গত কয়েকশত বছর ধরেই মেশিন মানুষের কাজের জায়গাগুলো দখল করে নিচ্ছে। ডিজিটাল প্রিন্টার মেশিনের বদৌলতে অ্যানালগ ফটো ডেভলাপমেন্ট স্টুডিওগুলোর চাহিদা হারিয়ে গেছে। কম্পিউটার দ্বারা পরিচালিত পাবলিশিং সফটওয়্যারগুলো অ্যানালগ গ্রাফিক্স ডিজাইনারদের চাকরিচ্যুত করেছে। গার্মেন্টস শিল্পে বর্তমানে মেশিনের জয়জয়কার; যেখানে উনিশ শতকের শেষের দিকেও রঙ করা, সুতা কাটা, বুননের কাজগুলো সাধারণ শ্রমিকদের দ্বারা পরিচালিত হতো।
পূর্বে জাহাজ শিল্পে যে পরিমাণ শ্রমিক প্রয়োজন হতো, তার প্রায় অধিকাংশ কমে গেছে ভারি ভারি মেশিনের কল্যাণে। বর্তমানে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কল্যাণে চালকবিহীন গাড়ি রপ্তানি হচ্ছে। এমন সব মেশিন তৈরি হচ্ছে, যেগুলো এক্স-রে রিপোর্ট পড়তে সক্ষম। সোশ্যাল মিডিয়া চ্যাট-বটগুলো মানুষের পরিবর্তে কাস্টমার সেবা দিতে সক্ষম। এমনকি ২০১৬ সালে জাপানী কোম্পানি সফট ব্যাঙ্ক টোকিওতে উদ্বোধন করা তাদের মোবাইল ফোন স্টোরের সেলস-অ্যাসোসিয়েট হিসেবে Pepper নামক একদল রোবটকে নিয়োগ করেছে। অর্থাৎ বর্তমানে বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি, হেলথ-কেয়ার, কাস্টমার-কেয়ার সহ প্রায় সবখানেই মেশিন, রোবট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেশনের জয়জয়কার।
যদিও মেশিনের কল্যাণে মানুষ চাকরিচ্যুত হচ্ছে, কিংবা অল্প বেতনের চাকরি করতে বাধ্য হচ্ছে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির এই আবির্ভাব মানুষের আমোদ-প্রমোদের সুযোগ করে দিচ্ছে, জীবনকে করছে আরো উন্নত, আরো সহজ। কিন্তু বর্তমানে শুরু হওয়া প্রযুক্তি বিপ্লব যদি এত দ্রুত গতিতে চলতে থাকে, তাহলে এর সাথে মানুষের তাল মিলিয়ে চলাটা কঠিন হয়ে পড়বে। যত সময় যাবে, তত বেশি মানুষের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় মেশিন বা রোবটের আওতায় চলে যাবে। জীবনযাত্রার মান, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে ঠিকই, কিন্তু সাথে সাথে মানুষকে ভয়ঙ্কর কিছু অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। আট মাস ধরে চলা ম্যাকিনজি গ্লোবাল ইন্সটিটিউশনের গবেষণাটি সেটাই প্রমাণ করে।
২০১৭ সালে প্রকাশিত ঐ গবেষণা অনুযায়ী, আমেরিকা এবং জার্মানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সহ পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ ২০৩০ সালের মধ্যে চাকরীশূন্য হবে। প্রায় ৩০ শতাংশেরও বেশি কর্মঘণ্টা স্বয়ংক্রিয় মেশিন বা রোবটের আওতায় চলে যাবে। গবেষণাটির মতে, চাকরি হারানো মানুষদের যে শুধু নতুন চাকরি খুঁজতে হবে তা নয়, তাদের মধ্যে প্রায় ৩৭৫ মিলিয়ন মানুষকে নিজেদের পেশা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো পেশা গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ, পৃথিবীব্যাপী প্রায় ১৪% শ্রমিক যে ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করতো, সেগুলো তাদের জন্য হারিয়ে যাবে।
২০১৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষাবিদ তাদের ‘দ্য ফিউচার অফ এমপ্লয়মেন্ট’ শিরোনামের একটি গবেষণা পত্রে দেখিয়েছে যে, “টেলিমার্কেটার, ট্যাক্স প্রস্তুতকারক, স্পোর্টস রেফারি সহ প্রায় ৭০২টি প্রচলিত পেশা সাইকোলজিস্ট, দন্তচিকিৎসক, চিকিৎসাবিদের মতো পেশাগুলোর থেকে বেশি ঝুঁকিতে আছে।”
ফিউচারিস্ট এবং ‘Rise of the Robots: Technology and the Threat of a Jobless Future’ এর লেখক মার্টিন ফোর্ডের মতে, “পুনরাবৃত্তিমূলক, অনুমানযোগ্য এবং একই পদ্ধতি, রুটিন মেনে চলা কাজগুলো ভবিষ্যতে অটোমেশনের আওতায় চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে।”
দ্য ফিউচার অফ এমপ্লয়মেন্টের গবেষণায় উল্লেখ করা টেলিমার্কেটার, ট্যাক্স প্রস্তুতকারক এবং স্পোর্টস রেফারেরির মতো পেশাগুলো ফোর্ডের উপরোক্ত কাজের মানদণ্ডের সাথে অনেকাংশেই মিলে যায়। বর্তমানে আমরা প্রায়শই দেখি ফোনে আসা বিজ্ঞাপনমূলক কলগুলো সাধারণত স্বয়ংক্রিয়; অর্থাৎ পূর্বে রেকর্ড করা থাকে এবং এ ফোনকলগুলোর মধ্যেই বিভিন্ন রকম নির্দেশনা অনুসরণ করে সরাসরি কোনো মানুষের সাথে কথা না বলেও শুধুমাত্র নাম্বার বাটনে চেপে কোনো কোম্পানির অফার, পণ্যের বিস্তারিত এবং এমনকি নির্দিষ্ট কিছু করার ব্যাপারে আবেদন করা যায়। অপরদিকে একই ধরনের তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে একই রকম পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রায় সব রকমের ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয়। যার ফলাফলও অনুমানযোগ্য। তাই বলা যায়, ট্যাক্স প্রস্তুতকারকদের পেশাগুলোও শীঘ্রই অটোমেশনের আওতায় চলে যাবে। বর্তমানে আমেরিকার সবচাইতে বড় ট্যাক্স প্রস্তুতকারক কোম্পানি H&R Block তাদের কাজে আইবিএম-এর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্লাটফর্ম ‘আইবিএম ওয়াটসন’ এর সেবা গ্রহণ করছে।
বর্তমানে চিকিৎসকরা আইবিএম ওয়াটসনের সাহায্যে খুব সহজেই লক্ষ লক্ষ কেস স্টাডি, জার্নাল ঘাঁটাঘাঁটির মাধ্যমে কোনো একটি বিশেষ রোগের চিকিৎসা নির্ণয় করতে পারে। সম্ভাবনা থেকেই যায়, ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি চিকিৎসকদের সাহায্য করার বদলে, নিজেই তাদের চাইতেই ভালো চিকিৎসক হিসেবে আবির্ভূত হবে!
গুগল, টেসলার কল্যাণে স্বয়ংক্রিয় গাড়ি তৈরির বিপ্লব বেশ ভালোভাবেই এগোচ্ছে। এদের সাথে পাল্লা দিয়েই ২০১৬ সালে উবারের স্বয়ংক্রিয় যান তৈরি প্রকল্প ‘Otto’ বাণিজ্যিক পণ্য ডেলিভারি সুবিধার জন্য তৈরি ট্রাকের মহড়া উপস্থাপন করে। স্বয়ংক্রিয় ট্রাকটি ফোর্ট কলিনস, কলোরাডো থেকে কলোরাডো স্প্রিং পর্যন্ত ১২০ মাইল ব্যাপী ২৫টি অঙ্গরাজ্যে সফলভাবে ২০০০ কেস বাডওয়াইজার বিয়ার ডেলিভারি করে। এখান থেকে বেশ ভালোভাবেই অনুমান করা যায়, উন্নত দেশগুলোতে ট্যাক্সিচালক, ট্রাক চালকেরা আগামী দশ বছরের মধ্যে নিজেদের পেশা থেকে বিতাড়িত হতে চলেছেন।
সব কিছু বিবেচনায় এনে ভবিষ্যতের অটোমেশন নিয়ে চিন্তা করার পর, চাকরি হারানো সহ মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ভয় স্বাভাবিকভাবেই ঝেঁকে বসতে পারে। তবে নানা ধরনের গবেষণার ফলাফল আগামী কয়েক যুগের স্বয়ংক্রিয় মেশিনের অগ্রগতি নিয়ে নানা ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করলেও আমরা এখনো জানি না, কী পরিমাণ কাজ কত দ্রুত অটোমেশনের আওতায় চলে যাবে। তবে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির মাধ্যমে খুব সহজেই ভবিষ্যতের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘অটোমেশনের সাথে পাশাপাশি তাল মিলিয়ে চলতে কী ধরনের প্রস্তুতির প্রয়োজন?’
পিউ রিসার্চ সেন্টার এবং এলন ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক, প্রযুক্তি কোম্পানি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে এমন ১,৪০৮ জন কর্মজীবীর উপর চালানো একটি জরিপে দেখায় যে, তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই মনে করে, পরবর্তী দশকের মধ্যে তৈরি হওয়া নতুন শিক্ষাপদ্ধতি ভবিষ্যতের সফল শ্রমিক তৈরি করতে সাহায্য করবে। গবেষকদের মতে, ঐ নতুন শিক্ষাপদ্ধতিতে যা থাকা প্রয়োজন তা হলো, “কর্মমুখী শিক্ষার পাশাপাশি ‘কীভাবে কোনো জিনিস শিখতে হয়’ তা শেখানো।” এ ব্যাপারে গবেষণায় নিযুক্ত ভিয়েনায় অবস্থিত FHWien University of Applied Sciences এর অধ্যাপক উটা রাসম্যান বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়, কীভাবে নতুন জিনিসের সাথে মানিয়ে নেওয়া যায়, কীভাবে প্রশ্ন করার মাধ্যমে উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় এবং যেকোনো পরিস্থিতি কীভাবে সামলানো যায়। এখন যা তাদের প্রয়োজন তা হলো, সবগুলো জিনিসকে কর্মজীবনের চলমান পরিবর্তনের সাথে সমন্বয় করা এবং নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য কীভাবে চাকরি চলাকালীন সময়ই নির্দিষ্ট কাজে দক্ষতা অর্জন করা যায় , তা শেখা।”
এখন প্রশ্ন এসেই যায়, “বর্তমানে যারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত এবং কয়েক দশক ধরে পেশাদারিত্ব চালিয়ে যাবে, তারা কীভাবে ভবিষ্যতের অটোমেশন দুনিয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে?” উপরোক্ত গবেষণায় নিয়োজিত অনেকের মতেই, নিজের পেশার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্য কোনো কাজ, যেগুলো সম্পাদন করতে রোবটের চাইতে মানুষের উপর বেশি নির্ভর করতে হবে, সেরকম কাজ খুঁজে বের করা এবং সেগুলোতে দক্ষতা অর্জন করা উচিত। এখানে মূল চ্যালেঞ্জটাই হচ্ছে, নিয়মিত নতুন কিছু শেখা, যা চেষ্টা করলেই সম্ভব। এ ব্যাপারে ইঙ্গিত করে পরামর্শ সেবা প্রতিষ্ঠান DDG এর প্রতিষ্ঠাতা জাস্টিন টোবিন বলেন, “কোনো একটি নির্দিষ্ট কাজে লেগে থাকার মানে, সঞ্চিত সব টাকা মাত্র একটি স্টকে বিনিয়োগ করা। সবচাইতে উত্তম কৌশল হচ্ছে নিজের পোর্টফলিওতে বৈচিত্র্য আনা।”
ফিউচারিস্ট ফেইথ পপকর্ণের মতে, বর্তমানে আমরা মাত্রাজ্ঞানহীন পরিবর্তনের ঠিক মধ্যে অবস্থান করছি, যা সমাজের প্রত্যেকের উপর প্রভাব বিস্তার করবে। তাই প্রত্যেকের যতটুকু সম্ভব চটপটে হওয়া এবং একের অধিক পরিমাণ কাজে দক্ষ হওয়া আবশ্যক। তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই সাত কিংবা আটটি কাজে নিয়োজিত থাকবে। অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্কই কোনো একটি বৃহৎ কর্পোরেশনে কাজ করার বদলে একসঙ্গে একের অধিক কোম্পানিতে কাজ করবে।”
এরপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, “যদি উল্লেখিত কাজগুলো করার পাশাপাশি পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করি, তাহলে কি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত চাকরি থাকবে?”
মাইক্রোসফটের প্রধান পরিকল্পনাকারী এবং গবেষক জনাথন গ্রুডিন এ ব্যাপারে বেশ আশাবাদী। তিনি বলেন, “মানুষ শুধু কোনো কাজ করার জন্য দক্ষতাই অর্জন করবে না, বরং যতদিন পর্যন্ত তারা প্রযুক্তিগত শিক্ষা অর্জন করবে, ততদিন পর্যন্ত মানুষই ভবিষ্যতের চাকরি, কাজের অবস্থানগুলো তৈরি করবে।”
এ ব্যাপারে অবশ্য ক্লাউড নির্ভর ইমেইল ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান মাইমকাস্টের প্রধান বিজ্ঞানী নাথানিয়াল বোরেনস্টাইন ভিন্ন মত পোষণ করেন। পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ প্রযুক্তিবিদ, ফিউচারিস্ট, সফল উদ্যোক্তা, ব্যবসায়িক রথী-মহারথীরা যখন ভবিষ্যতের চাকরির বাজারে মানুষের অস্তিত্ব সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন, ঠিক সে সময়ে তিনি বলেন, “ভবিষ্যতের অধিকাংশ কাজগুলোই রোবট শ্রমিক বা স্বয়ংক্রিয় মেশিন দ্বারা সম্পাদিত হবে। তাই প্রশ্নটা ‘ভবিষ্যতের অবিদ্যমান কাজের জন্য মানুষ কীভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করবে?’ না হয়ে বরং ‘যে পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষেরই কাজ করার প্রয়োজন হবে না, সেখানে কীভাবে উৎপাদিত ধন-সম্পত্তি সবার মাঝে ভাগ করে দেওয়া হবে?’ হওয়া উচিত।”
ফিচার ছবি: motherjones.com