মহাকাশ যাত্রাকে একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান হিসেবে দাবি করা হয়। একটি মহাকাশ যান তৈরি ও সেটির উড্ডয়নের পেছনে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। একই সাথে নভোচারীদের প্রশিক্ষণ, রকেট তৈরি, এর জ্বালানীর খরচ, উড্ডয়ন পরিচালনা ইত্যাদির পেছনে প্রচুর শ্রম ও অর্থের প্রয়োজন। তাছাড়া বিভিন্ন ধরণের ঝুঁকির সম্ভাবনা তো আছেই। কিছুদিন আগেই ভারতের তৈরি চন্দ্রযান ২ মহাকাশযানটি তার উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়। অপেক্ষাকৃত স্বল্প খরচে তৈরি এই যানটি নিয়ে ভারতের মানুষের জল্পনা কল্পনার শেষ ছিল না। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে এর যান্ত্রিক গোলযোগ ঘটে এবং শেষমেষ যানটি চাঁদের পৃষ্ঠে ক্র্যাশ করে। প্রতি বছরই এরকম অসংখ্য ব্যর্থ মিশনের খবর পত্রিকার পাতায় ছাপতে থাকে।
মহাকাশ অভিযান নিয়ে অনেক ব্যর্থতার গল্প রয়েছে। প্রচুর অর্থ খরচ করার পরও সাফল্যের মুখ দেখেনি অনেক মিশন। কিন্তু মানুষ থেমে নেই। এই যাত্রাকে আরো বিপদমুক্ত করার প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা চলছে। একদিন আমাদের মতো সাধারণ মানুষও যাতে মহাকাশে যাত্রা করতে পারে, তার জন্য গবেষণা চলছে। আর এরকম বহু গবেষণার মধ্যে একটি হলো স্পেস এলিভেটর। স্পেস এলিভেটর বলতে আক্ষরিক অর্থেই মহাকাশে যাওয়ার লিফটের কথা বলা হচ্ছে। আদতে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো শোনালেও বাস্তবে এটি নিয়ে ঠিকই গবেষণা চলছে। আর এই গবেষণা কিন্তু একেবারে নতুনও নয়। প্রায় দেড়শ বছর আগে থেকেই মানুষ এমন একটি বস্তু বানানোর কথা চিন্তা করছে।
স্পেস এলিভেটর আসলে কী?
স্পেস এলিভেটর বলতে তাত্ত্বিকভাবে টেথার বা লম্বা বর্ধনশীল এক শিকলকে বোঝায়, যেটি পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে মহাকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এমন একটি কাঠামোর ভরকেন্দ্র পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৩৫,৭৮৬ কিলোমিটার উপরে জিওস্টেশনারি অরবিটে অবস্থান করবে। এখানে জিওস্টেশনারি অরবিট হলো সেই বৃত্তাকার কক্ষপথ যার পর্যায়কাল ২৪ ঘণ্টা, অর্থাৎ পৃথিবীর পর্যায়কালের সমান। এই পথ দিয়ে চলাচল করতে পারবে বিভিন্ন তড়িৎচুম্বকীয় যানবাহন, মানুষ ও নানা ধরণের ভারী মালামাল। বর্তমানে মহাকাশে যাতায়াতের একমাত্র রাস্তা রকেট হলেও এলিভেটরের মাধ্যমে এই যাতায়াত অনেক কম খরচে ও নিরাপদে পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
স্পেস এলিভেটর সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায় ১৮৯৫ সালে। রাশিয়ান বিজ্ঞানী কনস্ট্যানটিন সিয়োলকভস্কি এর প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন। মূলত প্যারিসের আইফেল টাওয়ার থেকে তিনি ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি ভাবলেন, এমন একটি লিফট তৈরি করা যায় কি না, যার কেন্দ্র থাকবে জিওস্টেশনারি অরবিটে এবং তা ভূপৃষ্ঠে একটি টাওয়ারের সাথে যুক্ত হবে।
সেই আমলে এমন তত্ত্ব কল্পনা করাটাও অনেকে বোকামি মনে করতো। কারণ এমন একটা বস্তু তৈরি করতে যে মজবুত কাঠামোর প্রয়োজন তা কেবল কল্পবিজ্ঞানেই পাওয়া সম্ভব। যেখানে পৃথিবীতে এক কিলোমিটার লম্বা কাঠামোরই কোনো অস্তিত্ব নেই, সেখানে হাজার কিলোমিটারের তৈরি কাঠামোর চাপ পৃথিবী কীভাবে বহন করবে? সেই প্রশ্ন মাথায় আসাটা একেবারে স্বাভাবিক।
এই স্পেস এলিভেটর কেবল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে স্থান পেলেও বিজ্ঞানীরা কিন্তু একেবারে আশা ছেড়ে দেননি। ১৯৬০ সালে আরেকজন রাশিয়ান বিজ্ঞানী য়ুরি আর্টসুতানভ স্পেস এলিভেটর নিয়ে তার আধুনিক ধারণা লিখিত আকারে প্রকাশ করেন। তার মাধ্যমেই স্পেস এলিভেটর নিয়ে গবেষণা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। পরবর্তীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে এই গবেষণায় নতুন সম্ভাবনার পথ উন্মোচন হতে থাকে।
স্পেস এলিভেটর তৈরিতে যা যা প্রয়োজন
ইন্টারন্যাশনাল স্পেস এলিভেটর কনসোর্টিয়াম (ISEC) নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে এই এলিভেটর তৈরি সংক্রান্ত নানা সম্মেলন আয়োজন করে আসছে। প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে তৈরি এই সভায় নানা প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এমন একটি প্রজেক্টকে সফল করতে প্রয়োজন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রচুর গবেষণা। কারণ যে এলিভেটর তৈরির পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তার উচ্চতা হবে প্রায় ১ লক্ষ কিলোমিটার। এই উচ্চতা পৃথিবীর পরিধির থেকেই দ্বিগুণের বেশি। কাজেই এলিভেটরটাকে ভূপৃষ্ঠে নিজের বিরাট ওজন সামলাতে হবে। আর এজন্য এলিভেটরের উপাদান এমন কোনো পদার্থ দিয়ে তৈরি হতে হবে, যার ভর তুলনামূলক কম কিন্তু শক্তি অনেক বেশি। দুর্ভাগ্যবশত, এমন কোনো পদার্থ পৃথিবীতে নেই। এটিই একটি স্পেস এলিভেটর তৈরির পেছনে মূল প্রতিবন্ধকতা।
স্পেস এলিভেটর নিয়ে গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে এটি নিয়ে গবেষকদের আশা অনেক কম ছিল। কারণ সম্ভাবনার থেকে প্রতিবন্ধকতাই যে ছিল অনেক বেশি। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে গবেষকদের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার ঘটতে থাকে। আর এই আশার আলো বয়ে আনে ন্যানো প্রযুক্তি।
বর্তমানে গবেষকগণ মনে করেন, স্পেস এলিভেটরের যাতায়াত পথের উপাদান হিসেবে কার্বন ন্যানোটিউব ব্যবহার করা যেতে পারে। এই কার্বন ন্যানোটিউব এবং এর মূল গাঠনিক উপাদান গ্রাফিন অত্যন্ত হালকা এবং নমনীয়। অপরদিকে এটি সাধারণ স্টিলের তুলনায় প্রায় ২০০ গুণ বেশি শক্তিশালী। কাজেই এই উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে পুরো এলিভেটরের ওজন অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব।
যাতায়াত পথের তার বা টেথার তৈরির প্রতিবন্ধকতা দূর হওয়ার পর যেটি আসে, তা হলো টানা কাঠামোর ধারণা। অর্থাৎ এত বড় একটি স্থাপনা ভেঙে না পড়ে কীভাবে এক জায়গায় স্থির থাকবে, তার সমাধান। পাঠকদের পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে টুকটাক ধারণা থাকলে পরের অংশটি বোঝা একটু সহজ হবে।
এই স্পেস এলিভেটর মূলত হবে কার্বন ন্যানোটিউবের তৈরি নমনীয় টাওয়ার যার উপর কোনো অভিকর্ষ বল কাজ করবে না। টাওয়ারের এক অংশ থাকবে ভূপৃষ্ঠে এবং অপর অংশে যুক্ত থাকবে একটি ভারী বস্তু। এই ভারী বস্তুর উপস্থিতির কারণে তৈরি হবে কেন্দ্রবিমুখী বল। ভারী বস্তুটিকে এমনভাবে স্থাপন করা হবে যাতে এর ফলে সৃষ্ট কেন্দ্রবিমুখী বল অভিকর্ষ বলের তুলনায় সামান্য বেশি হয়। এতে করে টাওয়ারটি স্থিতিশীল থাকবে এবং ভেঙে পড়ার ঝুঁকিও থাকবে না। মূলত কেন্দ্রবিমুখী বল অভিকর্ষ বলের চেয়ে বেশি হওয়ায় এবং টাওয়ারটি জিওস্টেশনারী অরবিটে অবস্থান করায় তা এক জায়গায় স্থির থাকবে এবং পৃথিবীর উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করবে না।
স্পেস এলিভেটরের জন্য আরো একটি বড় ঝুঁকি হলো কৃত্রিম উপগ্রহ এবং মহাকাশের আবর্জনা। যেহেতু এলিভেটরের যাতায়াত পথ স্থির থাকবে, সেহেতু গতিশীল আবর্জনা ও উপগ্রহের সাথে প্রচন্ড বেগে সংঘর্ষের একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। আর এই সংঘর্ষের কারণে এলিভেটরের টেথার ছিঁড়ে যেতে পারে। এই সমস্যাটি নিয়ে বিশেষভাবে আলোকপাত করেছেন মার্কিন প্রকৌশলী ও মহাকাশ বিজ্ঞানী জেরোম পিয়ারসন। তার মতে, স্পেসএক্স, নাসা ও অন্যান্য মহাকাশ সংস্থাগুলো যে হারে কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরি করছে, তা স্পেস এলিভেটরের জন্য গুরুতর সমস্যা বয়ে আনতে পারে। তাছাড়া মহাকাশের আবর্জনা, রকেটের ধ্বংসাবশেষগুলোও ঝুঁকির মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। তাই স্পেস এলিভেটরের সাথে এগুলোর সংঘর্ষ এড়ানোর ব্যবস্থা আগেই করতে হবে।
এতক্ষণ পড়ে আসা কথাগুলো অনেকের কাছে নিছক কল্পবিজ্ঞান মনে হতে পারে। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই এই কল্পবিজ্ঞানকে বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টা চলছে। জাপানের বিখ্যাত নির্মাণ সংস্থা ওবায়াশি কর্পোরেশন ঘোষণা দিয়েছে, তারা ২০৫০ সালের মধ্যেই এই বস্তু নির্মাণ করবে। আবার চীন ২০৪৫ সালের মধ্যে এমন একটি এলিভেটর তৈরি করতে চায়। যদিও স্পেসএক্স-এর প্রতিষ্ঠাতা এলন মাস্ক এমন একটি এলিভেটর তৈরির সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তবুও এই প্রজেক্টের সাথে জড়িত অনেক প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে, আমরা আমাদের জীবদ্দশাতেই একটা স্পেস এলিভেটর দেখে যেতে পারবো। এই শতাব্দীর মাঝেই হয়তো মহাকাশে যাওয়ার এই বিকল্প রাস্তা তৈরি হয়ে যাবে।
স্পেস এলিভেটরের কি আদৌ প্রয়োজন রয়েছে ?
নীল নকশা থেকে বের হয়ে যদি সত্যি সত্যিই আনুষ্ঠানিকভাবে স্পেস এলিভেটর তৈরি শুরু হয়, তবে সেটি হবে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্প। এমন একটি প্রকল্পের পেছনে আনুমানিক ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারে। তবে বলে রাখা ভাল যে, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যয়বহুল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্প হলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। এটি তৈরিতে বিভিন্ন দেশের উদ্যোগে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল। সেই তুলনায় স্পেস এলিভেটরের খরচ তুলনামুলক কম। আর আর্থিক দিক বিবেচনা করলে, তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নত রাষ্ট্রের জন্য এটি তৈরি করা খুব কঠিন কোনো সমস্যা না।
খরচের দিক থেকে অনুকূলে থাকলেও এই স্পেস এলিভেটর তৈরির পেছনে অনেক ঝুঁকি রয়েছে। আকারে অনেক বড় হওয়ায় এর নির্মাণ কাজ শেষ হতে অনেক দিন পার হয়ে যাবে। নির্মাণ খরচ বাদ দিলে এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ আর সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের খরচও রয়েছে। তবে এই উদ্যোগ হাতে নিলে মহাকাশে যাতায়াত কয়েকগুণ সহজ হয়ে যাবে।
বর্তমানে পৃথিবীর কক্ষপথে কোনো যন্ত্র স্থাপন করতে হলে প্রতি পাউন্ড ভরের জন্য ৩,৫০০ মার্কিন ডলার খরচ হয়। স্পেস এলিভেটর চালু হলে এই খরচ প্রতি পাউন্ডের জন্য ২৫ ডলারে নেমে আসবে। এমনটিই দাবি করেছেন ISEC এর সভাপতি পিটার সোয়ান। তাছাড়া রকেটে যাতায়াত এমনিতেই অনেক ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। এতে করে যাতায়াতের জন্য নভোচারীদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। এছাড়াও রকেটের একটা বিরাট অংশ গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে মহাশূন্যে ফেলে দেওয়া হয়। এই ধ্বংসাবশেষ আবর্জনা হিসেবে মহাশূন্যে ভাসতে থাকে। আবার রকেটের জ্বালানির পেছনেও একটা বিরাট খরচ থাকে। আর এর ধোঁয়া পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর। কাজেই স্পেস এলিভেটর তৈরি হলে রকেটের নেতিবাচক দিকগুলো থেকে অনেকটা রেহাই পাওয়া যাবে। নানা ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ মিশন সহজে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। আর সাধারণ মানুষের মহাকাশ ভ্রমণের ইচ্ছাও সহজ করে দিতে পারে এই স্পেস এলিভেটর।
শেষ কথা
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী অনেক পছন্দ করেন এমন পাঠকেরা আর্থার সি ক্লার্ক নামটি শুনে থাকবেন। জনপ্রিয় এই ব্রিটিশ লেখক তার ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ফাউন্টেনস অফ প্যারাডাইস’ বইটিতে সর্বপ্রথম স্পেস এলিভেটর দিয়ে মহাকাশ যাত্রার ব্যাপারটি তুলে ধরেন। স্পেস এলিভেটর সম্পর্কে তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা অনেক বিজ্ঞানীদের আকৃষ্ট করেছিল। বহু আগে থেকেই মানুষ বইয়ের পাতার কল্পবিজ্ঞানকে বাস্তবে রূপায়িত করে আসছে। স্পেস এলিভেটরও সেই তালিকায় নাম লেখাবে কি না তা কেবল সময়ই বলে দেবে।