যে দুর্ভাগ্য নিয়ে তৈরি হয়েছিল টাইটানিক

জেমস ক্যামেরনের টাইটানিক সিনেমার বদৌলতে টাইটানিক আর তার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা এখন সবাই জানে। কিন্তু রূপালি পর্দায় স্বাভাবিকভাবেই টাইটানিক দুর্ঘটনার প্রযুক্তি বিষয়ক দিকগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। খুব সাধারণভাবে আটলান্টিকের বরফ শীতল রাতে বরফের সাথে সংঘর্ষকেই মূল কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। এর বাইরেও আবহাওয়ার সমস্যা, বাণিজ্যিক কারণে দ্রুত চালানো, অন্য জাহাজ থেকে সতর্কবার্তা পাবার পরেও সেগুলো পাত্তা না দেয়ার মতো বেশ কিছু কারণ রয়েছে টাইটানিক দুর্ঘটনার পেছনে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি টাইটানিকের ব্যাপারে অনেক অজানা তথ্য তুলে ধরেছে, যেগুলো প্রমাণ করে ১৯১২ সালের ভয়ংকর রাত্রে টাইটানিকের মর্মান্তিক ঘটনাটি না ঘটলেও টাইটানিকের ভাগ্য লেখা হয়েছিল এর নির্মাণের সময়েই।

টাইটানিক; Image source: Wikimedia commons

যেকোনো কিছু নির্মাণেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কোন উপাদান দিয়ে সেটি তৈরি করা হচ্ছে। এরপরে থাকে কোন ধরনের আবহাওয়ায় সেটি ব্যবহার হবে, কতদিন ব্যবহার হবে, সর্বোচ্চ তাপ কিংবা চাপ ধারণ করার ক্ষমতার মতো ব্যাপারগুলো। খুব সাধারণ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাঁশ আর মাটি দিয়ে ঘর তৈরি করা গেলেও বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য বাঁশ আর মাটি কোনো কাজের না। সেক্ষেত্রে স্টিল, কংক্রিটের মতো নির্মাণসামগ্রীর প্রয়োজন হবে। আবার রান্না করার জন্য ধাতব পাত্রের বদলে প্লাস্টিকের পাত্র নিশ্চয়ই কেউ ব্যবহার করবে না, কারণ রান্না করতে যে তাপমাত্রার প্রয়োজন তাতে প্লাস্টিকের পাত্র গলে যাবে, কিন্তু ধাতব পাত্রের কিছুই হবে না।

টাইটানিক নির্মাণের দায়িত্ব ছিল বেলফাস্টের হার্ল্যান্ড অ্যান্ড উলফ কোম্পানির। ১৯০৯ সালে শুরু হয় টাইটানিকের নির্মাণকাজ। টাইটানিকের নির্মাণকাজ শুরুর কয়েক মাস আগে শুরু হয়েছিল টাইটানিকের ‘সিস্টার শিপ’ অলিম্পিকের নির্মাণকাজ। প্রায় একই রকম দেখতে জাহাজ দুটিই ছিল হোয়াইট স্টার লাইন কোম্পানির। টাইটানিক ও অলিম্পিক উভয়ই ছিল ‘অলিম্পিক ক্লাস ওশেন লাইনার’ জাহাজ। অলিম্পিক ক্লাসের আরেকটি জাহাজ ছিল ব্রিটানিক, যেটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধে ধ্বংস হয়। টাইটানিক ও অলিম্পিক একই সময়ে নির্মাণ হওয়াতে দুটি জাহাজের নির্মাণ প্রক্রিয়া প্রায় একই রকম ছিল। দুটি জাহাজই নির্মাণ করতে লাগে ২৬ মাস সময়। কিন্তু জাহাজ দুটির ভাগ্য ছিল দুরকম। টাইটানিক সাগরে ডুবে যায় প্রথম যাত্রাতেই আর অলিম্পিক টিকে থাকে দুই দশকেরও বেশি।

অলিম্পিক (বামে) ও টাইটানিক (ডানে); Image Source: Wikimedia Commons

টাইটানিকের নির্মাণকাজ শেষ হবার পর ১৯১২ সালের ২ এপ্রিল শুরু হয় টাইটানিকের পরীক্ষামূলক সমুদ্রযাত্রা। ভোর ছয়টা থেকে প্রায় ১২ ঘন্টাব্যাপী দীর্ঘ পরীক্ষায় অভিজ্ঞ ক্রু ও নাবিকরা টাইটানিকের বিভিন্ন সক্ষমতা পরীক্ষা করেন। পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হয়ে টাইটানিককে কাজের উপযোগী হিসেবে ঘোষণা দেন। এরপরই টাইটানিক তার নির্বাচিত ক্রুদের নিয়ে রওনা হয় সাউথহ্যাম্পটনে, যেখান থেকে ১০ এপ্রিল টাইটানিক প্রথম যাত্রায় রওনা হয় নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে। কিন্তু প্রথম যাত্রা শেষ করার আগেই উত্তর আটলান্টিকে ডুবে যায় টাইটানিক, যে কথা সবারই জানা।

নির্মাণের সময় টাইটানিক; Image source: Wikimedia commons

ভবন কিংবা রান্নার পাত্রের মতোই জাহাজ নির্মাণের জন্য কিছু উপাদানের প্রয়োজন যেগুলো জাহাজকে সমুদ্রের লোনা পানিতে দীর্ঘদিন কোনো দুর্ঘটনা ছাড়া টিকে থাকতে সাহায্য করবে। সমুদ্রের লোনা পানি ছাড়াও যেসব জাহাজ অনেক ঠান্ডা অঞ্চলে যাতায়াত করে তাদের জন্য দরকার আরো উন্নত সুরক্ষা ব্যবস্থা। আর টাইটানিকের সবচেয়ে বড় খুঁত ছিল যে উপাদান দিয়ে এটি তৈরি ছিল সেটিতেই।

টাইটানিক যে সময়ে তৈরি হয়েছিল সেসময় জাহাজ তৈরি হতো মূলত স্টিল দিয়ে। এর উপরে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেব জিঙ্কের (দস্তা) আবরণ দেয়া হতো যাতে সাগরের লোনা পানির কারণে লোহায় মরিচা না ধরে। জাহাজের নিচের দিকে মূল অংশকে বলা হয় ‘হাল’ (Hull)। টাইটানিকের হালগুলো ছিল স্টিল প্লেটের, যেগুলো পরবর্তীতে স্টিলের রিভেট দিয়ে জোড়া দেয়া হয়। কিন্তু এই স্টিল প্লেটগুলোই শেষপর্যন্ত টাইটানিকের দুর্ভাগ্যের একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

টাইটানিকের যাত্রাপথ ছিল সাউথহ্যাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্ক। এ যাত্রাপথে পানির তাপমাত্রা অনেক সময় বেশ কমে যায়, ফলে সমুদ্রের পানিতে বরফখন্ডের সৃষ্টি হয়। এ কারণে এসব এলাকায় একটু সাবধানে জাহাজ চালাতে হয়। গবেষকরা বিভিন্ন আবহাওয়া রিপোর্ট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে হিসেব করে বের করেছেন টাইটানিক যে সময়ে বরফখন্ডে আঘাত করেছিল সেসময়ে পানির তাপমাত্রা ছিল -২ ডিগ্রি এর আশেপাশে।

সাধারণত স্টিল বা ধাতব পদার্থগুলো ঘাতসহ হয়। ফলে ভারি নির্মাণকাজে ধাতব পদার্থের ব্যবহার অনেক বেশি। বর্তমানে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার বাড়লেও গত শতাব্দীর শুরুতে ধাতুই ছিল মূল নির্মাণ উপাদান। স্টিলসহ বেশ কিছু ধাতু রয়েছে যেগুলো কম তাপমাত্রায় গেলে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। অর্থাৎ যে ধাতুতে সাধারণ তাপমাত্রায় ঘাতসহ সেই ধাতুই কম তাপমাত্রায় একেবারে ভঙ্গুর হয়ে যায়। পদার্থের ঘাতসহ থেকে ভঙ্গুর পদার্থে রূপান্তর হয়ে যাবার এ ধর্মকে বলা হয় Ductile to Brittle Transition বা ঘাতসহ থেকে ভঙ্গুরে রূপান্তর, সংক্ষেপে যাকে বলা হয় DBT আর যে তাপমাত্রায় এ রূপান্তর ঘটে তাকে বলা হয় Ductile to Brittle Transition Temperature (DBTT)

ঘাতসহ থেকে ভঙ্গুরে রূপান্তর হবার গ্রাফ; Image Source: Elsevier

সাধারণত স্টিলের -২ ডিগ্রি বা তার থেকেও কিছু কম তাপমাত্রায় এ ধরনের পরিবর্তন হয় না। কিন্তু আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে স্টিলের উপাদানের উপর নির্ভর করে ঠিক কত তাপমাত্রায় এই রূপান্তর ঘটবে। স্টিল মূলত লোহার একটি সংকর যেখানে স্টিলের গুণাগণ অনেকটাই কার্বনের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। এছাড়াও স্টিল তৈরির সময় না চাইলেও সালফার, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়ামের মতো কিছু উপাদান থেকে যায়। আবার নিকেল-ক্রোমিয়ামের মতো উপাদান যোগ করে স্টেইনলেস স্টিল তৈরি করা হয়। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তিতে এসব উপাদানের পরিমাণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কিন্তু প্রায় একশ বছর আগে স্টিল তৈরির প্রযুক্তি বর্তমানের মতো উন্নত ছিল না।

১৯৯০ এর দিকে মেটালার্জিস্টরা খেয়াল করেন স্টিলে থাকা ম্যাঙ্গানিজ স্টিলের DBTT অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে। যদি স্টিলে ম্যাঙ্গানিজ বেশি থাকে তাহলে DBTT বেশ কমে যায়, ফলে তাপমাত্রা অনেক বেশি কম না হলে রূপান্তর ঘটে না। কিন্তু ম্যাঙ্গানিজ যদি কম থাকে তাহলে DBTT বেড়ে যায়, ফলে সামান্য তাপমাত্রা কমলেই স্টিল ভঙ্গুর হয়ে যায়। পরবর্তীতে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করে দেখা গেছে টাইটানিকের স্টিলে ম্যাঙ্গানিজের পরিমাণ সাধারণ অবস্থার থেকেও কম ছিল। ফলে টাইটানিকের স্টিলের DBTT বেড়ে গিয়েছিল।

ম্যাঙ্গানিজ ছাড়াও আরো দুটি উপাদান টাইটানিকের স্টিলে অতিরিক্ত পরিমাণে ছিল- ফসফরাস ও সালফার। সেসময় যে প্রযুক্তিতে স্টিল তৈরি হতো তাতে এই দুটি উপাদান নিয়ন্ত্রণ করা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। দুটি উপাদানই স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেই স্টিলের ঘাতসহতা কমিয়ে দেয়। ম্যাঙ্গানিজ কম থাকায় টাইটানিকের DBTT বেড়ে গিয়ে ঘাতসহতা একেবারেই কমে গিয়েছিল কম তাপমাত্রায়। সেই সাথে অতিরিক্ত ফসফরাস ও সালফারের উপস্থিতি পুরো ব্যাপারটিতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল। ফলে টাইটানিক যখন আটলান্টিকে বরফখন্ডের সাথে ধাক্কা খায় তখন সেই ধাক্কায় টাইটানিকের খুব বেশি ক্ষতি হবার কথা ছিল না। কিন্তু টাইটানিকের ভাগ্য যে লেখা হয়ে গিয়েছিল টাইটানিক তৈরির সময়েই! বরফের ধাক্কায় ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া স্টিলের প্লেট আর রিভেট ভেঙে যায়, পানি ঢুকে পড়ে টাইটানিকের নিচের দিকে আর টাইটানিকের স্থান হয় আটলান্টিকের তলদেশে।

মাইক্রোস্কোপে দেখা টাইটানিকের স্টিলের গঠন, লাল চিহ্নিত অংশ অতিরিক্ত সালফার ও ফসফরাস; Image Source: Elesevier

প্রশ্ন উঠতেই পারে, টাইটানিক এত সহজে ডুবে গেলেও অলিম্পিক কিভাবে দুই দশক টিকে থাকল, এমনকি একবার বড় ধরনের সংঘর্ষের পরেও। ১৯১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অলিম্পিকের সাথে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর একটি জাহাজের সাথে সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে অলিম্পিকের হালে দুটি বড় গর্তের সৃষ্টি হয়। কিন্তু টাইটানিকের সাথে অলিম্পিকের সংঘর্ষের পার্থক্য ছিলো টাইটানিকের সংঘর্ষ ছিল অনেক কম তাপমাত্রায় আর অলিম্পিকেরটা ছিল সাধারণ তাপমাত্রায়। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, টাইটানিকের পুরো ঘটনাটিতে ঘটনাস্থলের তাপমাত্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

অলিম্পিকের হালে সৃষ্ট গর্ত (বামে); Image Source: Wikimedia commons

টাইটানিকের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, কেননা সেসময়ের হিসেবে টাইটানিকের স্টিলের মান ভালোই ছিল। স্টিল তৈরির প্রযুক্তি থেকে শুরু করে ম্যাঙ্গানিজের প্রভাব ব্যাপারগুলো সবগুলোই পরর্তীতে জানা গেছে। ফলে টাইটানিক তৈরিই হয়েছিল দুর্ভাগ্য নিয়ে। আর সেই দুর্ভাগ্যের অংশীদার হতে হয় টাইটানিকের হতভাগ্য যাত্রী ও ক্রুদের।

তথ্যসূত্র

১. Hooper J. J, et al. (2003) Metallurgical Analysis of Wrought Iron From the RMS Titanic Marine Technology, Vol. 40, No. 2
২. Chawla N, (2007) Engineering Disasters: Learning from Failure

ফিচার ইমেজ- w-dog.net

Related Articles

Exit mobile version