আপনি যদি এই মুহূর্তে এই লেখা পড়ে থাকেন, তবে হয়তো আপনি কয়েক মিনিট আগেই আপনার কিবোর্ডটি ব্যবহার করেছেন। হোক সেটি আপনার কম্পিউটারের কিংবা আপনার স্মার্টফোনের, এই কিবোর্ড আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। ভাবুন তো, যদি কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোনে এই কিবোর্ড না থাকতো তবে কীভাবে আপনি আপনার প্রয়োজনীয় তথ্যটি লিখে রাখতেন?
লেখালেখি সহ নানাবিধ কাজের সাথে জড়িয়ে আছে এই কিবোর্ড। আর বর্তমানে আমরা যে কিবোর্ড ব্যবহার করি সেটি হলো QWERTY কিবোর্ড। ভেবে দেখেছেন কি, এই কিবোর্ডের অক্ষরগুলো এমন এলোমেলো কেন? কেনই বা এগুলো বর্ণানুক্রমে সাজানো হয়নি? চলুন আজকে জেনে নেয়া যাক এসব অজানা প্রশ্নের উত্তর।
শুরুটা হলো যেভাবে
কম্পিউটার কিবোর্ডের শুরুটা আসলে হয় টাইপিং মেশিন থেকে। ১৮৭৩ সালের কথা। সেসময় ক্রিস্টোফার লাথাম শোলেস নামের এক ব্যক্তি চেষ্টা করছিলেন অফিসের লেখালেখির কাজগুলো কীভাবে আরো সহজে করা যায়। এ সময় তিনি লেখার জন্য নানা ধরনের মেশিন ও তাদের অক্ষরবিন্যাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম কার্যকরী টাইপরাইটার মেশিন উদ্ভাবন করেন।
শুরুর দিকে শোলেসের উদ্ভাবিত সেই টাইপিং মেশিনের কি বা বাটনগুলো বর্ণানুক্রমিকভাবেই ছিল। তার তৈরি এই টাইপিং মেশিন এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, মানুষ ধীরে ধীরে এই মেশিনে অনেক দ্রুততার সাথে টাইপ করা রপ্ত করে ফেলে। তবে এক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদের মধ্যে একটি সমস্যার আবির্ভাব ঘটে। দেখা যায়, খুব দ্রুত টাইপ করতে গেলেই টাইপরাইটারের বাটন বা কিগুলো মাঝে মাঝে আটকে যাচ্ছে। ফলে লেখার জন্য বড় একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এটি।
QWERTY কিবোর্ড
শোলেস এই সমস্যা দূর করার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ নানা ধরনের গবেষণা চালান। নানা ধরনের অক্ষরবিন্যাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন তিনি। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি এই সমস্যার সমাধান করতে পারছিলেন না। হঠাৎ একদিন তার মাথায় একটি বুদ্ধি আসে। তিনি ভাবেন, দ্রুত লেখার জন্যই যেহেতু বাটনগুলো আটকে যাচ্ছে, তাহলে যে ব্যক্তি টাইপ করছেন তার আঙ্গুল চালনার গতি কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করা যাক। আর সেটা করতে তিনি লেখার সময় যে অক্ষরগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় সেগুলো একে অন্যের থেকে দূরে দূরে রেখে নতুন একটি অক্ষরবিন্যাস বা লেআউট উদ্ভাবন করেন। আর এভাবেই জন্ম হয় বর্তমানের বহুল ব্যবহারিত QWERTY কিবোর্ডের।
তবে কম্পিউটারে এই কিবোর্ডের ব্যবহার শুরু হয় কিছুটা দেরিতে। ১৯৬০ সালে বব ও জোয়ান ক্রোজিয়ার নামের এক দম্পতি ভেবে দেখেন, নানা ধরনের ব্যবসায়িক লেখালেখির কাজেও কম্পিউটারকে ব্যবহার করা যেতে পারে। আর কম্পিউটারের সাথে যদি কিবোর্ড যুক্ত করা যায় তাহলে সেসব কাজ হয়ে যায় অনেক সহজ। বর্তমানে আমরা পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসি বলতে যে ছোটখাট কম্পিউটারকে বুঝি সেসময় কিন্তু এমন কম্পিউটার ছিল না। সেসময় ছিল বড় আকারের মেইনফ্রেম কম্পিউটার। ক্রোজিয়ার দম্পতিই সর্বপ্রথম এই কম্পিউটারের সাথে কিবোর্ড যুক্ত করে নতুন এক বিপ্লবের সূচনা করেন।
কম্পিউটারে কিবোর্ড
১৯৭০ সালের দিকে সর্বপ্রথম কম্পিউটার কিবোর্ডের প্রচলন ঘটতে থাকে। তবে সেসময় প্রথমদিকে বিশাল আকারের মেইনফ্রেম কম্পিউটারের জন্য কিবোর্ডগুলো বিশেষ প্রয়োজনে তৈরি করা হতো। এই কিবোর্ডগুলোতে একই সময়ে মাত্র একটি বাটন চাপা যেতো। বাটনগুলোকে ঝালাই করে বোর্ডের সাথে লাগানো থাকতো। কিবোর্ডের কোনো কভারও ছিল না সেসময়।
তবে এর কিছুকাল পরে বিশ্বের প্রথম ছোট আকারের পার্সোনাল কম্পিউটার বাজারে আসে। S100 নামে পরিচিত এই কম্পিউটারগুলোর কোনো হার্ড ড্রাইভ কিংবা ফ্লপি ডিস্ক ড্রাইভ ছিল না। ফলে কোনো তথ্য এতে সংরক্ষণ করে রাখা যেত না। এই ধরনের কম্পিউটারগুলো চালাতে হলে কম্পিউটারের সামনের প্যানেলে যুক্ত কিবোর্ডের মাধ্যমে সরাসরি প্রোগ্রামিং কোড লিখে চালাতে হতো। ফলে এই কম্পিউটার চালাতে খুবই ঝামেলার সম্মুখীন হতেন ব্যবহারকারীরা।
এছাড়া বর্তমান কিবোর্ডের মতো লেখালেখির জন্য সুবিধাজনক কিবোর্ড তখন কম্পিউটারের সাথে যুক্ত থাকতো না। ফলে লেখালেখি করতে চাইলে ব্যবহারকারীকে IBM এর ইলেকট্রিক টাইপরাইটার কিনে কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করতে হতো। এরপর ডাটা এন্ট্রির জন্য খুঁজতে হতো আলাদা ডাটা এন্ট্রি কিবোর্ড, আর খুঁজে না পেলে নিজেকেই তৈরি করে নিতে হতো। তবে সত্তরের দশকের শেষের দিকে বাজারে প্রথম ব্যবহারযোগ্য কম্পিউটার কিবোর্ড আসতে শুরু করে। আর এর পেছনে প্রধান অবদান রাখে অ্যাপল, রেডিও স্যাক ও কম্মোডোর মতো কোম্পানিগুলো।
আধুনিক যুগের কিবোর্ড
১৯৮০ সাল আসতে আসতেই কম্পিউটার কিবোর্ডের ইতিহাসের আধুনিক যুগ শুরু হয়। আশির দশকের শুরু দিকেই IBM তাদের সর্বপ্রথম পার্সোনাল কম্পিউটার বাজারে ছাড়ে। এই কম্পিউটারে যুক্ত ছিল তাদের বিখ্যাত ‘মডেল M’ কিবোর্ড। গুণগত মান ও ব্যবহারের সুবিধার জন্য এই কিবোর্ড বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে এই কিবোর্ডেও একটি সমস্যা ছিল।
সেটি হলো, এই কিবোর্ডে ‘Enter’ ও ‘Shift’ বাটন দুটি ছিল খুবই ছোট। ফলে লেখার ক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধা হতো ব্যবহারকারীদের। তবে শেষমেশ IBM এই সমস্যার এক সমাধান বের করে ফেলে। তারা এই দুটি বাটনের জন্য আলাদা দুটি ক্যাপ বাজারে ছাড়ে, যা আগের কিবোর্ডের উক্ত বাটন দুটির উপরে লাগিয়ে নিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো।
বর্তমানে যেমন নানা রঙের কিবোর্ড বাজারে দেখা যায়, সেসময় কিন্তু এত রঙের কিবোর্ড পাওয়া যেতো না। সেসময় কিবোর্ডের রঙ হতো কালচে সাদা কিংবা ধূসর বর্ণের। আশির দশকের শেষের দিকে সর্বপ্রথম কালো রঙের কিবোর্ড বাজারে আসে। সেসময় কিবোর্ডের প্রতিটি অক্ষরযুক্ত বাটন তৈরি করতে আলাদা আলাদা ছাঁচ ব্যবহার করা হতো।
আর কিবোর্ড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও ছিল সেসময় অনেক কম। ফলে কিবোর্ডের দাম ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। তবুও বাজারে ব্যাপক হারে বিক্রি হতো কিবোর্ড। তবে ১৯৮০ দশকের শেষের দিকে ধীরে ধীরে নতুন নতুন অনেক কিবোর্ড প্রস্তুতকারী কোম্পানির সূচনা ঘটে। ফলে ধীরে ধীরে কমতে থাকে কিবোর্ডের দাম। ১৯৮৫ সালে IBM সর্বপ্রথম ‘Touchdown Keytop Overlays‘ নামের কিবোর্ডের বাটনে লাগানোর জন্য এক ধরনের আঠালো স্টিকার উদ্ভাবন করে। এর ফলে প্রতিটি বাটনের জন্য আলাদা আলাদা ছাঁচ তৈরি প্রয়োজন হয় না আর। ফলে কিবোর্ডের দাম কমে যায় একেবারেই। বর্তমানেও এ ধরনের স্টিকার বাজারে পাওয়া যায়।
এরপর ১৯৯০ সালে কিবোর্ডের জগতে আসে ‘মেমব্রেন সুইচ’ নামক এক বিশেষ প্রযুক্তি। এর ফলে কিবোর্ডের বাটনের আকৃতি হয়ে যায় ক্ষুদ্র ও চ্যাপ্টা। এই দশকেই বাজারে আসে ল্যাপটপ কম্পিউটার। ল্যাপটপ কম্পিউটারে ব্যবহৃত হয় এই মেমব্রেন সুইচ যুক্ত কিবোর্ড। ফলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই প্রযুক্তি। এরপর ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা ও মাল্টিমিডিয়ার প্রসারের ফলে কিবোর্ডে আরো কিছু ফাংশন ও নেভিগেশনাল কি এর আবির্ভাব ঘটে। একুশ শতকের শুরু দিকে আরো কিছু উন্নয়ন ঘটে কিবোর্ডের। দীর্ঘক্ষণ টাইপ করার ফলেও যাতে হাতের ক্লান্তি না আসে এমন বৈশিষ্ট্যযুক্ত কিবোর্ড আসে বাজারে।
তবে অতি দরকারি এই কিবোর্ডের প্রয়োজনও ধীরে ধীরে কমে আসছে। ভয়েস রিকগনিশন, টাচ স্ক্রিন কম্পিউটার প্রভৃতি প্রযুক্তির ফলে কিবোর্ডের ব্যবহার দিন দিন কমে যাচ্ছে। গবেষকদের মতে, এসব নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমেই হয়তো একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে প্রায় ১৫০ বছর ধরে আমাদের সেবাদানকারী এই কিবোর্ড।
ফিচার ইমেজ – wallpaperflare.com