৩১ অক্টোবর, ২০১৮। চীনের রয়্যাল কর্পোরেশন নামের একটি কোম্পানি বেশ জোরেশোরেই ভাঁজ করে রাখা যায় এমন একটি স্মার্টফোন বাজারে নিয়ে আসছে বলে ঘোষণা করে। মোবাইল ফোনের দুনিয়ায় ভাঁজ করা যায় এমন ফোল্ডিং ফোনের ধারনাটি বেশ পুরনো হলেও বড় পর্দাবিশিষ্ট স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে বিষয়টি কিন্তু বেশ নতুন। ভাঁজযোগ্য পর্দার রয়্যাল ফ্লেক্সপাই (Royole Flexpai) স্মার্টফোনটিতে বেশ কয়েকটি ত্রুটি বা সমস্যা নিয়েও স্মার্টফোন দুনিয়ার আগ্রহ টানতে সমর্থ হয়।
ফ্লেক্সপাই বাজারে আসার পরে পানি অনেক গড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে জেডটিই, স্যামসাং এবং হুয়াওয়ের মতো প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো তাদের নিজস্ব ব্রান্ডের ভাঁজ করা যায় এমন ফ্লাগশিপ স্মার্টফোন বাজারে নিয়ে এসেছে। ২০১৯ সালের মোবাইল ওয়ার্ড কংগ্রেসের অন্যতম আকর্ষণ ছিল এই ফোন্ডিং স্মার্টফোন।
নতুন এই ভাঁজযোগ্য স্মার্টফোনগুলো ভোক্তা বা ব্যবহারকারীদের কাছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। আজকের লেখাটিতে এই নতুন প্রযুক্তির ফোন্ডিং স্মার্টফোনের ফিচার, সুবিধা, অসুবিধা এবং বাজার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা থাকছে।
ফোল্ডিং স্মার্টফোনের উপযোগিতা
আমরা মূলত অফিসের হিসাব সংক্রান্ত কাজগুলো করতে নিজেদের প্রিয় স্মার্টফোনটির পাশাপাশি ট্যাবলেট বা ল্যাপটপ পিসি ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। কিন্তু ভ্রমণকালে এগুলো আমাদের আলাদাভাবে বহন করতে হয়। একটি ফোল্ডিং স্মার্টফোন কিন্তু খুব সহজে এই ট্যাবলেট পিসির প্রয়োজনীয়তা রাতারাতি কমিয়ে দিতে পারে। কেননা, ফোল্ডিং স্মার্টফোনে ব্যবহৃত দুটি পর্দা বা বড় পর্দার কারণে খুব সহজেই ট্যাবলেট কম্পিউটারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। এতে একদিকে যেমন আমাদের একসাথে দুটি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস বহন করতে হচ্ছে না, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে ট্যাবলেট কম্পিউটারের জন্য আলাদা করে অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে না। অর্থাৎ, এক স্মার্টফোনের মধ্যে সহজেই আমরা ট্যাবলেট পিসির উপযোগিতা পেয়ে যাচ্ছি।
এই সুবিধাটি বাসাবাড়িতে ঠিকভাবে বুঝতে পারা না গেলেও ভ্রমণকালীন সময়ে কিন্তু আমাদের দারুণ উপকার দিতে পারে। ট্রেন কিংবা বাস অথবা প্লেন, ভ্রমণকালে আমরা সবাই যথাসম্ভব কম মালামাল আমাদের সাথে বহন করতে চাই। সেক্ষেত্রে ভাঁজ করে রাখা যায় এমন একটি স্মার্টফোন যদি ট্যাবলেট কিংবা ল্যাপটপ কম্পিউটারের কাজগুলো করার সুবিধা দিতে পারে কিংবা বিনোদনের যাবতীয় সুবিধা দিতে পারে, তবে বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক।
স্মার্টফোনে যথাযথ মাল্টি-টাস্কিং বা একসাথে অনেকগুলো কাজের সুবিধা
বাজারে প্রচলিত স্মার্টফোনগুলোতে মাল্টি-টাস্কিং সুবিধা থাকলেও তা মূলত কোনোভাবেই কম্পিউটারের মতো ব্যবহারকারী বান্ধব নয়। ট্যাবলেট বা ল্যাপটপ কম্পিউটারে একসাথে যেমন অনেকগুলো এপ্লিকেশন বা প্রোগ্রাম চালু রেখে কাজ করা সম্ভব, প্রচলিত স্মার্টফোনগুলোতে এমন সুবিধা আসলেই সীমিত।
নতুন ফোল্ডিং স্মার্টফোন এই মাল্টি-টাস্কিং সংজ্ঞাকে বহুলাংশে রাতারাতিই বদলে দিচ্ছে। ফোল্ডিং স্মার্টফোনে দুটি পর্দা থাকার সুবিধা নিয়ে খুব সহজেই একসাথে পাশাপাশি দুটি প্রোগ্রাম বা এপ্লিকেশন চালানোর সুযোগ থাকছে। সমসাময়িকভাবে কাজ করার এমন সুবিধাই সত্যিকারের মাল্টি-টাস্কিং। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি পর্দায় হয়তো ইউটিউবে হয়তো মজার কন্টেন্ট চলছে, অন্য পর্দাটিতে চলছে মাইক্রোসফট এক্সেলে গুরুত্বপূর্ণ কোনো হিসাব।
এককেন্দ্রিক ক্যামেরা সুবিধা
মূলধারার স্মার্টফোনের বাজারে এখন রীতিমতো ক্যামেরাকেন্দ্রিক যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধ কোম্পানিগুলোর রিয়ার এবং সেলফি ক্যামেরায় কত বেশি ভালো ক্যামেরা সেটআপ দিতে পারে সেই যুদ্ধ। মজার বিষয়টি হচ্ছে, ফোন্ডিং স্মার্টফোনে কিন্তু একটি সেটআপ দিয়েই যাবতীয় কাজ খুব সহজেই সম্পাদন সম্ভব। অর্থাৎ, আলাদা করে সেলফি ক্যামেরার কোনো দরকার থাকছে না। এক্ষেত্রে দুটি পর্দার সমন্বয় বাড়তি সুবিধা প্রদান করছে। পর্দা দুটিতে ভিউ-ফাইন্ডার পরিবর্তনের সুবিধা নিয়ে একদিকের ক্যামেরা সেটআপ দিয়েই সেলফি কিংবা মূলধারার ক্যামেরা ফটোগ্রাফি সম্ভব।
উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি বাজারে আসা জেডটিই এক্সন এম স্মার্টফোনটির কথা বলা যেতে পারে। দুই পর্দার এই স্মার্টফোনে ২০ মেগাপিক্সেলের একটি ক্যামেরা সেটআপ ব্যবহার করা হয়েছে। ভাঁজযোগ্য এই স্মার্টফোনে ভিউ ফাইন্ডার পরিবর্তনের সুবিধা নিয়ে দুটি পর্দার মাধ্যমেই ছবি তোলা সম্ভব। কাজেই এই ফোনের ক্যামেরা একদিকে সেলফি তোলার কাজে এবং অন্যদিকে রিয়ার ক্যামেরার কাজে যথাযথভাবে করা সম্ভব।
নতুন সম্ভাবনা
ফোল্ডিং স্মার্টফোনের আগমন মোবাইল দুনিয়ায় এমন সব নতুন নতুন ফিচার ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করছে যা এতদিন মূলধারার স্মার্টফোনে উপভোগ করা সম্ভব হয়নি। এই স্মার্টফোনে ব্যবহৃত একাধিক পর্দার সুবিধা নিয়ে একই গেম একসাথে দুজন পরস্পর প্রতিযোগী হিসেবে খেলার সুযোগ থাকছে। পরস্পর বিপরীতমুখী দুটি পর্দায় দুই বন্ধু চাইলেই ব্যাটলশিপের মতো গেম প্রতিযোগী হিসেবে খেলতে পারবেন।
সম্প্রতি বাজারে আসা জেডটিই এক্সনএম ফোল্ডিং স্মার্টফোনটিতে এ ধরনের সুবিধা থাকছে। এ ধরনের গেমিং সুবিধা উপভোগ করতে চাইলে এতদিন আমাদের দুটি পৃথক ডিভাইস বা স্মার্টফোনের দরকার হতো। শুধু জেডটিই কোম্পানির এই স্মার্টফোন নয়, যেকোনো কোম্পানির ভাঁজ করে রাখা যায় এমন স্মার্টফোনে সত্যিকারের মাল্টি টাস্কিং সম্ভাবনাকে বেশ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
শুধু গেমিং নয়, বাড়তি পর্দার সুবিধা নিয়ে এই স্মার্টফোনে যেকোনো ধরনের প্রোগ্রাম বা এপ্লিকেশন চালানোর ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাওয়া সম্ভব। গেমের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ কিংবা ওয়ার্ডে লেখার জন্য এই বাড়তি পর্দা থেকে সুবিধা নেওয়া সম্ভব। প্রচলিত স্মার্টফোনে কোনো কিছু লেখা বা কোনো কাজ সম্পাদনার সময় কি-বোর্ড পর্দার বেশ বড় একটি জায়গা দখল করে রাখে। কিন্তু, ফোল্ডিং স্মার্টফোনের বাড়তি পর্দায় এই কি-বোর্ডের স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে কাজের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা নেওয়া সম্ভব।
বর্তমান সমস্যা এবং সীমাবদ্ধতা
আগেই বলা হয়েছে, ভাঁজ করা যায় এমন পর্দাবিশিষ্ট স্মার্টফোনের ধারণাটি এখনো একদমই নতুন। প্রচলিত স্মার্টফোনগুলোর ক্ষেত্রে পর্দার ক্ষেত্রে বর্তমান আধুনিকতা এবং প্রযুক্তি আসতে অনেকটা সময় লেগেছে। ফোল্ডিং স্মার্টফোনের বিষয়টি এখনো শুরুর দিকে। এক্ষেত্রে বিস্তর গবেষণার জন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। এছাড়া, এক্ষেত্রে পর্দার ভাঁজ করার বিষয়টি থাকছে বলে সুরক্ষার বিষয়টিও প্রচলিত ফোনের পর্দা সুরক্ষা পদ্ধতি থেকে পুরোপুরি ভিন্ন রকম। স্যামসাং, এলজির মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সাম্প্রতিক সময়ে ভাঁজ করে রাখা যায় এমন স্মার্টফোনের উন্নতিকল্পে বিস্তারিত গবেষণা শুরু করেছে। আরও উন্নত ভাঁজযোগ্য পর্দা নিয়ে গবেষণা করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অগ্রগতির বিষয়টি একটু সময়সাপেক্ষ হলেও সামনে অবশ্যই উন্নত প্রযুক্তি যে আসতে চলেছে এ কথা কিন্তু হলফ করে বলা যায়।
এ ধরনের স্মার্টফোন জনপ্রিয় হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, ‘ফোল্ডিং স্মার্টফোনের আকাশচুম্বী দাম’। হুয়াওয়ে কিংবা স্যামসাং কোম্পানির ভাঁজযোগ্য স্মার্টফোন দুটির দাম অধিকাংশ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে। এ ধরনের স্মার্টফোনগুলো ব্যক্তি পর্যায়ে জনপ্রিয় হতে হলে অবশ্যই এগুলোর দাম ক্রয়সীমার মধ্যে আসতে হবে। এক্ষেত্রে বাজার বিশ্লেষণ সাপেক্ষে মধ্য বাজেটের স্মার্টফোন বাজারে আসতে হবে।
যেহেতু এই স্মার্টফোন প্রযুক্তি একদমই নতুন, সেহেতু বাজারে জনপ্রিয় হতে হলে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সময়ের সাথে সাথে উন্নত এবং সাশ্রয়ী প্রযুক্তি এক্ষেত্রে সামনের দিনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে। হয়তো বা সেই দিন খুব বেশি দূরে নয় যখন স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে পর্দার ভাঁজযোগ্যতা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্ব পাবে। এখন দেখার বিষয়, আগামীতে কি এই ফোল্ডিং স্মার্টফোন প্রচলিত স্মার্টফোনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে চলেছে?