প্রজেক্ট ড্রাগনফ্লাই: গুগলের একটি ব্যর্থ প্রকল্প

আজকের দিনে বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বাজার হচ্ছে চীন। শুধু মুনাফার জন্য গুগল চীনে ব্যবসা করতে চায় না। এখানে কী ঘটছে সেটা আমাদের বোঝা দরকার, আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। চীন আমাদের এমন কিছু শেখাবে, যা আমরা আগে জানতাম না।

উপরের কথাগুলো বলেছিলেন বেন গোমেজ, গুগলের তৎকালীন ‘হেড অব সার্চ’। বিশ্ববিখ্যাত একটি প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে তার এই কথাগুলোর মাধ্যমে চীনের বাজার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন আপনি। চীনের বাজার পৃথিবীর আর দশটা দেশের মতো নয়। এখানে যেমন গুগলকে স্থানীয় সার্চ ইঞ্জিনের সাথে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে, আবার সেবা দিতে গিয়ে স্থানীয় কঠোর আইনও মেনে চলতে হয়েছে। চীন প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে স্বপ্নের মতো। কোটি কোটি ভোক্তার বাজার যেকোনো প্রতিষ্ঠানকেই আকর্ষণ করবে, গুগলকেও করেছিল। কিন্তু তাদের প্রথম যাত্রায় তারা খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি।

বেন গোমেজের কথাগুলো চীনের বাজার সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করবে আমাদেরকে; Image Courtesy: Peter DaSilva/The New York Times

চীনে যখন প্রথমবারের মতো গুগলের আগমন ঘটে, তখন সার্চ ইঞ্জিন বাইডু চীনে বেশ জনপ্রিয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গুগলকে কখনই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়নি, কিন্তু চীন ছিল এ দিক থেকে ব্যতিক্রম। চীনা প্রযুক্তিবিদদের হাতে নির্মিত বাইডু এমন সব সেবা নিয়ে হাজির হয়েছিল, যেগুলো ছিল গুগলের চেয়ে ঢের ভাল। যেমন বলা যায়, চীনের সমাজে একসময় ই-কমার্সের চাহিদা অনুভূত হচ্ছিল বেশ, তখন প্রায় ২০০ শহরে বাইডুই প্রথম ই-কমার্সের সুবিধা নিয়ে আসে। পরবর্তীতে গুগলের উপর ভয়াবহ সাইবার আক্রমণ পরিচালনা করেছিল চীনা হ্যাকাররা, যেটি বৈশ্বিকভাবে গুগলের ভাবমূর্তি প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তদন্ত করতে গিয়ে গুগলের প্রযুক্তিবিদরা দেখতে পান, চীনের মানবাধিকারকর্মী কিংবা সরকারের সমালোচকদের জিমেইল আইডি থেকে অসংখ্য তথ্যের উপর আড়িপাতা হয়েছিল। তাই ২০১০ সালে গুগল চীন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়।

হচহচজচচকক
চীনে সবসময়ই বাইডুর সাথে তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হয়েছিল গুগলকে; image source: aicy-create.com

চীনের বাজার থেকে গুগল নিজেদের গুটিয়ে নিলেও পরবর্তীতে তারা আবার ফিরে আসতে চেয়েছিল, কিছুটা ভিন্নভাবে। একেবারে গোপনে তারা চীনের কঠোর আইনের প্রতি সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি সার্চ ইঞ্জিন তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়, যেটি গুগলের বাইরের কেউ জানত না। এমনকি এই প্রজেক্টের জন্য যাদের নিয়োগ করা হয়েছিল, তাদেরকেও গোপনে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। চীনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল বাজার যে হাতছাড়া করে গুগল যে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাদের ফিরে আসার জন্য গোপন প্রকল্প বিষয়টি নিশ্চিত করে। এই প্রকল্পটি এত গোপনে পরিচালনা করা হচ্ছিল যে, গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুন্দর পিচাই কখনও এই বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেননি। গুগল চেয়েছিল গোপনে চীনের বাজারে ফিরে আসতে, কিন্তু পরবর্তীতে তা আর সম্ভব হয়নি। চীনের বাজারে তো তারা ফিরতে পারেইনি, উল্টো ব্যাপক সমালোচনার মুখে তাদের প্রকল্প পুরোপুরি বাতিল করতে বাধ্য হয়।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সবসময়ই বিরুদ্ধমতের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ দেখিয়ে এসেছে। তিয়েনআনমেন স্কয়ার, গণতন্ত্র, লিবারেলিজম– এসব বিষয় সম্পর্কে সবসময়ই তারা স্পর্শকাতর। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি চীনের জনগণের জন্য ইন্টারনেট সেবা সহজ করে দিলেও তারা চায় না তারা এসব বিষয় সম্পর্কে জানতে পারুক। বাইডুসহ যত সার্চ ইঞ্জিন আছে, সবগুলোতেই সেন্সরশিপ আরোপ করা আছে। এছাড়া গণমাধ্যমের উপরে রয়েছে আরও কড়া সেন্সরশিপ। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো আর্টিকেল প্রকাশ করার আগে কমিউনিস্ট পার্টির কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হচ্ছে। যেমন ধরা যাক, কোনো একটি পত্রিকা বেইজিংয়ের বায়ুদূষণের মতো একটি বিষয়ের উপর রিপোর্ট তৈরি করল। চীনের ক্ষেত্রে পত্রিকার সম্পাদককে সেই রিপোর্টটি কমিউনিস্ট পার্টির কাছে প্রেরণ করতে হবে। এরপর সবুজ সংকেত পেলে সম্পাদক সেটি প্রকাশ করতে পারবেন।

িডওতপতপত
গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুন্দর পিচাই গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার আগে কখনোই এই প্রকল্প নিয়ে কথা বলেননি;
image source: Reuters

গুগল যখন প্রথমবারের মতো চীনা ভাষার জন্য সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করে, তখন তা খুব জনপ্রিয়তা পায়নি। কারণ মান্দারিন ভাষা খুব সহজ নয়, চীনা নাগরিকরা সার্চকৃত ফলাফলে যা প্রত্যাশা করত, তা গুগল দিতে পারত না। এছাড়া সেন্সরশিপ নিয়ে গুগলের কর্মকর্তাদের সাথে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ঝামেলাও হয়েছিল এবং এটি তাদের চীন ছেড়ে যাওয়ার বড় কারণ। সেই থেকে শিক্ষা নিয়ে গুগল একটি বেইজিংভিত্তিক নিউজ পোর্টালের কাছ থেকে চীনা ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে। প্রজেক্ট ড্রাগনফ্লাইয়ের মূল লক্ষ্য ছিল এমন একটি সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করা, যেখানে চীনা সরকারকর্তৃক নিষিদ্ধ ফলাফলগুলো সেন্সর করা থাকবে। চীনের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কমিউনিস্ট পার্টির দেয়া নির্দেশনা মেনে না চললে কোনোভাবেই ব্যবসা করতে পারে না। তথ্য সেন্সরশিপ নৈতিকভাবে কোনো ভালো কাজ নয়, কারণ এর মাধ্যমে জনগণকে সত্য থেকে দূরে রাখা হয়। পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই ধরনের কাজগুলোকে কখনোই ভালো চোখে দেখা হয় না।

এই প্রকল্পের তথ্য জনগণের সামনে এলে যে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে, তা গুগল খুব ভাল করেই জানত। কিন্তু পরবর্তীতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ইন্টারসেপ্ট’ গুগলের এই গোপন প্রকল্প নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করলে মানুষ প্রথমবারের মতো এই প্রকল্প সম্পর্কে জানতে পারে। গুগলের কর্মীরা পরবর্তীতে এটা নিয়ে সরাসরি কথা বলতে শুরু করেন। গুগলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন– এরকম অসংখ্য কর্মী নৈতিকভাবে এই প্রকল্পকে সমর্থন করতে পারছিলেন না। তাই প্রকল্প থেকে অনেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। গণমাধ্যমে এই প্রকল্পের তথ্য ফাঁস হওয়ার পর মানবাধিকারকর্মীরাও এই প্রকল্পের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন। কারণ চীনা নিপীড়ক সরকারের অন্যায় আইন মেনে নিয়ে সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করার অর্থ হচ্ছে তাদের নিপীড়নে সহায়তা করা। আমেরিকার কংগ্রেসেও শুনানির জন্য গুগলকে তলব করা হয়।

হডিতপতক
শুধু এই প্রকল্পের জন্য গুগল গোপনে কর্মী নিয়োগ দিয়েছিল; image source: timesofindia.indiatimes.com

সবদিক থেকে সমালোচনার তীর ধেয়ে আসার পর গুগল পিছু হটতে বাধ্য হয়। মূলত অর্থনৈতিক কারণে তারা চীনে ফিরে আসতে চেয়েছিল, এত বড় বাজার হাতছাড়া করা কোনো বিখ্যাত প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু বিশ্বজুড়ে যেভাবে এই প্রকল্পের প্রতিবাদ করা হয়, তাতে গুগল বাড়তি ঝামেলা এড়াতে এই প্রকল্প পুরোপুরি বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।

গুগলের অভ্যন্তরেও এই প্রজেক্টকে কেন্দ্র করে জটিলতা সৃষ্টি হয়। প্রায় হাজারেরও অধিক কর্মী প্রকল্প বন্ধের ব্যাপারে গুগলের কর্মকর্তাদের কাছে পিটিশন জমা দেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোও গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুন্দর পিচাইকে এই প্রকল্প বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছিল বারবার। ২০১৮ সালের দিকে গুগলের কর্তাব্যক্তিরা প্রকল্প সম্পর্কে তেমন উচ্চবাচ্য না করলেও পরবর্তীতে ২০১৯ সালে সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির শুনানির পর করণ ভাটিয়া নামের একজন কর্মকর্তা বলেন যে, গুগল এই প্রকল্প বাতিল করেছে।

চীনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের অভিযোগ কম নয়। উইঘুরে মুসলিমদের উপর নিপীড়ন তো রয়েছেই, এর পাশাপাশি পৃথিবীর বৃহত্তম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প নির্মাণের জন্য চারদিক থেকে চীনের সমালোচনা করা হচ্ছে। নিজের জনগণের উপর চীনা সরকার চরম নজরদারি চালায় এবং রাষ্ট্রীয় নজরদারিকে বৈধতা দেয়ার জন্য আইনও তৈরি করে রাখা হয়েছে। এজন্য গুগলের গোপন সার্চ ইঞ্জিন তৈরির প্রকল্পের তথ্য যখন ফাঁস হয় তখন মানবাধিকার কর্মীরা একজোট হয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন, কারণ প্রকারান্তরে গুগলের এই প্রজেক্ট নিপীড়ক চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকেই শক্তিশালী করত। মুনাফার কাছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মতো অনৈতিক কার্যক্রম যে কোনো বিষয় নয়, তা গুগলের এই গোপন প্রকল্প দেখেই বুঝতে পারা যায়।

Related Articles

Exit mobile version