সময়টা ১৯৮৩ সাল; প্রথম ম্যাকিনটোশ চালু করার মাস ছয়েক আগে অ্যাপলের সহকারী প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা স্টিভ জবস সফটওয়্যার প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে বলেছিলেন, “It would be a little like a record store, where software would be downloaded over phone lines”। চৌকস এই প্রযুক্তিবিদের ভবিষ্যদ্বাণী ফলেছে। বর্তমানে আমরা খুব সহজেই নিজের পছন্দের প্রয়োজনীয় অ্যাপটি অনলাইন দোকান থেকে ডাউনলোড করে নিতে পারি, যেটি পৃথিবীব্যাপী ‘অ্যাপ স্টোর’ নামে পরিচিত।
বর্তমানে আমাদের জীবন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অ্যাপ্লিকেশন প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। সকালে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেওয়ার অ্যালার্ম থেকে শুরু করে মিউজিক প্লেয়ারে পছন্দের প্লে-লিস্টটি চালু করে জগিংয়ে যাওয়া, গাড়ির টিকিট কেনা, হোটেলের রুম কিংবা রেস্টুরেন্টের টেবিল বুকিং দেওয়া, গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য ডিজিটাল নেভিগেশন প্রযুক্তির মাধ্যমে সঠিক এবং সহজ পথটি বেছে নেওয়া, দূর-দূরান্তের মানুষের সাথে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে সম্পর্কগুলো অবিরত রাখা সহ অনেকভাবে জীবনকে সহজ করে দিচ্ছে এ প্রযুক্তি। আপনি চাইলেই কিছু শর্ত মেনে খুব সহজেই আপনার স্মার্টফোনটির মাধ্যমে নিরাপত্তার স্বার্থে আপনজনদের গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখতে পারবেন। দূর থেকেও চোখ রাখতে পারবেন আপনার বাড়ি, গাড়ি এবং প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর উপর। অর্থাৎ জীবনকে সহজ, আনন্দময় করার জন্য প্রয়োজনীয় সব রকমের ব্যবস্থাপনা দিয়ে তৈরি হচ্ছে অ্যাপ্লিকেশনগুলো।
দিন দিন এই প্রযুক্তি আরো উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় সব রকম প্রযুক্তিকে ঢেলে সাজিয়ে ডেভেলপাররা এমন সব অ্যাপ তৈরি করছে, যা বছর তিরিশেক আগে কল্পনাও করা যেত না। তবে এই উন্নয়ন কয়েক বছরে সম্ভব হয়নি। একটি দীর্ঘ সময়ের ক্রমবিবর্তনের মধ্যে দিয়ে একে যেতে হয়েছে। আজ মোবাইল ফোন অ্যাপের ইতিহাস এবং ক্রমবিকাশ নিয়েই আপনাদের বলবো।
শুরুর কথা
সব কিছুর শুরু ১৯৭৩ সালের তিন এপ্রিলে মার্টিন কুপারের হাত ধরে বেল ল্যাবে তৈরি হওয়া মটোরোলা কোম্পানির প্রথম মোবাইল ফোন Motorola DynaTAC 8000X এর মাধ্যমে। যদিও প্রায় দুই পাউন্ড ওজনের ফোনটি বাজারে আসে ১৯৮৩ সালের দিকে। অর্থাৎ পুরো দশ বছর সময় লাগে সাধারণের মাঝে মোবাইল ফোন প্রযুক্তিকে পৌঁছে দিতে। কিন্তু এরপর সব কিছু বেশ দ্রুততার সাথে ঘটতে থাকে।
প্রথম স্মার্টফোন
মোবাইল অ্যাপের প্রথম দিকের সময়ে ফিরে গেলে বর্তমানের অভিনব, উন্নত মানের গ্রাফিক্স, বহু গবেষণা করে ডিজাইন করা ইউজার ইন্টারফেসের পরিবর্তে মোবাইল অ্যাপ ক্যাটাগরিতে জাভা গেমস, ক্যালকুলেটর এবং মাসিক ক্যালেন্ডার ছাড়া তেমন কিছুই পাওয়া যেত না। তবে মোবাইল ফোন তৈরির মাত্র বিশ বছরের মধ্যেই আইবিএম সিমন (IBM Simon) আসে পুরো পৃথিবীকে স্মার্টফোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। ১৯৯৪ সালের আগস্টের ১৬ তারিখে এসেই বাজিমাত করে সেটি। চড়া দাম হওয়া সত্ত্বেও মাত্র এক বছরে এর প্রায় পঞ্চাশ হাজার ইউনিট বিক্রি হয়। Datalight ROM-DOS অপারেটিং সিস্টেমের ফোনটিতে সাধারণ ফোনকল ছাড়াও ফ্যাক্স, ইমেইল, সেলুলার পেইজ পাঠানো যেত। এছাড়া টাচস্ক্রিন প্রযুক্তি সমৃদ্ধ এই ফোনটিতে অ্যাড্রেস বুক, ক্যালেন্ডার, অ্যাপয়েন্টমেন্ট শিডিউলার, ক্যালকুলেটর, ওয়ার্ল্ড টাইম ক্লক, ইলেক্ট্রনিক নোটপ্যাড সহ আরো কয়েকটি অ্যাপ্লিকেশন ছিল, যেগুলো বর্তমান সময়ের জন্য বেশ সাধারণ মানের মৌলিক ফিচার হলেও সেসময়ে উন্নত অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্টের আওতায় পড়তো।
এরপর আরো দুই যুগ। ক্রমবিবর্তনও হয়েছে ধাপে ধাপে। কখনো খুব ধীরে, কখনোবা খুব দ্রুত গতিকে। Psion EPOC থেকে শুরু করে বর্তমানে আইওস, অ্যান্ড্রয়েডের বিশাল সাম্রাজ্যে প্রবেশ আলোচনার বিষয়বস্তুই বটে।
Psion EPOC: সিমবিয়ান অপারেটিং সিস্টেমের আদি রূপ
অ্যাপ হিসেবে গ্রহণ করা যায় এমন প্রযুক্তির আগমন হয় Psion এর হাত ধরে। ‘৯০ এর শুরুর দিকে এটি ব্যক্তিগত ডিজিটাল সহযোগী (PDA) ডিভাইস হিসেবে পরিচিত ছিল। একে ষোল বিটের মেশিন হিসেবে বাজারে ছাড়া হয়, যেখানে EPOC অপারেটিং সিস্টেমের আওতায় ওয়ার্ড প্রসেসর, ডাটাবেজ, স্প্রেডশিট, ডায়েরির মতো বেশ প্রয়োজনীয় অ্যাপগুলো ইনস্টল করা ছিল। পরবর্তীতে ডিভাইসটির উন্নত সংস্করণে ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে বত্রিশ বিট করা হয় এবং সাথে দুই মেগাবাইটের র্যাম যুক্ত করা হয়, যা ব্যবহারকারীকে বিভিন্ন সফটওয়্যার প্যাক থেকে আলাদা আলাদা অ্যাপ ইনস্টল করার সুযোগ করে দেয়।
EPOC অপারেটিং সিস্টেম মূলত প্রোগ্রাম করা ছিল Open Programming Language (OPL) দিয়ে, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের জন্য নিজেদের খেয়ালখুশিমতো অ্যাপ তৈরি করার সুযোগ ছিল। ১৯৯৮ সালে Psion EPOC অপারেটিং সিস্টেমটি সিমবিয়ানের আওতাধীন হয়ে যায়
ওয়ারলেস এপ্লিকেশন প্রটোকল বা WAP browser সমৃদ্ধ PALM OS
১৯৯৬ সালে দামে সস্তা এবং আরো আধুনিক কার্যকারিতার পরিসীমা নিয়ে Psion EPOC এর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে মাঠে নামে Palm অপারেটিং সিস্টেমে সমৃদ্ধ Palm Pilot। টাচস্ক্রিন গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেস (GUI) সমৃদ্ধ PDAটিতে সাধারণ ফিচার অ্যাপ ছাড়াও C/C++ ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে প্রোগ্রাম করা থার্ড পার্টি অ্যাপও চালানো যেত। পরবর্তীতে অপারেটিং সিস্টেমটির উন্নত 3.0 ভার্সনে WAP ব্রাউজার অ্যাপ সংযুক্ত করা হয়।
জাভা মাইক্রো এডিশন (Java ME/J2ME/JME)
চারদিকে যখন বিভিন্ন ফিচার/অ্যাপ সমৃদ্ধ ফোনের জয়জয়কার, জাভা মাইক্রো এডিশন সহজ, কিন্তু উন্নত সেবার মাধ্যমে পুরো ডেভেলপিং প্লাটফর্মটকে নিজের করে নেয়। এটি Personal Java থেকে রূপান্তরিত হয়ে JSR 68 হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং মোবাইল ফোন, PDA, সেট টপ বক্সের মতো অ্যাপ্লিকেশন নির্ভর ডিভাইসগুলোতে ব্যবহৃত হওয়া শুরু করে।
ওরাকলের তথ্য অনুসারে, জাভার এই এডিশনটি বাজারে ছাড়ার মূল লক্ষ্যই ছিল সীমিত পরিমণ্ডলে তৈরি হওয়া ছোট ছোট ডিভাইসগুলোর উপযুক্ত অ্যাপ্লিকেশন তৈরির জন্য; যেগুলো ছোট স্ক্রিন, সীমিত পরিমাণ মেমোরি এবং স্বল্প ব্যাটারি পাওয়ার সমৃদ্ধ ছিল।
বর্তমানে ইন্টারনেট অফ থিংস, মাইক্রো কন্ট্রোলার, অ্যান্ড্রয়েডের অ্যাপ্লিকেশন তৈরির জন্য জাভার যে স্ট্যান্ডার্ড এডিশনটি ব্যবহৃত হয়, সেটিই জাভা মাইক্রো এডিশন হিসেবে পরিচিত।
সিমবিয়ান এবং অন্যান্য
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, সিমবিয়ান (Symbian) মূলত Psion EPOC থেকে রূপান্তরিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯৮ সালে এটি বাজারে আসে সিমবিয়ান লিমিটেডের হাত ধরে। এটি মূলত প্রথম দিকের সেরা চারটি মোবাইল ফোন কোম্পানি Psion, এরিকসন, মটোরোলা এবং নোকিয়ার যৌথ উদ্যোগ ছিল। ২০০৯ পর্যন্ত পুরো বিশ্বব্যাপী ২৫০ মিলিয়ন ডিভাইস এই অপারেটিং সিস্টেমের আওতাধীন ছিল। অপারেটিং সিস্টেমটি স্যামস্যাং, মটোরোলা, এলজি’র মতো বড় বড় ফোন কোম্পানির বিভিন্ন ফোনে ব্যবহৃত হলেও সবচাইতে বেশি ব্যবহৃত হয় নোকিয়ায়। এছাড়াও জাপানের প্রভাবশালী ব্র্যান্ড মিতসুবিসি, শার্প এবং ফুজিতসুর মতো কোম্পানিগুলো এই অপারেটিং সিস্টেমের নিয়মিত গ্রাহক ছিল।
সিমবিয়ান অপারেটিং সিস্টেমের জনপ্রিয় সফটওয়্যার প্লাটফর্মটি ছিল S60। এই সিরিজের ২০০১ সালে তৈরি হওয়া ভার্সনটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ২০০২ সালে Nokia 7650 মডেলের স্মার্টফোনটিতে। ২০০৮ সালে এর পঞ্চম এবং শেষ সংস্করণটি Nokia 5800 XpressMusic বের হয়।
প্রথমদিকের বাজারে সিমবিয়ান অপারেটিং সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে S60 সহ মোট তিনটি সফটওয়্যার প্লাটফর্মের প্রচলন ছিল। মূলত S60 ব্যবহৃত হতো নোকিয়া, স্যামস্যাং এবং এলজি’র ফোনগুলোতে। অন্যদিকে জাপানিজ কোম্পানি ফুজিতসু এবং শার্পের MOAP এবং মটোরোলা এবং সনি এরিকসনের সফটওয়্যার প্লাটফর্মটি ছিল UIQ নামে। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের জুন মাসে নোকিয়া সিমবিয়ানের সবগুলো শেয়ার কিনে নেয় এবং ওপেন-সোর্স ভিত্তিক প্লাটফর্ম হিসেবে ‘সিমবিয়ান ফাউন্ডেশন’ এর আওতায় নিয়ে আসে।
২০০৬ সালে পুরো পৃথিবীব্যাপী ৬৭% স্মার্টফোনের দখলদার ছিল সিমবিয়ান অপারেটিং সিস্টেম। কিন্তু নানান ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে আস্তে আস্তে ডেভেলপারদের কাছে এটি জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। প্রথমত, এতে অ্যাপ্লিকেশন তৈরির প্রথমদিকে OPL এবং C++ ছাড়া অন্য কোনো প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের ব্যবহার যোগ্যতা ছিল না। তাছাড়া, এর সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কিট (SDK) এবং ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট এনভায়রমেন্ট (IDE) সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না, যা থার্ড-পার্টি স্বাধীন ডেভেলপারদের নিরুৎসাহিত করে। অপরদিকে, অ্যান্ড্রয়েড এবং আইফোন অপারেটিং সিস্টেম তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। থার্ড-পার্টি অ্যাপ ডেভেলপমেন্টের জন্য এই দুই অপারেটিং সিস্টেমের কেন্দ্রীয় অবকাঠামোগত দিকগুলো বেশ সহজ ছিল।
সাধারণ ডিজাইন, নির্দিষ্ট কিছু ডেভেলপার টুলসের সহজলভ্যতা, বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের জটিলতার সমাধানযোগ্যতা, ভবিষ্যতের ভোক্তাদের জন্য চাহিদা অনুযায়ী মাল্টিটাস্কিং এবং হাই-গ্রাফিক্স সমৃদ্ধ অ্যাপ্লিকেশন তৈরির সুযোগ আর সাথে সাথেই সিমবিয়ান সুবিধা ডেভেলপারদের এন্ড্রয়েড এবং আইওএস অপারেটিং সিস্টেমমুখী করতে থাকে। ২০১০ এর পর থেকেই সিমবিয়ান তার জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে এবং সাথে সাথেই অ্যাপ্লিকেশন প্রযুক্তি পুরোপুরি আইএসও এবং অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের আওতায় চলে যায়।
শেষের কথা
বর্তমানে স্মার্টফোনের সাথে সাথে অ্যাপ্লিকেশন প্রযুক্তির সহলভ্যতাও চোখে পড়ার মতো। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, ভ্রমণ, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং, নিউজ সহ হাজার হাজার আলাদা কাজে বর্তমানে বিভিন্ন অ্যাপের চাহিদা এত বেশি যে, শুধুমাত্র অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে প্রত্যেক মাসে বিশ হাজারেরও বেশি নতুন অ্যাপ যুক্ত হয়। ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী অ্যাপল এবং অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ স্টোর থেকে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন বার বিভিন্ন অ্যাপ ডাউনলোড করা হয়েছে। সব বিবেচনা করে বলাই যায়, বর্তমান পুরো পৃথিবীটাই অ্যাপ্লিকেশন প্রযুক্তি নির্ভর। সময়ের সাথে সাথে এই প্রযুক্তিতে আরো পরিবর্তন আসবে। চাহিদা অনুযায়ী যুক্ত হবে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি এবং অগমেন্টেড রিয়ালিটির মতো জনপ্রিয় প্রযুক্তিগুলো। আর এভাবেই তিন যুগ আগে শুরু হওয়া এই প্রযুক্তির ক্রমবিকাশ ঘটবে। কয়েক যুগ পরে আবার নতুন করে লেখা হবে অ্যাপ্লিকেশন প্রযুক্তির বিস্ময়কর ইতিহাস!
ফিচার ছবি: rhbtradesmart.com