অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র: যান্ত্রিক আতঙ্ক

প্রথম পর্বঃ আগ্নেয়াস্ত্রের অগ্নি উদ্গিরণ

গত পর্বে ছিল অসাধারণ এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কিছু আগ্নেয়াস্ত্রের গল্প। এই পর্বে লেখা হলো এমন কিছু যন্ত্রের কথা যেগুলোর কার্যকারিতা শুনলেই আতঙ্কে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়।

টেসার শকওয়েভ

শুরুটা করা যাক কোনো ধরণের মারণাস্ত্র ছাড়াই, লোকজনকে মৃত্যুর স্বাদ দিতে না পারলেও বেশ বড়সড় একটি ধাক্কা দিতে এই যন্ত্রের জুড়ি মেলা ভার। এই টেসার শকওয়েভ মূলত ব্যবহার করে পুলিশরা, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়া লোকজনের ভয়াবহ ইলেক্ট্রিক শকের আঘাতে লুটিয়ে পড়তে খুব একটা দেরি হবে না।

“প্রোটেক্ট লাইফ” মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত টেসার কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসে এই যন্ত্র। বিশাল এলাকা ঘিরে ইলেক্ট্রিক ওয়েভ পাঠিয়ে দিয়ে একজায়গায় জড়ো হওয়া লোকজনদের সবাইকেই শক দেওয়া সম্ভব। এই যন্ত্র মূলত দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, ১০০ মিটার পর্যন্ত নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে শকওয়েভ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গাড়িতে লাগিয়েও এই যন্ত্র ব্যবহার করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে টেসার কোম্পানি বিভিন্ন ধরণের স্টান গান, শটগান বাজারে নিয়ে এসেছে, যার সাহায্যে সহজেই শত্রুকে ভূপাতিত করা যায়।

টেসার শকওয়েভ স্টানগান; ছবিসূত্র: SRS Protection Inc.

দ্য অ্যাকটিভ ডিনায়াল সিস্টেম [ADS]

যুক্তরাষ্ট্রের “রে গান” হিসেবে পরিচিত এই এডিএস-ও কোনো মারণাস্ত্র নয়, কিন্তু বলতে গেলে এটি মরণের চেয়েও বেশি কিছু। রাডার অ্যারে আর মাইক্রোওয়েভের কম্বিনেশনে তৈরি এই যন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর বিশেষ ব্যবহারের জন্য তৈরি করে রেথিওন কোম্পানি। ইতিমধ্যেই আফগানিস্তান যুদ্ধে এর ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছে।

এডিএস শত্রুর দিকে তাক করে মাইক্রোওয়েভের চেয়ে সামান্য কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ ছুড়ে মারে। এই তরঙ্গ চামড়ার উপরের স্তর শুষে নিয়ে এতটাই তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করে যে এর নামই হয়ে গেছে “দ্য গুডবাই ওয়েপন”! একে অনেকে তুলনা করেছেন এমনভাবে যেন চামড়ার উপরে কেউ জ্বলন্ত টিউবলাইট চেপে ধরে রেখেছে। এই তীব্র ব্যথার কারণে সাধারণ মানুষের উপর এটি ব্যবহারের জন্যও সমালোচিতও হয়েছে। ৭০০ মিটার দূর থেকে এই তরঙ্গ ছুড়ে দেওয়া গেলেও এটি ৫ সেকেন্ডের বেশি ক্রিয়া করলেই চামড়া পুড়ে যেতে পারে।

দ্য অ্যাক্টিভ ডিনায়াল গ্লোবাল সিস্টেম; ছবিসূত্র: flightglobal

থান্ডার জেনারেটর

নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যন্ত্রটি “বজ্র উৎপাদনকারী”-এর মতো কিছু একটা হবে, এবং আসলেও তাই। এই যন্ত্রটি মূলত কানফাটানো শব্দ উৎপাদন করে। পাখি তাড়ানোর জন্য আবিষ্কার হলেও যন্ত্রটি বর্তমানে মানুষ তাড়াতেও ব্যবহার করা হচ্ছে। ইজরাইলের সীমানায় এই যন্ত্রটির দেখা মিলবে খুব সহজেই। দূর নিয়ন্ত্রিত এই যন্ত্র কাজ করতে পারে ৫০ মিটার পর্যন্ত, এই সীমানার মধ্যে কেউ থাকলে সে বধির হয়েও যেতে পারে। আর ১০ মিটারের মধ্যে থাকলে মৃত্যুও অস্বাভাবিক কিছু নয়! তরল পেট্রোলিয়াম, জ্বালানি গ্যাস এবং বাতাসের সাহায্যে তৈরি এই যন্ত্র আদপে অসাধারণ কিছু মনে না হলেও শত্রুকে নিজ এলাকা থেকে দূরে রাখতে যথেষ্ট কার্যকরী।

দ্য থান্ডার জেনারেটর; ছবিসূত্র: spiegel.de

দ্য লেজার অ্যাভেঞ্জার

শত্রুপক্ষের ছুঁড়ে মারা বিশাল গোলা ছুঁড়ে আসছে আপনার দিকে! এমতাবস্থায় আপনি কি করবেন? পালিয়ে যাবেন নাকি চুপচাপ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবেন? এর কিছুই করতে হবে না যদি আপনার কাছে লেজার অ্যাভেঞ্জারের মতো কোনো যন্ত্র থেকে থাকে, যদিও এই জিনিসটি শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই রয়েছে।

মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের অদৃশ্য এই রশ্মি ইলেক্ট্রিভ স্টোভের তুলনায় ২০ গুণ গরম, যা দিয়ে সহজেই শত্রুর ছুঁড়ে দেয়া গোলা উড়ন্ত অবস্থাতেই কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা যায়। এছাড়াও আকাশে উড়তে থাকা উড়োযানও এই যন্ত্র দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব!

লেজার অ্যাভেঞ্জার; ছবিসূত্র: thefutureofthings.com

মার্স রোবট [MAARS]

কাইনেটিক কিউকিউ কোম্পানির এই রোবটও মূলত ব্যবহার করা হয় দূর থেকে বোমা নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার জন্য। “মড্যুলার অ্যাডভান্সড আর্মড রোবোটিক সিস্টেম”-এর আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই যন্ত্রতে থাকে এমবি২৪০ মেশিন গান, ৪০ মিমি গ্রেনেড লঞ্চার, লেজার, বন্দুক এমনকি স্মোক গানও। দূর থেকে বোমা নিষ্ক্রিয় করা কিংবা শত্রুকে নিকেশ করে দিতে মার্স অত্যন্ত যুগোপযোগী একটি যন্ত্র। তবে এটিও শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই রয়েছে।

মার্স রোবট; ছবিসূত্র: far-maroc.forumpro.fr

রেইল গান

বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে রেইল গানের চেয়ে সুবিধাজনক যন্ত্র মনে হয় না আর একটাও আছে। অন্যান্য অস্ত্রের তুলনায় খরচ কম করেও আরও কয়েক গুণ বেশি কাজ করতে রেইলগানের সমকক্ষ আর নেই। তড়িৎ-চুম্বকীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা এই যন্ত্র গোলা নিক্ষেপ করে কোনো ধরণের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার ছাড়াই। হোমোপোলার মোটর ব্যবহার করে ৪৫০০ মাইল প্রতি ঘণ্টা অর্থাৎ শব্দের তুলনায় সাড়ে সাত গুণ বেগে গোলা ছুড়তে পারে এই রেইল গান। আর এই গোলার ওজনও কম নয়, প্রতিটির ওজন কমপক্ষে ২৩ পাউন্ড! এছাড়াও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের ফলে এর খরচও কমে যায় বহুগুণে। এই অসাধারণ দ্রুতগতির অস্ত্র পরীক্ষা সফলভাবে চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। জলপথেও এর ব্যবহার কিভাবে করা যাবে তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে ইউনাইটেড স্টেটস নেভি। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই যুদ্ধক্ষেত্রে এর প্রয়োগ দেখা যেতে পারে। একইরকম প্রযুক্তিকে মাথায় নিয়ে “লাইট গ্যাস গান” নামেও আরেকটি অস্ত্র বানানো হয়েছে।

রেইল গান; ছবিসূত্র: atimes.com

স্বয়ংক্রিয় বুলেট/স্মার্ট বুলেট

“শত্রু এবং আপনার মাঝখানে যদি কোনো বাধা আড়াল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে কিভাবে শত্রুকে নিকাশ করা যায়?”- এমন কিছু চিন্তা মাথায় নিয়েই DARPA উদ্ভাবন করেছে স্মার্ট বুলেট বা স্বয়ংক্রিয় বুলেট যা শূন্যে ভাসমান অবস্থাতেই নিজের দিক পরিবর্তন করে ফেলতে পারবে! শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তাই না? শুধু দিক পরিবর্তন নয়, বরং আরও কয়েক ধরণের স্মার্ট বুলেট রয়েছে যেগুলো উড়ন্ত অবস্থাতেই ডেটা প্রেরণ করবে, শত্রুর অবস্থান খুঁজে বের করবে এমনকি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত যাওয়ার পর নিজে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে! লেজারের সাহায্যে দিক পরিবর্তন করা এই স্মার্ট বুলেটের পরীক্ষা সফল হলেও এখনো সামরিক বাহিনীতে এই অসাধারণ প্রযুক্তিটি যোগ করা হয়নি, সফলভাবে আরও কিছু পরীক্ষা চালানোর পরই হয়তো যুক্ত করা হবে।

স্মার্ট বুলেট; ছবিসূত্র: Popular Science

অ্যাডভান্সড প্রিসিশন কিল ওয়েপন সিস্টেম (APKWS)

বিশাল নামের এই যন্ত্র নিজের কাজেও বিশাল। ১.৮৭ মিটারের বিশালাকার এই মিসাইলের ওজন প্রায় ৫ কেজি। ইনফ্রারেড লেজারের সাহায্যে চলা এই মিসাইল নিয়ন্ত্রণ করাও খুব সহজ, এটি ছুঁড়তে অন্যান্য মিসাইলের তুলনায় মাত্র চারভাগের এক ভাগ সময় ব্যয় হয়। উৎপাদন খরচ এবং পারিপার্শ্বিক ক্ষতি কম হওয়ায় এটি প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার হচ্ছে। এই মিসাইলের দায়িত্বে থাকা BAE সিস্টেম এখনো পর্যন্ত পাঁচ হাজারেরও বেশি APWKS উৎপাদন করেছে!

APKWS; ছবিসূত্র: janes.com

ড্রোন

ড্রোন! এ আবার নতুন কি? প্রতিনিয়তই তো ড্রোন দেখা যাচ্ছে, এবং সেটা খুব সাধারণ কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে স্কাউট কিংবা তথ্য সংগ্রহ করা ইত্যাদি কাজে ড্রোন ব্যবহার করা হলেও ভবিষ্যতে সামরিক কাজে যে এর ব্যবহার বেড়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য। এখনো তৈরি করা না হলেও এমন প্রযুক্তির ড্রোন নিয়ে পরীক্ষা চালানো হচ্ছে যেখানে ড্রোন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যে নিজে নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ চালাতে পারবে। বর্তমানে সবচেয়ে আধুনিক সামরিক ড্রোন হলো এমকিউ৯ রিপার ড্রোন যা প্রায় ৩৬ ঘণ্টা ধরে উড়তে পারে! ২০০১ সালে আমেরিকার সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হওয়া এই ড্রোন উপরে উঠতে পারে ৫২ হাজার ফিট উপর পর্যন্ত এবং তা ৫০০ পাউন্ড ওজনের বোমাসহ!

এমকিউ৯ রিপার ড্রোন; ছবিসূত্র: cgsociety.org

Related Articles

Exit mobile version