিগুলোকে নীল, সবুজ, হলুদ এবং লাল রং হিসাবে দেখানো হয়, যা ছবিটির চারপাশের স্থানটি ছড়িয়ে অবস্থান করছে। এখানে দেখানো হয়েছে যে, একাধিক কম্পাংকের তথ্য হিসাবে একটি স্থানে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে, কিন্তু যেকোনো বেতার যন্ত্র দ্বারা এই তথ্য বুঝে অনুবাদ করা সম্ভব একটি সাধারণ ট্যাগ সিস্টেম ব্যবহার করার মাধ্যমে।
ওয়াই-ফাই মূলত নির্ভর করে একধরনের রেডিও তরঙ্গের আদান প্রদানের উপর। এই তরঙ্গের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তরঙ্গগুলোর একটির সাথে আরেকটির দূরত্ব রেডিও তরঙ্গ হতে কম, তবে মাইক্রোওয়েভ থেকে বেশি। কিছুক্ষণ আগে আপনাদের ওয়াই-ফাই তরঙ্গের দুই ধরনের কম্পাংকের কথা বলেছিলাম। এমনটা নিয়ন্ত্রণ করা হয় যাতে অন্যান্য তরঙ্গের সংঘর্ষ না হয়। ওয়াই-ফাই তরঙ্গের দুটি শীর্ষের মধ্যবর্তী দূরত্ব ৩ থেকে ৫ ইঞ্চির মতো হয়ে থাকে।
কম্পিউটার সাধারণত বাইনারি সংখ্যা (০ এবং১) দ্বারা সবকিছু বিবেচনা করে। তরঙ্গের শীর্ষকে একটি কম্পিউটার ১ হিসেবে এবং পাদকে ০ হিসেবে বিবেচনা করে। ০ এবং ১ এর মাধ্যমে বিট গঠিত হয় যা কম্পিউটারের জগতে নেটওয়ার্কের গতির নির্ণায়ক হিসেবে কাজ করে। ০ এবং ১ এর একটি শিকল অক্ষর, সংখ্যা এবং কোডে পরিণত হয় যা আমাদের স্ক্রিনে আসা ওয়েবপেইজ, ইমেইল এবং অন্যান্য উপাদান গঠন করে। আপনার এই তথ্য আপনার সেবা প্রদানকারী ইন্টারনেট সেবার সার্ভার হয়ে আবার চলে যাচ্ছে ইন্টারনেটের বিশাল জালে।
সাধারণত ওয়াই-ফাই তরঙ্গের বিস্তার হ্রাস পায় তা তার উৎস থেকে যত দূরে যায় সেই হারে। এই কারণে উপরের ছবিতে ডান পাশে বিস্তার বেশি হলেও বাম দিকে তা ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে।
তাহলে এখন আসা যাক এই ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে সেই কথায়। ওয়াই-ফাই এর মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদান করতে হলে সে সিস্টেমে অন্তত ট্রান্সিভার, এন্টেনা এবং একটি সম্প্রচার মাধ্যম থাকে। ট্রান্সিভার এবং এন্টেনা সাধারণত আপনার ঘরের ওয়াই-ফাই রাউটারে একসাথে থাকে। আর সম্প্রচার মাধ্যমে বাতাস তো আছেই।
ট্রানসিভার একটি প্রেরক যন্ত্র (Transmitter) এবং গ্রাহক যন্ত্রের (Receiver) সমন্বয়ে গঠিত। প্রেরক যন্ত্র একপ্রান্ত থেকে (উৎস) রেডিও তরঙ্গ প্রেরণ করে এবং গ্রাহক যন্ত্র অন্য প্রান্তে (গন্তব্য) সেই তরঙ্গ গ্রহণ করে। প্রেরক যন্ত্র আপনার কম্পিউটারের ডিজিটাল সংকেত (০ এবং ১ এর সমন্বয়ে গঠিত বিট) রেডিও কম্পাংকে পরিবর্তন করে এবং তা পরবর্তীতে বাতাসের মাধ্যমে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এর আগে এমপ্লিফায়ারের মধ্য দিয়ে তরঙ্গের বিস্তারের মাত্রা বৃদ্ধি করা হয়, যাতে সংকেতের সঞ্চারণ ঠিকমত হয়।
গ্রাহক যন্ত্রের গঠনও প্রেরক যন্ত্রের ন্যায়, তবে কাজ হয় এর ঠিক উল্টো। নিচের ছবি দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন।
আপনার ঘরে বেতার ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে আপনি নিশ্চয়ই রাউটার নামে একটা ছোট বক্স রয়েছে। এই রাউটার আপনার অজান্তে ঘরে ট্রান্সিভার এবং গ্রাহক যন্ত্রের কাজ করে যাচ্ছে। এই ছোট যন্ত্রটি ইন্টারনেটের সাথে আপনার সংযোগ আদান প্রদান করেই যাচ্ছে।
একটি বেতার রাউটার কেবল একটি রাউটার, যা আপনার কম্পিউটারের (বা কম্পিউটারগুলিকে) সাথে সংযোগ স্থাপন করে তারের পরিবর্তে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে। রাউটারে একটি খুব কম শক্তিসম্পন্ন রেডিও প্রেরক যন্ত্র এবং গ্রাহক যন্ত্র রয়েছে, যার পরিসর সর্বোচ্চ ৯০ মিটার বা ৩০০ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। তবে এর বেশিরভাগ নির্ভর করে আপনার দেওয়ালগুলো কী তৈরি করা এবং বাসার অন্যান্য ইলেকট্রিক্যাল সরঞ্জামের উপরে। রাউটার আপনার কম্পিউটারে যেকোনো কম্পিউটারে ইন্টারনেটের তথ্য পাঠাতে ও গ্রহণ করতে পারে (তবে বেতার নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত হতে কম্পিউটারে একটি রেডিও প্রেরক যন্ত্র এবং গ্রাহক যন্ত্র থাকতে হবে)। অধিকাংশ নতুন ল্যাপটপের মধ্যে নির্মিত ওয়্যারলেস কার্ড লাগানো থাকে।
ওয়াই-ফাই বলতে গিয়ে আপনি মাঝেমধ্যে হয়ত ওয়াই-ফাই হটস্পটকেই বুঝিয়ে থাকেন। একটি ওয়াই-ফাই হটস্পট হলো একটি সার্বজনীন স্থান, যেখানে আপনি আপনার কম্পিউটারকে ইন্টারনেটের সাথে সহজেই সংযুক্ত করতে পারেন। বিমানবন্দর, কফি বার, বুকশপ এবং ক্যাম্পাসগুলোতে আপনি যে হটস্পটগুলো খুঁজে পান সেগুলো এক বা একাধিক ওয়্যারলেস রাউটার ব্যবহার করে তৈরি করা, যাতে বৃহৎ এলাকার উপর বেতার নেট অ্যাক্সেস তৈরি করা যায়। নেদারল্যান্ডের টুইটে বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বের বৃহত্তম হটস্পটগুলোর একটি। ৬৫০টি আলাদা অ্যাক্সেস পয়েন্ট ব্যবহার করে, এটি সম্পূর্ণ ১৪০ হেক্টর (৩৫০ একর) ক্যাম্পাস জুড়ে একটি ওয়াই-ফাই হটস্পট তৈরি করেছে।
ফিচার ইমেজ: rving.how