স্টিভ জবসের শেষ স্বপ্ন রূপে আখ্যায়িত গোলাকার স্পেসশিপের মতো নকশায় প্রধান কার্যালয় তৈরি করেছে বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা কোম্পানি ‘অ্যাপল’। স্টিভ জবস তার জীবনের শেষ দুই বছর এই অ্যাপল ক্যাম্পাস নিয়েই কাজ করে গেছেন। মৃত্যুর মাস চারেক আগে স্টিভ ২০১১ সালের জুনের ৭ তারিখ কোপার্টিনো সিটি কাউন্সিল থেকে অনুমতি পাবার লক্ষ্যে এই বিলাসবহুল ভবনের বিস্তারিত তথ্য জমা দেন। ২০১৩ সালের অক্টোবর ১৫ কোপার্টিনো সিটি কাউন্সিলের অনুমোদন পাবার পর শুরু হয়েছিল ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের এই দক্ষযজ্ঞ।
২০১৭ সালে এটির কাজ আংশিক শেষ করে কর্মীদের জন্য উন্মুক্ত দেওয়ায় এটি এখন অ্যাপলের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস। ইনফিনিট লুপ নামে পরিচিত প্রথম ক্যাম্পাসের এক মাইল পূর্বে নতুন এই ক্যাম্পাস প্রায় ১২ হাজার দক্ষ কর্মীর তীর্থ হয়ে উঠেছে।
চোখ জুড়িয়ে যাওয়া নকশা
শেষ হবার আগেই গিনেজ বুকে নাম উঠানো এই ভবনে নেই অনাকাঙ্ক্ষিত কোনোরূপ আলোর প্রতিফলন। আইফোনের হার্ডওয়্যারের নকশাগুলোর সাথে সাদৃশ্য রেখে পুরো ভবনের ফিটিংসের কাজ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। অ্যাপলের সদ্য সাবেক বেশ কয়েকজন ব্যবস্থাপকের ভাষ্যমতে অ্যাপলের নতুন ভবনের বাথরুম থেকে লিফট সব জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে অ্যাপলের তৈরি বিভিন্ন ল্যান্ডমার্ক হার্ডওয়্যারের নকশা। এমনকি এলিভেটরের বাটনগুলো তৈরী করা হয়েছে আইফোনের হোম বাটনের মতো করে!
মূলভবনের দেয়ালগুলো নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাঁকা কাচের খন্ডগুলো দিয়ে। ৩ হাজারের বেশী বাঁকা কাচের খন্ড ব্যবহৃত হবে এই নির্মাণ কাজে।
২০১৭ থেকেই নতুন কার্যালয়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছে অ্যাপলের। ২০১৩ সালে নির্মাণকাজ শুরু করার পর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো ২০১৫ সালে কাজ শেষ হবে। দেরীর কারণ অ্যাপল বরাবরের মতো সবকিছুতে শৈল্পিক ছোঁয়া দিতে চেয়েছে। পারতপক্ষে কোথাও রাখতে চায়নি সূক্ষ্মতম ত্রুটিও। তাই কিনা নিখুঁত আর শৈল্পিক এই ভবন নির্মাণকাজে বাড়তি সময় লেগেছে বিশ্বের অন্যতম দক্ষ নির্মাণকর্মীদের।
ভবনের সিলিং প্যানেলগুলো তৈরিতে উচ্চমানের পলিশড কংক্রিট ব্যবহার করেছে। একেকটি দরজার হাতলগুলো তৈরিতেও এমন সূক্ষ্ম মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, যাতে বিন্দুমাত্র কোনো খুঁত না থাকে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ভাষ্যমতে, মান ঠিক রাখার জন্য দরজার হাতলগুলো তৈরি করতেই মোট দেড় বছর লেগেছে।
২০০৬ সালে স্টিভ জবসের কাছ থেকে নতুন ক্যাম্পাসের ঘোষণা আসে। ২০০৯ সালের গ্রীষ্মে স্টিভ ডাকেন বিশ্বজোড়া খ্যাতিমান স্থপতি নর্ম্যান ফস্টারকে এই অ্যাপল ক্যাম্পসের ডিজাইনে হাত দেবার জন্যে। পরবর্তীতে স্টিভ জবসের স্মরণসভায় নর্ম্যান ফস্টার সেই ঘটনার স্মরণে বলেন স্টিভ আমাকে সেদিন বলেছিলেন, “আমাকে তোমার বস হিসাবে নয়, বরং তোমার দলের একজন সদস্য হিসাবে ধরে নাও।”
১৭৬ একর জায়গার ওপর এই ক্যাম্পাসের মূল নির্মাণকাজ ২০১৩ সালের শেষ দিকে শুরু হয়। ২০১৭ এর মাঝামাঝি কাজ শেষ হয়ে আসায় ১২ হাজার কর্মীকে নিয়ে ওই ক্যাম্পাস চালু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ক্যালিফোর্নিয়ার কুপারটিনোতে বর্তমানে অ্যাপলের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। এর এক মাইল পূর্বে অবস্থিত কার্যালয়টি এর অভিনব বৃত্তাকার নকশার জন্য ‘স্পেসশিপ’ হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছে। অ্যাপল ক্যাম্পাসের এই অভিনব ধারণাটি আসে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির লন্ডন স্কয়ার থেকে যেটির মূলভবন এবং এর চারদিকে আছে চোখ জুড়ানো পার্ক।
মূল ভবনে রয়েছে ২৮ লক্ষ বর্গফুটের অফিস স্পেস। মোট ৮৩ হাজার বর্গফুটের মিটিং স্পেস, সাথে সাইট এলাকার পৃথক গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র, এক লাখ বর্গফুটের ফিটনেস সেন্টার, আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকবে এক হাজার সিটের চোখ ধাঁধানো অ্যাপল থিয়েটার অডিটোরিয়াম যার নামকরণ করা হয়েছে এর স্বপ্নদ্রষ্টা স্টিভ জবসের নামে। শুধু কি তাই? থাকছে প্রায় ১১ হাজার গাড়ি এক সাথে পার্ক করার জন্যে স্মার্ট পার্কিং লাউঞ্জ।
অ্যাপল তাদের এই ক্যাম্পাসে নিশ্চিত করছে শতভাগ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার। পুরো ক্যালিফোর্নিয়া জুড়েই রয়েছে বিশুদ্ধ পানির সমস্যা। কাজ শেষ হবার পর পুরোদমে এই ক্যাম্পাস চালু হলে প্রতিদিন প্রায় ১,৫৭,০০০ গ্যালন পানির দরকার পড়বে। তাই ক্যাম্পাসে একবার ব্যবহৃত পানিকেই আবার ব্যবহারযোগ্য করার লক্ষ্যে অত্যাধুনিক পানি বিশুদ্ধকরণ প্লান্ট বসানো হয়েছে। এই প্লান্ট ব্যবহারের ফলে সিলিকন ভ্যালি এলাকায় একই আয়তনের কোনো কমার্শিয়াল ভবনের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ পানি কম ব্যবহার করছে অ্যাপল।
নতুন এই ক্যাম্পাসে অ্যাপলের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার হার থাকবে প্রায় ৭৮ শতাংশ। এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উৎপাদিত শক্তি এবং অন্যান্য উপজাত ব্যবহার করার মাধ্যমে অনন্য এক নজির স্থাপিত হবে বলেই অ্যাপলের বিশ্বাস। পাশাপাশি এই ক্যাম্পাস ঘিরে লাগানো হচ্ছে প্রায় ৭,০০০ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। যার মধ্যে প্রায় ২,০০০ ফলের গাছও আছে। আপেল গাছ যে এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আছে।
শতভাগ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ৩০০টি ইলেকট্রিক কার চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা হচ্ছে, যা পরবর্তীতে আরো বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে ব্যবস্থাপকদের কাছ থেকে।
রেকর্ড সমতুল্য ৮ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুতের প্যানেলগুলোকে মূলভবন আর পার্কিং স্পেসের ছাদে লাগানো হয়েছে, চলছে পরীক্ষামূলক ফুয়েল সেল প্রযুক্তির ব্যবহার। পুরো ভবন জুড়ে ব্যবহার করা হবে এলইডি লাইট। পাশাপাশি উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার প্রাকৃতিক বায়ু চলাচলকে আরো সক্ষমতার সাথে ব্যবহার করে পুরো ভবনে সারা বছরের ৭৫ শতাংশ সময়ে এয়ার কন্ডিশনিং ছাড়াই কাটাতে পারছেন অ্যাপলের কর্মীরা। এর জন্যে অবশ্য নতুন কিছু প্রযুক্তির উদ্ভাবন করে ফেলেছে নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান! যার পেটেন্ট করার ঘোষণাও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
১৭৬ একরের এই বিশাল ক্যাম্পাসে কর্মীদের জন্যে আছে ১,০০০ এর অধিক সাইকেল। যাতে চড়ে কর্মীরা ছুটে যেতে পারবেন বিশাল এই ক্যাম্পাসের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কর্মীদের জন্যে আরো থাকছে ১,০০,০০০ বর্গফুটের ফিটনেস সেন্টার যা তৈরি করতে অ্যাপলের খরচ হবে প্রায় ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কর্মীদের সুবিধার জন্যে অ্যাপল দুই ক্যাম্পাস এবং এর আশপাশের বিভিন্ন ভবনের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে টানেল নেটওয়ার্ক, যা বিভিন্ন পণ্য ও সেবা পরিবহণে সময় কমিয়ে আনবে। মূল ভবনের গ্রাউন্ড লেভেলে ৬০ হাজার ফুটের রাজকীয় ডাইনিং ফ্যাসিলিটি অবাক করবে যে কাউকে। এতে একইসাথে আড়াই হাজার লোক একসাথে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
সুবিশাল এই ভবনের নিরাপত্তা নিয়েও বেশ তৎপর অ্যাপল কতৃপক্ষ। ভবনের অগ্নিনির্বাপণ সংক্রান্ত নিরাপত্তার নিশ্চিতের লক্ষ্যে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে। জরুরি মুহূর্তে এ ভবন কতটা নিরাপদ, তা নিশ্চিত করতে ১৫ বার সভা করে বেশ কয়েকবার শিরোনামেও এসেছে অ্যাপল।
দর্শনার্থীদের জন্য যা আছে
চোখ ধাঁধানো এই অ্যাপল ক্যাম্পাসে নির্মাণে ব্যয় হয়েছে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এটিই হয়ে উঠছে এই কোম্পানির মেধা, মনন আর উদ্ভাবনের নতুন ঘাঁটি। কর্মকর্তা, কর্মচারীদের পাশাপাশি এতে দর্শনার্থীদের জন্য আছে ১০,১১৪ বর্গফুটের সুবিশাল এক অ্যাপল স্টোর আর ২,৮৩৬ বর্গফুটের ক্যাফেও। অ্যাপল স্টোর আর ক্যাফের পাশাপাশি মূল ভবনের আশেপাশের খানিকটা ধারণাও পাবেন দর্শনার্থীরা, যদিও অনুমতি ছাড়া ভেতরে ঢুকতে বারণ!