সারাদিন ইন্টারনেটে খানিক্ষণ সময় না কাটাতে পারলে দিনটাই যেন ভালো কাটে না। আর ফেসবুক, টুইটার কিংবা ভাইবার? ল্যাপটপ বা মোবাইল, ঘরে কিংবা বাইরে- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর হাতছানি আছে সবখানে, সবসময়। পড়াশোনা থেকে শুরু করে বিনোদন, রান্না থেকে শুরু করে প্রাথমিক চিকিৎসা- অন্তর্জালের এই দুনিয়া বাস্তব দুনিয়ার চাইতেও অনেক বেশি কাছের আর ভালোলাগার জায়গায় পরিণত হয়েছে মানুষের কাছে। কেমন হত যদি একদিন ইন্টারনেট না থাকতো?
ভেবে দেখেছেন কখনো? কখনো মাথায় এসেছে প্রশ্নটি? আপনার মাথায় না এলেও প্রশ্নটি উঁকি মেরে গিয়েছে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষক জ্যাক হ্যানককের মাথায়। শিক্ষার্থীদের সাথে সেই ২০০৮ সাল থেকেই মজার একটা কাজ করতেন তিনি। তাদেরকে এ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে খুব অদ্ভুত একটা কাজ দিতেন। আর কাজটি হল টানা ৪৮ ঘন্টা ইন্টারনেটের বাইরে থাকা।
প্রথমেই বেশ বাধা আসে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। আরে! এ আবার কেমন কাজ? ৪৮ ঘন্টা ইন্টারনেট ছাড়া থাকা! এটাও কি সম্ভব? বিশেষ করে যে শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটে সারাক্ষণ ডুবে থাকে তাদের জন্য ব্যাপারটা ছিল অসম্ভব কিছু। জ্যাক মোটেও ঠিক কাজ করছেন না- এমনটাই মনে হয়েছিলো তাদের। ২০০৯ সালে এসেও আবার এই একই কাজ শুরু করেন জ্যাক। এবার শিক্ষার্থীরা রুখে দাঁড়ায়। নিজেদের কাজের ক্ষতি হচ্ছে, বন্ধু আর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে না- এমন হাজারটা কারণ ছিল তাদের। সেই থেকে আর এমন কোন এ্যাসাইনমেন্ট দেননি জ্যাক কাউকে। আর এখন, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতন কথা তো এখন চিন্তা করাটাও মুশকিল!
এই তো, ১৯৯৫ সালের কথা। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ মানুষ ব্যবহার করতো ইন্টারনেট। তা-ও আবার কেবল শখের বশে। এদের বেশিরভাগই ছিলো পশ্চিমা। আর এখন? এই ২২ বছরের মধ্যে সেই সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে সাড়ে ৩ বিলিয়নে! ঠিক ধরেছেন। পুরো পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে। আর প্রতি সেকেন্ডে সেই সংখ্যা আরো দশজন করে বাড়ছে।
সম্প্রতি পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় পাওয়া যায়, আমেরিকার শতকরা ৭৩ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যের শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষ প্রায় দিনই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির উইলিয়াম ডাট্টানের মতে, বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষ ইন্টারনেটের সাথে এত বেশি যুক্ত হয়ে গিয়েছে যে, ইন্টারনেট থাকবে না এটা তারা ভাবতেই পারে না। নিজেদের জীবনের সব ক্ষেত্রের সাথে ইন্টারনেটকে জড়িয়ে নিয়েছে সবাই।
কিন্তু আপনি কি জানেন, ইন্টারনেট জিনিসটি যেভাবে আমাদের জীবনে এসেছে, ঠিক সেভাবে আমাদের জীবন থেকে চলেও যেতে পারে? কীভাবে? হতে পারে কোনো হ্যাকার রাউটারের দুর্বল দিকগুলো লক্ষ্য করে কোনো ক্ষতিকারক সফটওয়্যার ছড়িয়ে দিলো, কিংবা ডোমেইন আর সার্ভারগুলো বন্ধ হয়ে গেল। গভীর সমুদ্রের তলদেশের ক্যাবল কেটে দিলে এক মহাদেশ আরেক মহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ইন্টারনেটের গতিপথে বাঁধা দিতে আর ইন্টারনেটকে থামিয়ে দিতে যেকোনো একটি উপায়ই যথেষ্ট ।
এমন না যে পানির তলদেশের এই ক্যাবলে কেউ ইচ্ছে করে বাধা প্রদান করবে, তবে ২০০৮ সালে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া এবং ভারতের মধ্যে দুর্ঘটনাবশত যে ইন্টারনেটজনিত সমস্যা তৈরি হয়েছিলো সেটা যদি আবার ঘটে? দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই!
এমনকি কোনো দেশ নিজে থেকেও কিল সুইচের মাধ্যমে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে পারে। এই যেমন ২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় মিশর যেমনটা করেছিলো। পুরো দেশের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সেসময়। তুরস্ক এবং ইরানও একই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল। অবশ্য, এই সমস্যা উন্নত দেশে হওয়াটা সহজ নয়। সেক্ষেত্রে, বাইরের দেশের সাথে সম্পর্ক, মহাকাশের সাথে যেকোনো কার্যকলাপ- সবকিছুতে বাধা এসে পড়ে। তবে অনেকের মতে, খানিকটা সময় ইন্টারনেটের বাইরে থাকলে মানুষ নিশ্চয়ই নতুন কোনো উপায় বের করে নেবে। ফলে এ নিয়ে এত চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
তবু চলুন দেখে আসি এমন একদিন ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটলে আমাদের উপরে তার কী প্রভাব পড়তে পারে?
অর্থনৈতিক প্রভাব
বর্তমানে মানুষ ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য ইন্টারনেটের প্রতি অনেক বেশি নির্ভরশীল। কেবল একজন কিংবা দুজন মানুষ নয়, দেশগুলোও ইন্টারনেটের মাধ্যমে অর্থনৈতিক যোগাযোগ করে থাকে। ফলে ইন্টারনেট না থাকা দেশের এবং পৃথিবীর ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের উপরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড স্টেটস সাইবার কনসিকুয়েন্স ইউনিটের স্কট বর্গ জানান, ২০০৮ সালে এমন একটি গবেষণা তাদেরকে করতে হয়েছিল। প্রথমে মনে হয়েছিল এমন কিছু হলে বিশাল কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে। তবে বাস্তবে ফলাফল দাঁড়িয়েছিল একেবারেই ভিন্ন। গবেষণায় দেখা যায় যে, ইন্টারনেট একদিন না থাকলে যে অর্থনৈতিক সমস্যা হবে সেটা পরের চারদিনেই তুলে আনা সম্ভব।
উৎপাদনে প্রভাব
উৎপাদন, সেটা মানসিক এবং কায়িক দুটোই হতে পারে। একদিন ইন্টারনেট না থাকলে কাজের গতি ধীর হয়ে যাবে। উৎপাদন কম হবে। তবে সেটা খুব উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব রাখবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। উল্টো, তারা ভাবেন এমন কিছু হলে সেদিন মানুষ ইন্টারনেটে সময় ব্যয় করবে কম। ফলে কাজ হবে বেশি। হোটেল, এয়ারলাইন্সের মতন কিছু স্থানে খানিকটা ক্ষতি হয়ে যাবে এবং সেটা হয়তো পাকাপাকিভাবেই হবে। তবে সেটাও উল্লেখ করার মতো নয় বলে মনে করেন তারা। মানুষ ইন্টারনেট বাদ দিয়ে আর যে কাজগুলো করতো সেগুলো ঠিকভাবেই করবে। পরদিন ইন্টারনেট আবার চলে এলে বাড়তি কাজটুকু করে পুষিয়ে দেবে। সহজ সমাধান, তাই না?
ভ্রমণে প্রভাব
ভ্রমণে তখনই কোনো প্রভাব হয়তো ফেলবে না একদিনের ইন্টারনেটহীনতা, তবে পরবর্তীতে সেটা সমস্যা তৈরি করলেও করতে পারে। প্লেন চালাতে ইন্টারনেটের দরকার পড়ে না। কিন্তু সেদিনের টিকিটগুলো বিক্রি না হলে পরেরদিনের ফ্লাইট সঠিক সময়ে যাবে কিনা সেটা নিশ্চিত করা মুশকিল হয়ে পড়বে। ফলে কিছু টিকিট কম বিক্রি হবে।
মানসিক প্রভাব
আর সব প্রভাব তুচ্ছ হয়ে যায় এই একটি প্রভাবের কাছে। ইন্টারনেট একদিন না থাকলে আপনি হয়তো আপনার কাছের মানুষটির খবর নিতে পারবেন না, তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন না। আর এই ছোট্ট ব্যাপারটিই তৈরি করবে মানসিক সমস্যা। এমন না যে এই একদিনে সব কাজ কেউ শেষ করে ফেলতে পারতো, তবে ইন্টারনেট নেই সেটা মনে করলেই মানসিক উদ্বিগ্নতা বেড়ে যেতে বাধ্য। ধরুন, আপনি হঠাৎ বুঝতে পারলেন যে, আপনার ইন্টারনেটের সংযোগ নেই। আপনি কারো সাথে কথা বলতে পারছেন না, গান শুনতে পারছেন না, মুভি ডাউনলোড করতে পারছেন না, কোনো ব্যাপারে ইচ্ছে করলেই জানাতে পারছেন না- হয়তো ইন্টারনেট থাকলেও এগুলোর কোনোটাই আপনি করতেন না আজকে। তবে ইন্টারনেট নেই ভাবনাটিই আপনার মাথায় এই চিন্তাগুলো নিয়ে আসবে আরো বেশি করে। পাশে ঘরভর্তি মানুষ থাকলেও আপনার নিজেকে একা মনে হবে।
সামাজিক প্রভাব
ইন্টারনেট না থাকলে এমন না যে, সবাই সবসময় সবার সাথে কথা বলতো, সামাজিকতা রক্ষা করতো। তবে ইন্টারনেট না থাকায় মানুষ সামাজিক অন্যান্য দিকে মনোযোগ দেওয়ার অবসর পায়।
পাশেই যে মানুষটি আছে তার সাথে সময় কাটানোর ইচ্ছেকে বুঝতে পারে সে। অন্তর্জালের দুনিয়ার বাইরেও যে বাস্তব পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষগুলোর অস্তিত্ব আছে সেটা বোঝানোর জন্যে হলেও একদিন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া উচিত- এমনটাই ভাবেন অনেকে!
ফিচার ইমেজ- CNET