ট্রোজান হর্সের কথা মনে আছে? গ্রীকদের তৈরিকৃত ফাঁপা একটি ঘোড়ার ভাস্কর্য, যার ভেতর লুকিয়ে গ্রীকরা প্রবেশ করেছিল ট্রয় নগরীতে; ঐতিহাসিক ঐ ঘোড়ার ভাস্কর্যটিই ইতিহাসে ট্রোজান হর্স নামে পরিচিত। যুদ্ধের কাহিনী না জানলেও অন্তত ‘ট্রয়’ সিনেমার বদৌলতে ট্রোজান হর্সের রহস্য আমাদের সকলের সামনে উন্মোচিত হয়েছে অনেক আগেই।
কথিত আছে, পৃথিবীতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। কী ভাবছেন? বর্তমান পৃথিবীতে আবার কোথাও ট্রোজান হর্স ব্যবহার করা হয়েছে? উত্তর একইসাথে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। প্রযুক্তির এ যুগে ময়দানের যুদ্ধে ট্রোজান হর্সের প্রয়োগ করা না গেলেও অনলাইন দুনিয়ায় তা করা যায় খুব সহজেই। ট্রয়ের যুদ্ধে ভাস্কর্যের আড়ালে লুকিয়ে গ্রীকরা যেভাবে ট্রয় নগরীতে প্রবেশ করেছিল, ঠিক তেমনি স্প্যামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভাইরাসের মাধ্যমে অনলাইন জগতে এরূপ ধোঁকাবাজি চলে হরহামেশাই। এই ঘটনাকে যদি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলি, তাহলে খুব বেশি অতিরঞ্জন হয়ে যায় কি?
স্পাইআই ভাইরাস
আলজেরিয়ান হ্যাকার হামযা বেনদেলাজ হ্যাকিং জগতে বিএক্স১ ছদ্মনামে কাজ করতেন। ধারণা করা হয়, স্পাইআই নামক ভাইরাসের মূল ডেভেলপারদের মধ্যে বেনদেলাজ অন্যতম। স্পাইআই একটি সুপরিকল্পিত কম্পিউটার প্রোগ্রাম, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিভিন্ন গোপন এবং অর্থসংক্রান্ত তথ্য, যেমন অনলাইন ব্যাংকিংয়ের পরিচয়পত্র, ক্রেডিট কার্ডের তথ্য, ইউজারনেম, পাসওয়ার্ড, পিন নাম্বার সহ বিভিন্ন তথ্য চুরি করতে পারে। এ ভাইরাসটি যে কম্পিউটারকে সংক্রমিত করে, সেটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয় হ্যাকারের হাতে। পরবর্তীতে হ্যাকার তার ইচ্ছেমতো নির্দেশনা দিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ বা তথ্য সহজেই লুট করে নিতে পারে।
রাশিয়ার অ্যালেক্সান্ডার আন্দ্রেভিচ পানিন স্পাইআই ভাইরাসের মূল প্রোগ্রামার এবং পরিবেশক হিসেবে কাজ করেছেন। বেনদেলাজ ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ একজন সহযোগী। ২০০৯-১১ সাল পর্যন্ত পানিন এবং বেনদেলাজ অনলাইনে এই ভাইরাসটির প্রচার ও উন্নীতকরণের কাজ পরিচালনা করেন। তবে শুধুমাত্র যারা সাইবার-অপরাধী জগতের বাসিন্দা, তাদের কাছেই এই প্রচার ও প্রসার সীমাবদ্ধ ছিল। এসব অনলাইন সাইটের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল রাশিয়া ভিত্তিক ফোরাম, যেগুলোর মধ্যে ডারকোড ডট কম (Darkode.com) অন্যতম। এ সাইবার অপরাধীদের কাছে প্রায় ১০,০০০ ডলারের বিনিময়ে উন্নত মানের স্পাইআই ভাইরাস বিক্রি করা হতো। ধারণা করা হয়, এই ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৫০ জন ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয়েছে। ‘সোলজার’ নামক এক হ্যাকার জানান, তিনি এই ভাইরাসটির মাধ্যমে ৬ মাসের মধ্যেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৩.২ মিলিয়ন ডলার লুট করেছেন।
আদালতে দেয়া তথ্যানুযায়ী, এফবিআই কর্তৃক অবরুদ্ধ হবার পূর্ব পর্যন্ত ২০১০-১২ সালে বৈশ্বিক এক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫০ মিলিয়ন কম্পিউটার স্পাইআই ভাইরাসের আক্রমণের শিকার হয়েছে এবং সংক্রমণ থেকে পরিত্রাণের জন্য মালিকদের মোট খরচ করতে হয়েছে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার!
গ্রেফতার এবং শাস্তি
এক মার্কিন গুপ্তচরের কাছে স্পাইআই ভাইরাসের একটি কপি ৮,৫০০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করলে সর্বপ্রথম আমেরিকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বেনদেলাজকে চিহ্নিত করে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এর তথ্যানুযায়ী ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে মালয়েশিয়া থেকে আলজেরিয়া গমনের পথে ব্যাংককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরে থাই পুলিশের কাছে ধরা পড়েন তিনি। একই বছরের মে মাসে তাকে থাইল্যান্ড থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ঠিক তার পরের মাসেই হার্টসফিল্ড-জ্যাকসন আটলান্টা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ওপর দিয়ে যাওয়ার পথে গ্রেফতার হন স্পাইআই ভাইরাসের মূল প্রোগ্রামার পানিন।
পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের আওতায় তাদের অপরাধের পক্ষে-বিপক্ষে শুনানি শুরু হয়। পানিনের বিরুদ্ধে সাইবার প্রতারণা এবং ব্যাংক জালিয়াতির অভিযোগ এবং হামযা বেনদেলাজের ওপরেও এরূপ প্রায় ২৩টি অভিযোগ আনা হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতেই পানিন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ স্বীকার করে নেন এবং তারই পথ ধরে হামযা বেনদেলাজ ২০১৫ সালের ২৬শে জুন তার বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগের সবক’টিই স্বীকার করে নেন।
অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় রাশিয়ান অ্যালেক্সান্ডার আন্দ্রেভিচ পানিনকে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ কর্তৃক শাস্তি হিসেবে ৯ বছর ৬ মাসের কারাবাস প্রদান করা হয় এবং হামযা বেনদেলাজকে ১৫ বছরের কারাবাস প্রদান করা হয়। এফবিআই এর বিশেষ কর্মীদের দ্বারা এই মামলাটির সম্পূর্ণ তদন্ত পরিচালনা করা হয়।
মৃত্যুদন্ডের গুজব
হামযা বেনদেলাজকে কারাগারে প্রেরণের পরপরই তার অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের গুজব ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। তার সমর্থকেরা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার দাবিতে প্রচার-প্রচারণা চালাতে শুরু করে। ২০১৫ সালের আগস্টে তার এক সমর্থক এই মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণার প্রতিবাদ করে টুইট করেন। টুইটে বেনদেলাজ ফিলিস্তিনের অসহায়দের জন্য ২৮ কোটি মার্কিন ডলার দান করেছেন বলে দাবি করেন তিনি। তার এই বক্তব্যটি প্রায় ৪,৫০০ বার পুনরায় টুইট হয়। এই ঘটনার রেশ ধরে আলজেরিয়ায় অবস্থানরত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এই মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণার প্রতিবাদ জানিয়ে টুইট করেন।
অপরাধ স্বীকার সত্ত্বেও বেনদেলাজের সমর্থকেরা তার মুক্তির দাবিতে আমেরিকা, ফ্রান্স, জর্জিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ওয়েবসাইট হ্যাক করে যাচ্ছে। প্রচার-প্রচারণার কাজে তারা বেনদেলাজের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন ধরনের হ্যাশট্যাগও ব্যবহার করছে।
হ্যাকার নাকি হিরো?
বেনদেলাজ হ্যাকার নাকি হিরো? উত্তরটি কী হবে তা নির্ভর করছে কার কাছে এ প্রশ্নটি করা হচ্ছে, তার ওপর। স্বভাবতই যারা বেনদেলাজের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের কাছে তিনি ভিলেন, আবার যারা তার দ্বারা উপকৃত হয়েছেন তাদের কাছে তিনি পরোপকারী রবিন হুড।
ধারণা করা হয়, স্পাইআই ভাইরাসের সাহায্যে বেনদেলাজ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকার কম্পিউটারগুলোতে প্রায় ১ মিলিয়নের বেশি স্পাম ইমেইল পাঠিয়েছেন। এর ফলে প্রায় কয়েক’শ হাজার কম্পিউটার এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় তিনি সংক্রমিত কম্পিউটারগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন এবং প্রায় অর্ধ মিলিয়ন ব্যক্তির ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বার চুরি করেছেন, যা ছিল নিতান্তই ব্যক্তির গোপন ও ব্যক্তিগত তথ্য। এসব তথ্য ব্যবহার করে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার চুরি করেছেন বলে জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ।
প্রায় দুশ’রও বেশি মার্কিন ব্যাংক থেকে তার বিরুদ্ধে অর্থ চুরির অভিযোগ উঠলেও চুরিকৃত অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে কোথাও নিশ্চিতভাবে কিছু বলা হয়নি। একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, তার অপরাধের ফলে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার। আবার অন্য একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে তার অপরাধের ফলে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার। তবে ৯০০ মিলিয়ন ডলারের হিসেবে ভাইরাস সংক্রমিত কম্পিউটারগুলোর মেরামতের খরচও গণনা করা হয়েছে।
আল জাজিরার একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত হামযা বেনদেলাজ তার এই চুরিকৃত মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ফিলিস্তিনির গরিবদের জন্য দান করে দিয়েছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এ বক্তব্যকে ন্যায্যতা প্রদান করতে তারা হামযা বেনদেলাজের গ্রেফতার পরবর্তী একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি উপস্থাপন করেছে এবং তাকে ‘হ্যাপি হ্যাকার‘ উপাধি প্রদান করেছে। মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সে সময়টাতে এমন প্রচার প্রচারণা চালানো হয়েছিল। আদালতের কাগজ-পত্রে চুরিকৃত অর্থ কীভাবে খরচ করা হয়েছে, তা উল্লেখ করা হয়নি। তার অর্থ খরচের যে কয়টি তথ্য পাওয়া গেছে তার সবক’টি সংগ্রহ করা হয়েছে অনলাইন থেকেই।
পুঁজিপাতি বুর্জোয়াদের দৃষ্টিতে এবং আইনের চোখে তিনি সর্বদাই একজন অপরাধী। তবে মানবতাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে অনেকে এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, সমগ্র বিশ্বে যেখানে চলছে লুটপাটের চর্চা সেখানে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে অসহায়, নির্যাতিত, নিপীড়িত কিছু মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে হামযা বেনদেলাজ যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন তা তাকে সত্যিকারের নায়কের মর্যাদায় আসীন করেছে। অন্তত তার সমর্থকরা এমনটাই মনে করছেন।
ফিচার ইমেজ: আল জাজিরা