রাশিয়া ফুটবল বিশ্বকাপে ব্যবহৃত আধুনিক তিন প্রযুক্তি

বিশ্বব্যাপী ফুটবল খুবই জনপ্রিয়। তাই খেলাটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ শিল্প। তাই অপ্রীতিকর সব ঘটনা ও ভুল যেন কম হয় সেদিকে চোখ সবার। পাশাপাশি রেফারির নেওয়া সিদ্ধান্ত যাতে সুষ্ঠু হয়, সেদিকেও সকলের নজর। এ কাজে আধুনিক প্রযুক্তির তুলনা হয় না। বহু বছর ধরেই ব্রডকাস্টিং, লাইভ স্ট্রিমিং ইত্যাদিতে নানা প্রযুক্তির ব্যবহার করে আসছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গোল, অফসাইড, প্যানাল্টির মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর ব্যাপারে প্রধান রেফারির উপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো উপায় থাকতো না। ফলে প্রায় খেলাতেই একটু আধটু ভুল সিদ্ধান্ত থেকে যেত।

এটি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন কোম্পানির সাথে যৌথ প্রযোজনায় কাজ করে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। পূর্বে কিছু প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হলেও বড় আসরগুলোতে তেমন একটা ব্যবহার হতো না; হলেও, বিভিন্ন সময় নির্ভুলভাবে কাজ করতে না পারায় সমালোচকদের সমালোচনায় ঠাই হতো সেগুলোর। কিন্তু রাশিয়াতে শুরু হওয়া বিশ্বকাপের এবারের আসরে সেগুলোকে বেশ আগ্রহের সাথে ব্যবহার করা হচ্ছে। গোল-লাইন প্রযুক্তিকে করা হয়েছে আরো উন্নত, প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি’। এছাড়াও বিশ্বকাপের অফিশিয়াল বল টেলস্টার এইটিন-এ ব্যবহার করা হয়েছে নিয়ার-ফিল্ড কমিউনিকেশন প্রযুক্তি। চলুন, এ প্রযুক্তিগুলো নিয়ে বিস্তারিত জেনে নিই।

গোল-লাইন প্রযুক্তি

জাপান ক্লাব বিশ্বকাপ, কনফেডারেশন কাপে সফল ব্যবহারের পর নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে সর্ব প্রথম গোল-লাইন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। সমালোচকদের সমালোচনা পাশ কাটিয়ে আগ্রহীদের কাছে বেশ প্রশংসাও কুঁড়ায় সে সময়। কিন্তু বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় ইউরোপীয় লিগ, প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক আসর ছাড়া তেমন একটা ব্যবহার করা হয়নি। ২০১৫ সালের মহিলা বিশ্বকাপের পর, এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপের আসরে অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির সাথে এই প্রযুক্তিও রয়েছে নির্ভুল গোল নির্ণয়ের লক্ষ্যে।

গোল-লাইন প্রযুক্তি মূলত বলটি গোলপোস্টের বার বা গোল লাইন অতিক্রম করল, নাকি করল না তা নির্ণয় করে। আর সেই তথ্য রেফারি সহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কাছে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে জানিয়ে দেয়। রেফারি ও অন্যান্যদের কাছে তথ্য গ্রহণ করার জন্য বিশেষ স্মার্টওয়াচ থাকে।

গোল হলো কি, হলো না তা নির্ণয় করে গোল-লাইন প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত সফটওয়্যারটি রেফারির স্মার্টওয়াচে জানিয়ে দিচ্ছে; Image Source: Digitaltrends.com

২০১২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বোর্ড দ্বারা প্রযুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ফিফা কনফেডারেশন কাপে জার্মান ভিত্তিক কোম্পানির তৈরি গোলকন্ট্রোল নামের গোল-লাইন প্রযুক্তিটি ব্যবহার করা হয়। সে সময় প্রযুক্তিটি পুরো আসরে হওয়া ৬৮টি গোলের প্রত্যেকটি গোল নির্ণয় করতে সক্ষম হয়।

গোল-লাইন প্রযুক্তিতে ক্যামেরার ব্যবহার; Image Source: dw.com

গোলকন্ট্রোল সিস্টেমটিতে সাতটি করে দুই গোলপোস্টের জন্য চৌদ্দটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। ক্যামেরা থেকে পাওয়া ফুটেজগুলো একটি সফটওয়্যার স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখে বলটি পুরোপুরি গোলপোস্টের বার বা লাইন অতিক্রম করেছে কি না। এরপর প্রাপ্ত ফলাফল মুহূর্তের মধ্যেই কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়।

গোল-লাইন প্রযুক্তিতে চৌম্বকক্ষেত্রের ব্যবহার; Image Source: dw.com

অপরদিকে, গোলপোস্ট বার এবং গোল লাইনের নীচে চৌম্বকক্ষেত্র বিশিষ্ট ক্যাবল স্থাপন করেও গোলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। এক্ষেত্রে খেলায় ব্যবহৃত বলটিতেও কিছু বিশেষ প্রযুক্তি যুক্ত করতে হয়। বলটি গোলপোস্টের কাছাকাছি পৌঁছনোর পর, বলে থাকা রিসেপ্টর এবং ক্যাবলের চৌম্বকক্ষেত্রের দূরত্ব সফটওয়ারের মাধ্যমে হিসেব করে পূর্বের মতোই কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়, বলটি গোল লাইন অতিক্রম করলো কি না। 

ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (VAR)

ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি বা VAR’কে এখন পর্যন্ত ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ প্রযুক্তি বলা যেতে পারে। ২০১৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বোর্ডের ‘ল অব দ্য গেম’ দ্বারা স্বীকৃতি পায় এটি। এর প্রধান কাজ হলো, ভিডিও নির্ভর প্রযুক্তির সাহায্যে খেলা চলাকালীন সময়ে মাত্র ঘটে যাওয়া খেলার ফুটেজগুলো পরীক্ষা করা এবং নির্ভুল সিদ্ধান্তে আসা।

সিদ্ধান্তে আসার ব্যাপারটি দুই রকমের হতে পারে। প্রথমত, প্রধান রেফারি কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণার পূর্বে সরাসরি VAR-এর সুপারিশ চাইতে পারেন। ভিএআর যদি রেফারির সিদ্ধান্তে কোনো ভুল না পায়, তাহলে রেফারির সাথে যোগাযোগের প্রয়োজন বোধ করে না। এটি ‘সাইলেন্ট চেক’ হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ, রেফারির সিদ্ধান্তই সঠিক। অপরদিকে, যদি রেফারির সিদ্ধান্তে ভুল থাকে, তাহলে তারা নির্ভুল সিদ্ধান্তটি রেফারিকে জানায়। সেক্ষেত্রে রেফারি ভিএআর-এর সিদ্ধান্তটি নিজে ঘোষণা করতে পারেন, অথবা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে অন-ফিল্ড রিভিউর জন্য আবেদন করতে পারেন। রেফারির সাথে ভিএআর-এর পুরো যোগাযোগটি এয়ারপিসের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এছাড়াও, প্রধান রেফারি ‘রেফারি রিভিউ অ্যারিয়া’তে অবস্থিত মোবাইল-মনিটর-ডেক্সে গিয়েও মাত্র ঘটে যাওয়া ফুটেজগুলো দেখে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন। 

কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পূর্বে প্রধান রেফারি ‘রেফারি রিভিউ অ্যারিয়া’তে অবস্থিত মোবাইল-মনিটর-ডেক্সে গিয়েও মাত্র ঘটে যাওয়া ফুটেজগুলো দেখে নিচ্ছে; Image Source: fifa.com

খেলা চলাকালীন সময় চারটি ক্ষেত্রে প্রধান রেফারি ভিএআর-এর সাহায্য নিতে পারেন- গোলটি বৈধভাবে হলো কিনা যাচাই করতে, ডি-বক্সে কোনো রকম ফাউল, হ্যান্ডবল হলো কিনা; অর্থাৎ, প্যানাল্টির সিদ্ধান্ত নিতে, দোষী খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখানোর ক্ষেত্রে এবং ভুল করে নির্দোষ খেলোয়াড়কে কার্ড দেখানো হলে, সেটি বাতিল করতে। 

সাধারণত পুরো কাজটি সম্পাদন করতে ভিডিও অপারেশন রুম বা VOR’এ তিনজন অপারেটর থাকে। একজন প্রধান ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি, যিনি সরাসরি মাঠে অবস্থানরত প্রধান রেফারির সাথে যোগাযোগ বজায় রাখবে এবং কোনো রিভিউর পর উপযুক্ত সিদ্ধান্ত জানাবে। দ্বিতীয়জন, সহকারী ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির ভূমিকা পালন করবে; যাকে অবশ্যই ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বোর্ড দ্বারা স্বীকৃত বর্তমান বা সাবেক রেফারি হতে হবে। তার কাজ হচ্ছে, সরাসরি খেলার দিকে মনোযোগ রাখা এবং প্রধান ভিএআরের কাছে আসা রিভিউগুলো চেক করে তাকে জানানো। তৃতীয়জন, রিপ্লে অপারেটরের ভূমিকা পালন করবে। 

এবারের বিশ্বকাপে ম্যাচ চলাকালীন সময়ে VOR’এ ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির আট সদস্য; Image Source: fifa.com

তবে, এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপে নির্ভুল এবং দ্রুতগতি সিদ্ধান্তে আসার জন্য ভিডিও অপারেশন রুমে একজন ভিএআর, তিনজন সহকারী ভিএআর এবং চারজন অপারেটর সহ মোট আটজন দায়িত্ব পালন করছে। চারজন রিপ্লে অপারেটরের মধ্যে দুজন ঘটনাটি ঘটার সম্ভাব্য অ্যাঙ্গেলের ফুটেজগুলো রিপ্লে করবে। অপর দুজনের কাজ হচ্ছে প্রধান ভিএআর এবং সহকারী ভিএআরের নির্দেশে ঠিক যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে সেই অ্যাঙ্গেলের ফুটেজগুলো রিপ্লে করা।

যে অ্যাঙ্গেলে মাঠে ক্যামেরেগুলো অবস্থান করে; Image Source: fifa.com

এবারের বিশ্বকাপে ভিএআরের সদস্যরা মস্কো ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্ট সেন্টারের ভিডিও অপারেশন (VOR) রুম থেকে পুরো কাজটি সম্পাদন করছে। রাশিয়ার এগারোটি শহরে অবস্থিত ১২টি স্টেডিয়াম থেকে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রত্যেকটি স্টেডিয়ামে থাকা ৩৩টি ক্যামেরা থেকে ভিডিও ফুটেজগুলো সরাসরি ভিওআরে পৌঁছায়। ভিওআরে অবস্থানরত সদস্যরা স্টেডিয়ামে অবস্থান করা ফিফার কর্তৃপক্ষ এবং প্রধান রেফারির সাথে যোগাযোগের জন্য শক্তিশালী ফাইবার-লিংকড রেডিও সিস্টেমের ব্যবহার করে থাকে।

রাশিয়ার এগারোটি শহরে অবস্থিত ১২টি স্টেডিয়াম থেকে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রত্যেকটি স্টেডিয়ামে থাকা ৩৩টি ক্যামেরা থেকে ভিডিও ফুটেজগুলো সরাসরি মস্কো ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্ট সেন্টারের ভিওআরে পৌঁছায়; Image Source: fifa.com

ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি প্রযুক্তিটি বর্তমানে বেশ কর্মক্ষমতা সম্পন্ন এবং নির্ভুল হলেও, প্রাথমিক অবস্থায় একে নিয়ে ফিফা কর্তৃপক্ষের বেশ কাঠখড় পুঁড়াতে হয়েছে। ২০১৬ সালে জাপানে হয়ে যাওয়া ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড-কাপ ফাইনালে এটি প্রথম ব্যবহার করা হয়। সে সময় রিয়াল মাদ্রিদের পরিচালক এবং বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি ফুটবলার জিনেদিন জিদান একে ‘বিভ্রান্তির উৎস’ হিসেবে অ্যাখ্যা দেন।  ২০১৭ সালের কনফেডারেশন কাপে ভিএআরের কারণে হয়ে যাওয়া কিছু বিতর্কিত মুহূর্তের জন্য সমালোচকদের নিন্দা কুঁড়ায়।

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রিমিয়ার লিগে বোয়াভিসটা এবং অ্যাভেসের খেলায় অ্যাভেসের করা একটি গোলে অফসাইড হওয়ার সম্ভবনা দেখা দিলেও, ভিএআরে ব্যবহৃত ক্যামেরার ফুটেজ বোয়াভিসটার একজন সাপোর্টারের পতাকার কারণে অস্পষ্ট হয়ে যায়। ফলে প্রধান রেফারি সন্দেহে থাকা সত্ত্বেও এটিকে গোল হিসেবে ঘোষণা দেন।

এছাড়াও এ বছরের এ-লিগ গ্র্যান্ড ফাইনালে নিউ-ক্যাসল জেটস এফসি এবং মেলবোর্ন ভিক্টরি এফসি’র খেলায় মেলবোর্ন ১-০’তে ম্যাচটি জিতে যায়। পরবর্তীতে জানা যায়, ঐ একটিমাত্র গোল অফসাইড হওয়ার কারণে বাতিল হতো, কিন্তু ভিএআরের সফটওয়্যারে সেসময় ত্রুটি দেখা দেওয়ায় সেটি সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। তবে পরবর্তীতে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের ম্যাচগুলোতে নির্ভুল তথ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করায়, কর্তৃপক্ষ প্রযুক্তিটিকে বিশ্বকাপের মূল আয়োজনে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ভুল, বা টেকনিক্যাল ত্রুটিবিচ্যুতির কথা শোনা যায়নি।

টেলস্টার এইটিন

টেলস্টার এইটিন হাতে ফুটবল যাদুকর মেসি; Image Source: mirror.co.uk

এবারের বিশ্বকাপের প্রধান আকর্ষণগুলোর মধ্যে অ্যাডিডাসের তৈরি অফিশিয়াল ম্যাচ বল ‘টেলস্টার এইটিন’ অন্যতম। ১৯৭০ এর বিশ্বকাপে সাদাকালো টেলিভিশনে দেখার উপযোগী করে অ্যাডিডাস প্রথম ‘টেলস্টার’ বলটির ডিজাইন করে। ৩২ টেক্সচার্ড প্যানেলের এই বলটিতে রাশিয়ার বিশ্বকাপে ছয়টি টেক্সচার্ড প্যানেল রাখা হয়। সেলাইয়ের বদলে অবিচ্ছিন্নভাবে সংযুক্ত করতে ব্যবহৃত হয় শক্তিশালী আঠা। এতোগুলো পরিবর্তনের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পরিবর্তন হচ্ছে, বলটিতে নিয়ার-ফিল্ড কমিউনিকেশনের ব্যবহার। 

ফিচার ছবি: goalcontrol.de

Related Articles

Exit mobile version