নিজের শয়নকক্ষটিকে সুন্দর করতে ভালো ইন্টেরিয়র ডিজাইন যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি পর্যাপ্ত প্রাযুক্তিক ব্যবস্থা, যা শয়নকক্ষকে করবে আরো আরামদায়ক, আরো অধিক বসবাসোপযোগী। শয়নকক্ষের সকল সাজসজ্জা আর পরিকল্পনার কেন্দ্রেই থাকে মূলত ঘুমানোর জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ গড়ে তোলা। সুন্দর, পরিপাটি একটি শয়নকক্ষকে চমৎকার কিছু বেডরুম গ্যাজেটই পারে পরিপূর্ণতা দিতে। ঘুমের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করা থেকে শুরু করে শয়নকক্ষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি- সবই করবে এসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। চলুন তাহলে জেনে নিই এমন কিছু প্রযুক্তি সম্পর্কে।
এলেক্সা
অ্যামাজন ইকো, অ্যামাজন এলেক্সা কিংবা শুধু এলেক্সা- যে নামেই ডাকুন না কেন, এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিটি কিন্তু শয়নকক্ষে আপনার জীবনকে আরেকটু সহজ করে তুলবার জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করা বা খোলা থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক বাতির তীব্রতা কমানো কিংবা নিভিয়ে দেয়া, ফ্যান/এসি চালু বা বন্ধ করা, ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, টেলিভিশনের চ্যানেল বদল, সকালে ঘুম থেকে জাগানো, দরজার বাইরে কে দাঁড়িয়ে আছে দেখা, ঘুমের সময় প্রশান্তিদায়ক গান বাজানো- কী না করতে পারে এই যন্ত্র? বিছানায় শুয়ে, পড়ার টেবিলে বসে কিংবা ল্যাপটপে কাজ করতে করতে কেবল দু-চারটি শব্দ খরচ করেই এতসব কাজ করিয়ে নেয়া যায় এই ডিভাইসটি দিয়ে।
প্রোগ্রামেবল থার্মোস্ট্যাট
যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার ঘরের আদর্শ তাপমাত্রা কত রাখতে চান, একটি সংখ্যায় উত্তর দিতে পারবেন কি? খুব সম্ভবত পারবেন না, কারণ তাপমাত্রার চাহিদা দিনের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন হয়। বিশ্রাম বা কাজের ভিত্তিতে মানুষের শারীরিক তাপমাত্রা সর্বক্ষণ ওঠানামা করে। তাই, একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা কখনোই আরামদায়ক হতে পারে না। প্রয়োজন চাহিদা মোতাবেক পরিবর্তন। আর এ পরিবর্তনের কাজটিই করে দেবে একটি স্মার্ট ডিভাইস যার নাম ‘প্রোগ্রামেবল থার্মোস্ট্যাট’।
এই ডিভাইসটি শুধু যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করবে তা-ই নয়, এটি ব্যবহারকারীর ব্যবহার থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী সময়ে নিজে থেকেই ব্যবহারকারীর পছন্দসই তাপমাত্রার ব্যবস্থা করে। যেমন, প্রোগ্রামেবল থার্মোস্ট্যাট স্থাপন করার পর প্রথমদিন সকালবেলা ঘরে যে তাপমাত্রা সেট করবেন, যন্ত্রটি সেই তথ্য মনে রাখবে এবং পরদিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে তাপমাত্রা সেট করে দেবে! এছাড়াও, মোবাইলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা থাকায় এই ডিভাইসটি হয়ে উঠেছে আরো ব্যবহার বান্ধব।
সানলাইট ওয়েকআপ অ্যালার্ম
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে রাত জাগা এখন মানুষের নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর এ কারণে সকালে সঠিক সময়ে ঘুম থেকে ওঠা একটি বড় হ্যাপার নাম। একাধিক অ্যালার্মের ব্যবস্থা করেও অনেকে ঘুম থেকে উঠতে পারছেন না। অনেকে আবার আধো ঘুমে অ্যালার্ম বন্ধ করে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়েন। এই বিড়ম্বনা থেকে বাঁচাতে পারে সানলাইট ওয়েকআপ অ্যালার্ম নামক একটি সহায়ক গ্যাজেট।
সানলাইট ওয়েকআপ অ্যালার্ম মূলত কোনো শব্দ করবে না। বরং সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে আপনার ঘুম ভাঙাতে সহায়তা করবে। মানবদেহে এমন এক জৈবিক ব্যবস্থা রয়েছে যা সূর্যালোকে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। সানলাইট ওয়েকআপ অ্যালার্ম সেই জৈবিক ব্যবস্থাটিকেই কাজে লাগায়। এটি যথাসময়ে সূর্যের আলোর মতো প্রখর আলোয় জ্বলতে শুরু করবে এবং সময়ের সাথে আলোর তীব্রতা বাড়তে থাকবে। ফলে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ব্যবহারকারীর ঘুম ভাঙতে বাধ্য। অ্যামাজনের ফিলিপস সানলাইট অ্যালার্ম এখন বাজারে সবচেয়ে জনপ্রিয়।
স্লিপ ট্র্যাকার
প্রতিদিন অনেকটা সময় মোবাইল আর কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখ রাখার কারণে রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। আর নিয়মিত ঘুমের সমস্যায় তৈরি হয় নানারূপ শারীরিক জটিলতা। বিশেষকরে, দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থেকেও পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়াটা একটি বড় সমস্যা। অনেকেই এ সমস্যা ধরতে পারেন না। তাদের জন্য বাজারে এসেছে অত্যাধুনিক গ্যাজেট স্লিপ ট্র্যাকার।
এই ডিভাইসটি ব্যবহারকারীর ঘুমের দৈর্ঘ্য, মান, বিভিন্ন স্তর সহ ঘুম সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে। এসব তথ্য সংগ্রহ করার পাশাপাশি স্লিপ ট্র্যাকার এটাও বলে দেয় যে রাতের কোন সময়ে ব্যবহারকারী ঘুমের কোন স্তরে ছিল, কীরূপ ব্যাঘাত ঘটেছিল, সে স্তরের দৈর্ঘ্য কতটুকু হওয়া উচিৎ ছিল। আর এসব তথ্য থেকে ব্যবহারকারী জানতে পারেন নিজের ঘুমের মান উন্নয়নের জন্য করণীয়।
ভরযুক্ত কম্বল
এসি চালু করে ঘরের তাপমাত্রা নামিয়ে এনে কম্বল দিয়ে ঘুমোতে কার না ভালো লাগে? তবে এই ভালো লাগাটা সর্বোচ্চ হতে পারে একপ্রকার ভরযুক্ত কম্বলের কল্যাণে, যা কি না রাতের ঘুমকে অধিকতর আরামদায়ক করার নিমিত্তে প্রস্তুত করা হয়েছে। অত্যন্ত মসৃণ এ কম্বল গায়ে দিলে মনে হবে যেন কেউ আরামদায়কভাবে আলিঙ্গন করে আছে। এরকম ভরযুক্ত কম্বলের বাজারে বর্তমানে গ্রাভিটি ব্লাংকেট সবচেয়ে জনপ্রিয়।
কুশিয়ন ব্লুটুথ স্পিকার বালিশ
গ্যাজেট হিসেবে বালিশ স্পিকার নতুন নয়। তবে, কুশিয়ন বালিশ স্পিকার এই শ্রেণির প্রথম স্মার্ট স্পিকার। এর কার্বন নির্মিত অ্যাকাউস্টিক ফোমগুলো শব্দ উৎপন্ন করায় অত্যন্ত দক্ষ এবং বুদ্ধিমান। বাজারের অন্যান্য স্পিকার বালিশে সাধারণত স্মার্টফোনের মাধ্যমে শব্দের ভলিউম বাড়ানো-কমানো যায়। কিন্তু কুশিয়ন স্মার্ট স্পিকার বালিশ নিজে থেকেই বুঝতে পারে ব্যবহারকারীর চাহিদা এবং সে অনুযায়ী ভলিউম পরিবর্তন করে।
যেমন- স্মার্টফোনে সংযোগ থাকাকালীন কারো ফোন আসলে ব্যবহারকারী যদি বালিশে শুয়ে পড়েন, তাহলে মোবাইল কানে রাখার মতো পরিমেয় শব্দ তৈরি করবে এই স্মার্ট বালিশ। আবার, দীর্ঘক্ষণ কথা বলার সময় ব্যবহারকারী বালিশটিকে কোলে নিয়ে বসতে পাড়েন। তাতে শব্দের মাত্রাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে এমন হয়ে যাবে যেন ব্যবহারকারীর কান পর্যন্ত তা পৌঁছায়। বালিশটিকে নড়াচড়া না করে বিছানায় বা সোফায় রেখে দিলে এর ভলিউম আপনা থেকেই বেড়ে যায়। অবশ্য, প্রতি ক্ষেত্রেই ব্যবহারকারী ম্যানুয়ালি ভলিয়ুম পরিবর্তন করতে পারবেন।
ড্রিমপ্যাড অ্যাডভান্সড স্মার্ট মিউজিক পিলো
নিজের আশেপাশের লোকজনের সমস্যা না করে গান শোনার উপায় কী? অবশ্যই ইয়ারফোন। কিন্তু ঘুমের আগে ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে রাখতে অনেকসময় অস্বস্তি হয়। এক্ষেত্রে সমাধান মিউজিক পিলো। স্পিকার বালিশের চেয়েও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত এই মিউজিক বালিশগুলো ব্যবহারকারীকে গান শোনাবে ইন্ট্রা-সাউন্ড পদ্ধতিতে। এ পদ্ধতিতে শব্দ কম্পনে রূপান্তরিত হয়ে বালিশে শুয়ে থাকা ব্যক্তির কানের গভীরে প্রবেশ করবে ‘বোন-কন্ডাক্টর’ পদ্ধতিতে। ফলে তৈরি হবে অত্যন্ত মোলায়েম এবং প্রশান্তিদায়ক শব্দ যা পাশের ব্যক্তির কানে পৌঁছুবে না।
অরিও স্মার্ট ল্যাম্প
অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এ গ্যাজেটটি শহুরে ঘিঞ্জি ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দাদের জন্য, যাদের দিনের বেলাতেও বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। সাধারণ বৈদ্যুতিক বাতির মতো সারাক্ষণ একই তীব্রতায় জ্বলবে না এই ল্যাম্প। দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তীব্রতায় জ্বলবে অরিও স্মার্ট ল্যাম্প। শুধু তা-ই নয়, আলোর তীব্রতা পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবর্তিত হবে দিকও! এতে করে কৃত্রিম আলোক ব্যবস্থাও ব্যবহারকারীর নিকট অনেকটাই প্রাকৃতিক মনে হবে।
ডাইসনের পার্সোনাল পিউরিফায়িং ফ্যান
পৃথিবীর বড়বড় মেগাসিটিগুলোতে, যেখানে বায়ু দূষণ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, পিউরিফায়িং ফ্যান সেখানে ক্রমেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এই ফ্যানগুলো বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে ৯৯ শতাংশ ধূলিকণা, দূষক পদার্থ, নানারূপ অ্যালার্জেন, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি আটকে ফেলে এবং দূষণমুক্ত বাতাস দেয়। তবে ডাইসনের পিউরিফায়িং ফ্যানটির বিশেষত্ব হলো এই যে এটি বাতাস দেবার ক্ষেত্রে নিশানা নির্দিষ্ট করে দিতে পারে। অর্থাৎ, একই ঘরে একাধিক ব্যক্তি উপস্থিত থাকলেও এই ফ্যান কেবল যাদের প্রয়োজন তাদের লক্ষ করে বাতাস দিতে পারে। চাইলে বাতাসের পরিধি বৃদ্ধি বা কমানো যায় এবং দিক পরিবর্তন করা যায়।
মোশন অ্যাক্টিভেটেড বেড লাইট
একই শয়নকক্ষে একাধিক মানুষ ঘুমালে প্রধানত দুটি সমস্যা হয়। একটি গান শোনার সমস্যা যেটি স্মার্ট মিউজিক বালিশ দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। আরেকটি হলো বিছানা থেকে উঠতে গেলে আলো জ্বালানোর সমস্যা। শুয়ে পড়ার পর কোনো প্রয়োজনে উঠতে হলে বাতি জ্বালানোর প্রয়োজন হয়। আর তাতে সমস্যা হয় পাশেরজনের। এ সমস্যার সমাধান দিচ্ছে আরেকটি স্মার্ট গ্যাজেট, মোশন অ্যাক্টিভেটেড বেড লাইট। কেউ বিছানা থেকে নামলে তার নড়াচড়া টের পেয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিছানার পাশের স্মার্ট বাতিগুলো জ্বলে উঠবে, যেগুলোর আলো সহনীয় মাত্রায় থাকবে এবং কেবল মেঝে আলোকিত করবে।
অ্যান্টি-স্নোর পিলো
কয়েকজন একত্রে ঘুমানোর আরেকটি বড় সমস্যা হলো নাক ডাকা। বিছানায় পাশের ব্যক্তি যদি ঘরঘর শব্দে নাক ডাকতে শুরু করেন, তাহলে ঘুমের বারোটা বাজে বৈকি। অবশ্য নাক ডাকতে থাকা ব্যক্তিকে আলতো করে ধাক্কা দিলেই তিনি নড়াচড়া করেন এবং নাক ডাকা বন্ধ করেন। তাই বলে সারা রাত বসে বসে পাশের জনের নাক ডাকা বন্ধ করবেন?
অবশ্যই না। শয়নকক্ষের সবচেয়ে ব্যবহার উপযোগী গ্যাজেটগুলোর মধ্যে একটি হলো স্মার্ট অ্যান্টি-স্নোর পিলো, যা নাক ডাকা রোধের দায়িত্ব পালন করবে। এ বালিশের উপর শুয়ে থাকা ব্যক্তি যখনই নাক ডাকতে শুরু করবেন, তৎক্ষণাৎ বালিশটির স্মার্ট সেন্সর নাক ডাকার শব্দ সনাক্ত করে ফেলবে। তখন এর ভেতরে থাকা একটি ছোট এয়ারব্যগ বায়ুপূর্ণ হয়ে যাবে এবং প্রায় সাথে সাথেই বায়ুশূন্য হবে। ফলে ঘুমন্ত ব্যক্তি খানিকটা ঝাঁকুনি অনুভব করে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করবেন এবং নাক ডাকাও বন্ধ করবেন।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো: