১৯৪১ সালের কথা। ৭ই ডিসেম্বর সকালে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়োতে অবস্থিত সেনাবাহিনীর রাডারে একটি সিগন্যাল ধরা পড়ে। তড়িৎগতিতে রাডার অপারেটর ছুটে যান তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছে। তাকে জানান, রাডারের সংকেত অনুযায়ী কিছু বিমান এগিয়ে আসছে পার্ল হারবারের দিকে। বিমান হামলার মুখোমুখি হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিমান ও নৌ ঘাঁটিটি। কিন্তু তরুণ অপারেটরের কথা হেসেই উড়িয়ে দেন কর্মকর্তারা।
বস্তুত, সেসময় কেউই পার্ল হারবারে আক্রমণের প্রত্যাশা করেনি। তারা ভেবেছিল অনভিজ্ঞ অপারেটর হয়তো ভুলভাল কোনো কিছু দেখেছে অথবা সেগুলো আমেরিকান কোনো বিমানই হবে। এটি ছিলো পার্ল হারবারে জাপানের বিমান আক্রমণের এক ঘন্টা আগের কথা। হায়! সেসময় যদি তারা রাডারের তথ্যের ওপর ভরসা করতেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস হয়তো আজ অন্যরকম হতো।
এই রাডার প্রযুক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই বিকশিত হয়েছে। আর অল্প সময়ের মধ্যে হয়ে উঠেছে আকাশ যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারগুলোর একটি। রাডারের মাধ্যমে শত্রুদলের যুদ্ধবিমানের দিক চিহ্নিত করা যেত। আর সেই অনুসারে প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও নেয়া হতো। রাতের আঁধারে বা প্রতিকূল আবহাওয়ায় আক্রমণের ক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তুর সঠিক অবস্থানের নির্দেশনাও পাওয়া যেত রাডার থেকে।
আক্রমণ বা রক্ষণ উভয় ক্ষেত্রেই রাডারের ভূমিকা ছিল অপরিহার্য। এ অসাধারণ প্রযুক্তিটির কথা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এর ভূমিকা নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের লেখাটি।
রাডার কী? এটি কীভাবে কাজ করে?
রাডার (RADAR) শব্দটি ‘রেডিও ডিটেকটিং এন্ড রেঞ্জিং’ শব্দগুচ্ছের সংক্ষিপ্ত রূপ। নাম থেকেই রাডারের কাজের বিষয়ে কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। দূরবর্তী কোনো স্থানে কোনো বস্তুর উপস্থিতি আছে কিনা এবং থাকলে এর অবস্থান কোন দিকে, দূরত্ব কতটুকু- এসব বিষয় নির্ধারণ করাই হলো রাডারের কাজ। রাডার এ কাজটি করে রেডিও ওয়েভ এর মাধ্যমে।
রাডারের কর্মকৌশল বুঝতে হলে আমাদের একটু প্রতিধ্বনির বিষয়টি স্মরণে রাখতে হবে। প্রতিধ্বনির ক্ষেত্রে কী হয়? কোনো ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আপনি চিৎকার করলে, আপনার তৈরি করা শব্দ তরঙ্গ দূরের কোনো বস্তু থেকে বাধা পেয়ে আবার আপনার কাছে ফিরে আসে। এর ফলে আপনি আবার নিজের তৈরি করা শব্দটি শুনতে পান।
এখন এই শব্দ তরঙ্গটি প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসতে যে পরিমাণ সময় নেয়, সে তথ্যের দ্বারা আপনার এবং শব্দকে বাধা দেয়া বস্তুর মধ্যকার দূরত্বের পরিমাপ সম্ভব। ডপলার ইফেক্টের মাধ্যমে বাধা দেয়া বস্তুর গতিও নির্ণয় করা যায়। রাডারের ক্ষেত্রে ঠিক এই কৌশলটিই ব্যবহার করা হয়। প্রতিফলিত তরঙ্গের মাধ্যমে বস্তুর দূরত্ব ও গতি নির্ণয় করা হয়।
রাডার কোনো একটি নির্দিষ্ট দিকে শক্তিশালী, উচ্চ কম্পাঙ্কের রেডিও ওয়েভ (বেতার তরঙ্গ) সঞ্চারিত করে। এরপর ঐ তরঙ্গগুলোর আওতায় কোনো বস্তু; যেমন, জাহাজ বা বিমান আসলে এ তরঙ্গগুলো বাধাপ্রাপ্ত হয়, প্রতিফলনের মাধ্যমে ফিরে আসে রাডারে। এর মাধ্যমে রাডার বস্তুর উপস্থিতি নিশ্চিত করে। শুধু উপস্থিতিই নয়, রাডার আগমনকারী বস্তুর দূরত্ব,গতিবেগ, কৌণিক দূরত্বও নির্ণয় করতে পারে।
আর রাডার যেহেতু রেডিও ওয়েভ ব্যবহার করে, তাই রাতের আঁধার হোক বা প্রতিকূল আবহাওয়া হোক, এতে রাডারের কোনো সমস্যা হয় না। যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়াও রাডারের ব্যবহার অনেক। আকাশযানকে পথের দিশা দেয়া, আবহাওয়ার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা, সমুদ্রে অন্য জাহাজ বা সমতল ভূমির অবস্থান বের করা ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয় এই প্রযুক্তিটি।
রাডার উদ্ভাবন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগ থেকেই রেডিও ওয়েভ ব্যবহার করে কোনো বস্তুকে চিহ্নিত করার বিষয়টি নিয়ে কাজ করে আসছিলেন বিজ্ঞনীরা। যেমন ১৯০৪ সালে জার্মানিতে আবিষ্কৃত হয়, টেলিমোবাইলোস্কোপ নামক একটি ডিভাইস যা জাহাজের সংঘর্ষ প্রতিরোধ করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এর রেঞ্জ ছিল প্রায় তিন হাজার মিটার।
১৯২৫-২৬ সালে আমেরিকান ও ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা রেডিও ওয়েভ ব্যবহার করে পৃথিবীর আয়নোস্ফিয়ারের পরিমাপ করেন। এটিকে আদি রাডার বলা চলে।
১৯৩৪ সালের দিকে আমেরিকান নৌবাহিনীর গবেষকরা লক্ষ্য করেন, পটোম্যাক নদীতে প্রেরণ করা রেডিও ওয়েভগুলো জাহাজ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এরপর তারা এ নিয়ে আরো গবেষণায় অগ্রসর হন।
আধুনিক রাডার প্রযুক্তির উন্নয়নে স্যার রবার্ট ওয়াটসন ওয়াটের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৩৫ সালে তিনি তার রেডিও ডিভাইস দিয়ে সফলভাবে একটি আকাশযানকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন।
এ উদ্ভাবনের পথ ধরেই ১৯৩৭ সালে ব্রিটেনে সর্বপ্রথম রাডার নেটওয়ার্ক চেইন হোম প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই ছিল আধুনিক রাডারের চলার শুরু।
১৯৩৯ সাল নাগাদ, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, রাশিয়া সহ আরো অনেকগুলো দেশের রাডার প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রে রাডারের ভূমিকা
যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাডারের কাজকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়: ডিটেকশন ও ফায়ার কনট্রোল। ডিটেকশন রাডার একটি এলাকা জুড়ে আশেপাশের সকল বস্তুর একটি ইলেকট্রনিক মানচিত্র তৈরি করতো। এরপর এই মানচিত্রে বহিরাগত কোনো জাহাজ বা আকাশযানের আগমন ঘটলে তার অবস্থান চিহ্নিত করে দিতো।
সেই চিহ্নিত বিমানকে ধ্বংসের জন্য ভূমি থেকে যুদ্ধ বিমান পাঠানো হতো। এসব যুদ্ধবিমান পরিচালনা করতে এ রাডারকে অনুসরণ করতে হতো। কোনো জায়গায় বোমা হামলার জন্য প্রয়োজন হতো ভূখন্ডের মানচিত্র, যাতে করে প্রতিপক্ষের সর্বোচ্চ ক্ষতি নিশ্চিত করা যায়। এসব মানচিত্র তৈরি করতেও রাডার ব্যবহৃত হতো।
একদম প্রথম দিকে ব্রিটেনের চেইন হোম ছিলো এমন একটি রাডার নেটওয়ার্ক। ১৮৫ মাইল রেঞ্জের মতো। এটি খুব বেশি উন্নত ছিলো না, মাঝে মাঝে ভুল সংকেতও দেখাতো। তবে ব্যাটল অফ ব্রিটেন-এর সময় জার্মান বাহিনীর বিমান হামলা প্রতিরোধে এ নেটওয়ার্কটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ফায়ার কন্ট্রোল রাডার প্রধানত ব্যবহার করা হতো রাতের আঁধারে আক্রমণের জন্য। আগে চিহ্নিত করে রাখা কোনো টার্গেটের নিখুঁত সন্ধান দিতো এ রাডার। বলা যায়, এর মাধ্যমে টার্গেটকে না দেখেই অনেকটা নিখুঁতভাবে আক্রমণ করা যেত। এছাড়া যেসব টার্গেট দূর থেকে দৃশ্যমান না, এ রাডার পাইলটদের সেসব লক্ষ্যের কাছাকাছি নিয়ে যেত।
এর একটি বিশাল সুবিধা ছিল। কেননা রাতের আঁধারে আক্রমণ চালালে ধরা পড়ার সুযোগ কম। ফলে আক্রমণ সফল হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ঐ অঞ্চলে প্রতিপক্ষের ডিটেকশন রাডার থাকলে অবশ্য ভিন্ন কথা। এরকম ফায়ার কনট্রোল রাডার বেশি ব্যবহৃত হতো নৌ বাহিনীর দ্বারা। পরে অবশ্য জার্মানি ফায়ার কন্ট্রোল রাডার সমন্বিত আকাশযানও তৈরি করে।
রাডারের আগে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বোমা হামলা করা সম্ভব হতো না। মোটামুটি একটি এলাকা নির্ধারণ করেই হামলা চালানো হতো। রাডার, বোম্বসাইট ইত্যাদি প্রযুক্তির ফলে অনেকটা নিখুঁত লক্ষ্য নির্ধারণ করা সম্ভব হয়। শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের সামরিক ঘাঁটি, ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে হামলা চালানো হয়। চেষ্টা করা হয় যাতে সাধারণ জনগণের ক্ষতি যথাসাধ্য কম হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাডারের গুরুত্ব বেশি হওয়ার একটা বড় কারণ হচ্ছে জার্মানির তুলনায় মিত্রশক্তি রাডার বা এ ধরনের প্রযুক্তিতে অধিক সমৃদ্ধ ছিল। জার্মানি এ ধরনের রক্ষণাত্মক প্রযুক্তির তুলনায় আক্রমণাত্মক অস্ত্র-শস্ত্রে অধিক শক্তিশালী ছিল। রক্ষণাত্মক মিত্রবাহিনী এসকল প্রযুক্তি ব্যবহার করে জার্মানির হামলা যেমন প্রতিরোধ করতে পেরছে, তেমনি জার্মানিতে তাদের আক্রমণগুলোও চালাতে পেরেছে নিখুঁতভাবে। এ জন্যেই রাডার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে,
“The weapon that won the war and the invention that changed the world!”