আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। নতুন করে এই প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। যখনই আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নাম শুনি তখনই আমাদের মধ্যে কাজ করে এক অন্যরকম অনুভূতি। মাথায় আসে সোফিয়ার মতো রোবট, আলফা গো, অ্যামাজনের অ্যালেক্সা, গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট কিংবা সিরি-কর্টানার মতো ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট অথবা গুগল বা ওয়েমোর সেলফ ড্রাইভিং কারসহ আরো অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান, সফটওয়্যার কিংবা রোবটের নাম। কিন্তু এই প্রযুক্তির সাথে যখনই গুগলের নাম আসে, তখনই আসে একটু নড়েচড়ে বসার পালা।
প্রতিনিয়ত সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে আমাদের কাজের ব্যস্ততা। আর এত ব্যস্ততার মধ্যে অনেক সময় আবার দরকার পড়ে কারো সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা বুকিং দেয়ার কাজ। কিন্তু বুকিংয়ের অনলাইন সুবিধা না থাকলে দ্বারস্থ হতে হয় ফোন কলের। ব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়ে যাবার সময় কখনো ভেবে দেখেছেন কি আপনার ফোনের মাধ্যমে কারো সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা কিংবা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রেস্টুরেন্ট বা হোটেলে সিট বুক করার মতো একঘেয়ে কাজগুলো যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কোনো যন্ত্র আপনার হয়ে করে দিতো, তাহলে কেমন হতো?
আপনি এ ব্যাপারে না ভাবলেও গুগল আপনার কথা ভেবে তৈরি করেছে এমনই এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। নাম তার গুগল ডুপ্লেক্স। গত ৮ মার্চ শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী গুগল আই/ও-২০১৮ সম্মেলনে ডুপ্লেক্সের ঘোষণা দেয় টেক জায়ান্ট গুগল। ফোন কলের মাধ্যমে কারো সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট, রেস্টুরেন্ট বা হোটেল বুকিং, বা কোনো প্রতিষ্ঠানের সার্ভিসের জন্য অর্ডারের কাজটি আপনার হয়ে করে দেবে গুগল ডুপ্লেক্স। তবে সব থেকে মজার আর অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটি জানবেনও না যে তিনি মানুষ নয়, বরং একটি এআই-এর সাথে কথা বলছেন!
কিন্তু কী এমন আছে এই ডুপ্লেক্সে যাতে রীতিমতো সাড়া পড়ে গেল? আর কীভাবেই-বা কাজ করে গুগল ডুপ্লেক্স? কীভাবে আপনার উপকারে আসতে পারে মানুষরূপী এই এআই? আপনাকে কোনো ধরনের সমস্যায় ফেলবে না তো এ প্রযুক্তি? নাকি ফোনের কথার রাজ্যে মানুষের জায়গাটা দখল করে নেবে ডুপ্লেক্স? এসবেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো আমরা আজকের এই লেখায়।
গুগল ডুপ্লেক্স
গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই এর তথ্যানুযায়ী, কেবল যুক্তরাষ্ট্রতেও প্রায় ৬০ শতাংশ ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো অনলাইন বুকিং সুবিধা নেই। আর তার বিকল্প হিসেবে থাকে ফোন কলের মাধ্যমে বুকিং। কখনো কখনো অনেক প্রয়োজনীয় সময় ব্যয় হয় অনেকের এই ফোনকলগুলো করতে। কিন্তু এখন এই ফোনকলগুলো আপনার হয়ে করে ফেলবে ডুপ্লেক্স। না, শুধু কি-প্যাডে নাম্বার ডায়াল করা নয়, আপনার হয়ে কথা বলবে ডুপ্লেক্স। শুধু আপনাকে করতে হবে একটি ভয়েস কমান্ড।
পুরো বিষয়টি পরিষ্কারভাবে জানতে এবারে গুগল ডুপ্লেক্সের একটি আসল ভিডিও ডেমো দেখা যাক, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রধান চমক।
ভিডিওটিতে দেখা যায় লিসার হয়ে ফোন কলের মাধ্যমে একটি স্যালুনে হেয়ারকাট অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে দেয় গুগল ডুপ্লেক্স। সব থেকে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটি টেরই পাননি আদতে তিনি একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সত্ত্বার সাথে এই মাত্র অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করলেন। শুধু তা-ই নয়, কথোপকথনের সময় অবিকল মানুষের মতো করেই কথা বলে ডুপ্লেক্স।
কথা বলার ভঙ্গিমা, কথার মাঝে কিছুটা বিরতি, কথায় ফুটে ওঠা বিভিন্ন রকমের অভিব্যক্তি সবকিছু ডুপ্লেক্সকে দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা।
কথা বলার সময় “উহু”,”হুম” এই সকল অভিব্যক্তিগুলো মানুষের মতো করে অনুকরণ করতে বিন্দুমাত্র ভুল করেনি গুগলের এআই। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, যেকোনো জটিল অবস্থাতে কথোপকথন চালিয়ে যেতে সক্ষম গুগল ডুপ্লেক্স। কখনো কখনো পরিস্থিতি যদি কাঙ্ক্ষিত মাত্রার বাইরে চলে যায়, তবুও সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় এই এআই। আর যদি কোনোভাবেই পরিস্থিতি ডুপ্লেক্স সামলাতে না পারে, সেক্ষেত্রে সাহায্য নেয় একজন মানব অপারেটরের। আর শিখে নেয় কীভাবে পরবর্তীতে এই পরিস্থিতি সামাল দেবে।
সুন্দর পিচাইয়ের তথ্যানুসারে, ডুপ্লেক্স ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটির কথার তারতম্য খুব সহজেই ধরতে পারে। আর স্বাভাবিক কথাবার্তা খুব সহজেই বুঝে ফেলে। একটি কথার পর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে সেটিও বুঝে যায় ডুপ্লেক্স। প্রশ্নের পর উত্তর অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া জানাতে কোনো অতিরিক্ত সময় নেবে না। পুরো ব্যাপারগুলো প্রসেস হতে লাগবে মাত্র কয়েক মিলিসেকেন্ড থেকে সেকেন্ড। সত্যিই আশ্চর্য হবার মতোই এক উদ্ভাবন।
কীভাবে কাজ করে?
গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট এর সাহায্যে আপনি যদি বলেন, রাত ৮টায় অমুক রেস্টুরেন্টে আপনার জন্য ডিনার টেবিল রিজার্ভ করতে, তবে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেই কাজটি দিতে দেবে ডুপ্লেক্সকে। ব্যস, আপনার কাজ এখানেই শেষ। ডুপ্লেক্স তার কাজ করতে থাকবে ব্যাকগ্রাউন্ডে। তবে যদি কাঙ্ক্ষিত সময়ে বুকিং না থাকে, তবে এর কাছাকাছি কোনো সময়ে বুক করে ফেলবে ডুপ্লেক্স। তার কাজ শেষে আপনার কাছে চলে আসবে নোটিফিকেশন।
গুগল এই জাদুর কাঠি তৈরি করতে ব্যবহার করেছে মেশিন লার্নিং, ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্ক, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং এবং অ্যাডভান্স টেক্সট টু স্পিচ। এছাড়াও জটিল সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য ব্যবহার করেছে রিকারেন্ট নিউরাল নেটওয়ার্ক (আরএনএন)। এটি হলো আর্টিফিসিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্কের একটি শ্রেণী। ব্যবহার করা হয়েছে গুগলের নিজস্ব ফ্রেমওয়ার্ক টেনসরফ্লো এক্সটেন্ডেড। আরএনএন ব্যবহার করে ডুপ্লেক্সকে অনেক ট্রেনিং দেয়া হয়েছে বাস্তব জীবনের মানুষের সাথে মানুষের ভয়েস কলের মাধ্যমে। বাস্তব জীবনে এসবের ব্যবহার অনেক জটিল এবং বিস্তর ধারণা পেতে থাকা চাই প্রোগ্রামিং এবং এআই সম্পর্কিত জ্ঞান।
কথা বলার সময় মানুষ সবথেকে জটিল বাক্য ব্যবহার করে। অনেক সময় পুরো বাক্যটাও শেষ করে না। কথার মধ্যে অনেক সময় ব্যবহার করে বিভিন্ন অভিব্যক্তি, কথার মাঝে কথা তৈরি করে জটিলতা। আমাদের মানুষের সাথে মানুষের কথোপকথনে তা সমস্যা তৈরি না করলেও এতদিন মেশিনের পক্ষে তা বুঝতে পারা ছিল বেশ কষ্টকর। তবে এসব সমস্যাকে ডুপ্লেক্স যেন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হয়ে উঠতে পেরেছে আরো বুদ্ধিমান।
কিন্তু কেন ব্যবহার করবো ডুপ্লেক্স?
এখন পর্যন্ত গুগল ডুপ্লেক্স তিন ধরনের কাজ করতে সক্ষম। রেস্টুরেন্ট রিজার্ভেশন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা এবং অর্ডার করা বা কোনো বিজনেস কোম্পানির ছুটির দিনের ওপেনিং টাইম জানা। গুগলের মতে, এগুলো সবই ক্লোজড ডোমেইনের অন্তর্গত। অর্থাৎ বিশেষ এই কাজগুলোর বাইরে বেশি কিছু করতে পারবে না।
আপনি যদি না চান আপনার মূল্যবান সময়টা এই ধরনের ফোনকলের পেছনে নষ্ট না করতে, তবে ডুপ্লেক্স আপনার জন্য সহজ সমাধান। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থাটা আরো সহজ করার লক্ষ্যই হলো ডুপ্লেক্সের। অনেক সময় কোনো সেবাদানকারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অনলাইনে থাকা তথ্য পর্যাপ্ত হয় না কিংবা কাঙ্ক্ষিত তথ্য থাকে না। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির সাথে যোগাযোগের প্রয়োজন পড়ে। ভাবুন তো একবার, ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবেন, সাথে লাঞ্চও সেরে ফেলবেন কোনো রেস্টুরেন্টে। কিন্তু তাদের ছুটির দিনে খোলার সময় জানা নেই আপনার। আপনি নিশ্চয়ই অনলাইনে বুকিং করা কিংবা ছুটির দিনের খোলার সময় খোঁজার জন্য সময় নষ্ট করবেন না, যদি আপনার কাছে থাকে ডুপ্লেক্স।
রেস্টুরেন্ট রিজার্ভের ডেমো দেখুন নিচের ভিডিওতে। এখানে পুরুষ কণ্ঠের এআই খুব সহজেই জটিল একটি পরিস্থিতি সামলে নেয়।
আবার যদি কোনো বিশেষ মুহূর্তে মনে পড়ে সে কথা, কিন্তু কল করার মতো সময় নেই হাতে। তখন কী করবেন আপনি?
কিন্তু এত বিস্ময়ের মাঝে মনে প্রশ্ন আসার কথা, ঠিক কতটা নিরাপদ এই প্রযুক্তি? আর মানুষের জায়গাটা কি তবে দখল করে নিতে চলেছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?
সম্ভাবনা নাকি শঙ্কা?
ডুপ্লেক্স কি তবে এতদিনের শঙ্কা আর বিজ্ঞান কল্পগল্পের সেই চিরচেনা কাহিনীকে সত্য করে মানুষের জায়গাটা দখল করে নিতে চলেছে? একদিক থেকে আপনার বেশ উপকারী হলেও, মনে অনেক প্রশ্ন আর শঙ্কার ঝড় তোলে এই গুগল ডুপ্লেক্স।
এতদিনের এআইগুলো ব্যবহারের সময় মানুষ জানতো, তারা একটা এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করছে। কিন্তু ডুপ্লেক্সের বেলায় আপনি জানলেও ফোনের ওপাশে থাকা কর্মচারী জানতে পারছেন না তিনি একজন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে কথা বললেন! এখানেই আসছে নীতিগত প্রশ্ন। আপনার কি তবে জানার অধিকার নেই, আপনি কার সাথে কথা বললেন? আবার আপনার অগোচরেই চলছে ডুপ্লেক্সের ফোনালাপ, এমন দিন কি তবে বেশি দূরে নেই যখন নিজে থেকেই ডুপ্লেক্সের মতো এআই নিজে থেকেই ফোনে যোগাযোগ বলবে অন্য কোনো এআই এর সাথে? এখানে আপনার তথ্যের নিরাপত্তা কতটুকু? ফেসবুক আর ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার মতো তথ্য ফাঁসের কেলেঙ্কারিতে ডুপ্লেক্সও জড়িয়ে পড়বে না তো?
আগেই বলা হয়েছে ডুপ্লেক্স একটি ক্লোজড ডোমেইন। নির্দিষ্ট কিছু কাজের বাইরে অন্য কাউকে কল করার ক্ষমতা এটি রাখে না। আর তাই রিজার্ভ বা বুক করার মতো কাজ ছাড়া এটি আপনার বন্ধু বা মায়ের সাথে অনায়াসে কথা বলতে পারবে না। কিন্তু উন্নতির পথে থাকা ডুপ্লেক্সের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা এখনো অজানা।
গুগল যদিও ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা জানিয়ে দেবে সেটি আপনি মানুষের সাথে কথা বলছেন, নাকি কোনো ডুপ্লেক্স। কিন্তু ডেমোতে এ ব্যাপারে কিছুই দেখানো হয়নি। পাশাপাশি গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টের জন্য তারা উন্মুক্ত করেছে নতুন ৬টি ভয়েস। এছাড়া একেবারে ডেমোতে যেভাবে দেখানো হয়েছে ডুপ্লেক্সকে, ঠিক সে সাজেই পাওয়া যাবে না উন্মুক্ত হবার পর।
কিন্তু ডুপ্লেক্স এখনো রয়েছে উন্নতি প্রক্রিয়ার মধ্যে। ঠিক কবে নাগাদ সবার জন্য উন্মুক্ত করা হবে, তা এখনও জানায়নি গুগল। আসতে পারে নতুন রূপে আরো নতুন ফিচার নিয়ে, যোগ হতে পারে নিরাপত্তার নিশ্চয়তামূলক ফিচার। কিন্তু নিরাপত্তামূলক কোনো তথ্য এখনো স্পষ্ট করে জানায়নি তারা।
দিনে দিনে বাড়ছে প্রযুক্তির পরিধি। সারা বিশ্ব ঝুঁকছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দিকে। এর যেমন আছে নানা অসম্ভব রকমের ভালো দিক, তেমনি আছে ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ দিক। এর শেষটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা সবার কাছেই এক রহস্য? মানুষ আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মিলেমিশে তৈরি হবে নতুন এক পৃথিবীর, নাকি পরাজয় বরণ করেই ঘটবে মানব ইতিহাসের সমাপ্তি?
ইন্টারনেট দুনিয়া বিশাল এক তথ্যভাণ্ডার। এ তথ্যের নিশ্চয়তা/অনিশ্চয়তা এতদিন কেবল সীমাবদ্ধ ছিল ইন্টারনেট দুনিয়াতে। কিন্তু ভ্রান্তি এখন ছড়িয়ে পড়লো বাস্তব জগতেও। আপনার কি মনে হয়? ডুপ্লেক্স কি সীমা অতিক্রম করে পাড়ি দেবে ভয়ঙ্কর কোনো ভবিষ্যতের দিকে, নাকি বয়ে আনবে আরো উন্নত এক যুগ?