অন্যান্য প্রকৌশল বিভাগগুলোর তুলনায় সিভিল বা পুরকৌশল বিভাগেই সম্ভবত প্রযুক্তির প্রয়োগ এযাবৎ কম হয়েছে। পরিবহন এবং যোগাযোগ প্রকৌশলে গত পনের বছরে প্রযুক্তির প্রয়োগ, বিশেষ করে ডাটা অ্যানালাইসিস এবং সেন্সরের উপর নির্ভরশীলতা দেখা গেলেও সিভিলের অন্যান্য শাখাতে খুব বেশি প্রয়োগ দেখা যায়নি।
অবকাঠামোর নিরাপত্তা এবং কাঠামোর কোথায় কতটুকু ফাটল ধরলো সে বিষয়ে কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু সিভিলের অন্য শাখাগুলোতে তথ্য-প্রযুক্তির প্রয়োগ কম দেখা গিয়েছে। অথচ পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে যখন কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নতি হওয়া শুরু হলো, তখন সিভিল ইঞ্জিনিয়াররাই চমৎকার সব ব্যবহারিক কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করেছিলেন। তবে আশার কথা হচ্ছে ইদানীং পুরকৌশল বিভাগে প্রচুর প্রযুক্তির প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে এই বিভাগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিংয়ের প্রয়োগ চোখে পড়ার মতো।
একটি বিল্ডিং কিংবা ব্রিজ নির্মাণ করার স্থানে নিরাপত্তা রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সত্যি বলতে কি, যেকোনো কন্সট্রাকশন সাইটেই নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কন্সট্রাকশন সাইটে অনিরাপত্তাজনিত কারণে সেখানে কাজ করা শ্রমিকরা অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকদের তুলনায় সংখ্যায় প্রায় পাঁচগুণ বেশি মৃত্যুবরণ করে। এটা একটি বিপদসংকেত ছাড়া কিছু নয়।
নিরাপত্তা রক্ষার্থে এবং সাইটে কাজের গতি দ্রুত করতে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের সাফোক (Suffolk) নামক একটি প্রতিষ্ঠান তাদের কন্সট্রাকশন সাইটের জন্য ডাটা সায়েন্টিস্ট নিয়োগ দিচ্ছে। এই সায়েন্টিস্টদের কাজ হবে এমন কিছু এলগরিদম তৈরি করা যেগুলো সাইটের বিভিন্ন কাজের ছবি তুলে সেগুলোর ইমেজ প্রসেসিং করবে। এই ইমেজ প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে কন্সট্রাকশন সাইটে শ্রমিকদের নিরাপত্তা লক্ষ্য করা হবে। যেমন- সাইটে কেউ যদি হেলমেট পরে না আসে তাহলে সেটা এই এলগরিদম শনাক্ত করবে। যেকোনো কন্সট্রাকশন সাইটে একেক কাজের জন্য একেক রঙের হেলমেট পড়তে হয়। কোনো ব্যক্তি ভুল হেলমেট পরে এসেছে কিনা সেটাও শনাক্ত করা যাবে এই এলগরিদমের মাধ্যমে।
এই এলগরিদমকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হবে। সেটা হচ্ছে কেউ যদি সাইটের নিরাপত্তার নিয়ম না মেনে কাজে চলে আসে তাহলে কাজ করার সময় তার বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু এবং কী ধরনের বিপদ তার হতে পারে সেটার সম্ভাব্যতা বের করতে পারবে এই এলগরিদম। এর ফলে কন্সট্রাকশন সাইটে আগে থেকেই শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া সম্ভবপর হবে। আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিংয়ের ক্ষমতা দিন দিন এত করে বৃদ্ধি পাচ্ছে যে আমাদের কাছে যদি আগের বছরের ডাটা বা উপাত্ত থাকে তাহলে খুব সহজেই বর্তমান কোনো ঘটনার জন্য ভবিষ্যতে কী ফলাফল হতে পারে সেটার সম্ভাব্যতা বের করা যায়।
সাফোক নামের এই প্রতিষ্ঠানের কথাই ধরা যাক। তারা ডাটা সায়েন্টিস্ট নিয়োগ করছে। তাদের প্রধান কাজ হবে এই প্রতিষ্ঠানে এর আগে আগে কী কী দুর্ঘটনা ঘটেছে, কীভাবে ঘটেছে, কোন সময় ঘটেছে এবং এর ফলে কী কী হয়েছে সেগুলোর উপাত্ত ব্যবহার করা এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করা।
একটি উদাহরণ দিলে এই কাজটি বোঝা যাবে। ধরা যাক, সাফোকের তৈরি এই এলগরিদম শনাক্ত করলো যে সাইটে একজন হলুদ রঙের হেলমেট পরে আসেনি। এই হলুদ রঙের হেলমেট যারা পরে তাদের কাজ হয় বিল্ডিংয়ে কনক্রিট কাস্টিং অর্থাৎ ঢালাই করা। এটা শনাক্ত করার পর এলগরিদমটি আগের ডাটার মধ্যে খুঁজতে থাকবে যে হলুদ রঙের হেলমেট না পরে আসার কারণে এর আগে এই প্রতিষ্ঠানে কী ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং কোন ধরনের কাজ করার সময় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। সাথে সাথে সেই এলগরিদমটি কয়েকটি শ্রেণীবিভাগ করে ফেলবে এবং সেখানে উল্লেখ করা থাকবে যে কোন ধরনের বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, বিপদের কারণে কী কী হতে পারে, বিপদ এড়ানোর জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে ইত্যাদি। এরকম এলগরিদম প্রস্তুত করতে পারলে কন্সট্রাকশন সাইটের ঝুঁকির তালিকা প্রস্তুত করা সম্ভব এবং সর্বক্ষণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত খবর সাইটেই সম্প্রচার করা সম্ভব। এতে নিরাপত্তা অনেকাংশেই নিশ্চিত হয়।
শুধু নিরাপত্তাই নয়, সাফোক আরও একটি এলগরিদম প্রস্তুত করছে যেটা গত দশ বছরের কাজের শিডিউলের ডাটা ব্যবহার করবে এবং প্রতিষ্ঠানের কোনো কন্সট্রাকশন প্রজেক্ট শেষ হতে কতটুকু দেরি হবে এবং কী কারণে সেই দেরি হতে পারে সেটার সম্ভাব্যতা বের করবে। এসব কাজ ডাটা সায়েন্টিস্ট ছাড়া সম্ভব নয়। তবে অনুমান করা যায় যে, ভবিষ্যতে পুরকৌশল বিভাগে যারা পড়াশোনা করবে তাদের কাজ হবে এই ব্যাপারগুলো নিজেদের থেকে করতে শেখা।
তথ্য-প্রযুক্তির আরেকটি বিষয় সাফোক ব্যবহার করছে, সেটা হচ্ছে কনক্রিট যে গাড়িতে করে কন্সট্রাকশন সাইটে নিয়ে আসা হয় সেই গাড়িগুলোর গতিবিধি শনাক্ত করা। এরকম করার উদ্দেশ্য হচ্ছে সাইটে যেসব শ্রমিক আছে তাদেরকে যেন আগে থেকে প্রস্তত করা যায়। এতে কংক্রিট বহন করা গাড়ি আসার সাথে সাথেই শ্রমিকরা পরিকল্পনা এবং অনুসূচী অনুসারে কাজ শুরু করে দিতে পারবে। এতে সময়ের অপচয় কম হবে। কারণ আগে দেখা যেত কংক্রিটবাহী এই গাড়ি আসার বেশ কিছুক্ষণ পরে ঢালাইয়ের কাজ শুরু হচ্ছে, এতে সময়ের অপচয় হতো অনেক।
এই ধরনের তথ্য-প্রযুক্তির প্রয়োগ আগে কখনও হয়নি। সাফোকের এই কাজের সাথে জড়িত সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান JBKnowledge এর প্রধান নির্বাহী জেমস বেনহাম বলেছেন, “অনেকেই এ ধরনের কাজ সম্পর্কে জানে। তারা এটাও জানে যে কীভাবে এই কাজগুলোকে বাস্তবে প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু আমরা শুধু জানিই না,বরঞ্চ আমরা সেটা প্রয়োগও করতে পারি। তবে বিভিন্ন কন্সট্রাকশন ফার্মগুলোকে তথ্য প্রযুক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে বোঝানো খুব কষ্ট। অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে মনে হয় এরকম করা শুধুই অর্থের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটি সেরকম নয়।”
বেনহামের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় বিশটি এমন অবকাঠামো নির্মাণ প্রতিষ্ঠান আছে যারা ডাটা সায়েন্স নিয়ে কাজ করছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সাধারণত তাদের প্রতিটি কাজের তথ্য-উপাত্তের খুঁটিনাটি সংগ্রহ করে রাখে। কিন্তু এগুলো ঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। যার জন্য এই ধরনের প্রতিষ্ঠান ঠিকভাবে তাদের কাজের এবং সাইটে নিরাপত্তার পূর্বাভাস দিতে পারে না।
সাফোক সাধারণত নির্মাণকাজের সবরকমের তথ্য, রিপোর্ট এবং সাইটের ছবি সংগ্রহ করে থাকে। তারা যখন তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য একজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয় তখন সেই ব্যক্তি কয়েজন ডাটা সায়েন্টিস্ট নিয়োগ দিয়েছিলো। তাদের মধ্যে অনেকে ছিল ডাটা ভিজুয়ালাইজেশন এক্সপার্ট, আইটি এক্সপার্ট এবং অপারেশন্স এক্সপার্ট। তাদের কাজ ছিল সাফোকের আগের বছরের ডাটাগুলো নিয়ে কিছু নিরাপত্তা বিষয়ে আগাম পূর্বাভাস দেয়া এবং কন্সট্রাকশন সাইটের রিয়েল-টাইম ভিডিও, ছবি ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে সেখানে নিরাপত্তা বিষয়ে নিয়মিত তথ্য প্রদান করা। সাইটে একটি ড্যাশবোর্ড রাখা থাকে যেখান থেকে প্রতিদিন শ্রমিক কর্মচারীরা পূর্বাভাস, নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদ, প্রতিদিনের কাজের শিডিউল, কে কী ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকবে, কতক্ষণ নিয়োজিত থাকবে, কন্সট্রাকশনের জন্য কতটুকু এবং কোথায় কাঁচামাল ব্যবহার করতে হবে ইত্যাদি সবধরনের তথ্য দেয়া থাকে। সে কারণে কন্সট্রাকশন সাইটে একটি নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি হয় এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদেরকে নিয়মিত নজরে রাখা যায়।
আমাদের দেশের অবকাঠামো নির্মাণের জায়গাগুলোতে নিরাপত্তা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। কিছু নামকরা রিয়েল এস্টেট কোম্পানি তাদের নির্মাণকাজের জায়গাগুলোতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখলেও অপেক্ষাকৃত মাঝারি এবং ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত লাভের আশায় নিরাপত্তার দিকে কোনো অর্থ খরচ করতে চায় না, যে কারণে প্রায়ই শ্রমিকদের দুর্ঘটনা ঘটে।
ফিচার ইমেজ সোর্স: machine learnings