আমরা ধীরে ধীরে বর্তমান প্রযুক্তির শীর্ষের দিকে এগোচ্ছি। এতে কিছু প্রযুক্তির উদ্ভাবনী ক্ষমতার হার অনেকাংশে কমে গেছে। তন্মধ্যে কম্পিউটিং প্রযুক্তিতে উদ্ভাবনই বোধহয় সবচেয়ে ধীরগতিতে চলছে, এবং ইতোমধ্যেই ঘনিয়ে আসছে মূরের সূত্রের দিন। যার ফলে প্রযুক্তিবিদ এবং গবেষকদের খুঁজতে হচ্ছে অন্য পথ। মূরের সূত্রের মৃত্যু আমাদের অন্য একটি জগতের ধারণায় নিয়ে যায়। সেটি হচ্ছে কোয়ান্টাম জগত, যা আমাদের বর্তমান কম্পিউটিং জগতকে হাসির খোরাকই বানিয়ে দিয়েছে। অপার সম্ভাবনার এই জগত কি আমাদের বাস্তব জীবনে চলে আসবে? এই লেখায় তুলে ধরা হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভবিষ্যত এবং সম্ভাবনা নিয়ে।
কোয়ান্টাম দুনিয়া যেভাবে চলে
আমাদের বর্তমান কম্পিউটার চিপগুলো খুবই সাধারণ কম্পোনেন্ট দিয়ে তৈরি। এককথায় বললে, একটি ইলেক্ট্রনিক চিপ মডিউলের সমন্বয়ে তৈরি, মডিউলগুলো লজিক গেট দিয়ে তৈরি, এবং লজিক গেটের মূলে রয়েছে ট্রানজিস্টর। একটি ট্রানজিস্টরের ভাষা হলো ০ এবং ১, এদের বলে বিটস (Bits)। একটি ট্রানজিস্টর একই সময়ে শুধুমাত্র একটি মান বহন করতে পারে (০ অথবা ১)। এই ট্রানজিস্টরগুলো মিলে লজিক গেট তৈরি করা হয়, যেগুলোও এই বিটের সাহায্যে যোগ, গুণের মতো সাধারণ কাজ করে থাকে।
এভাবে একটি ট্রানজিস্টর গাণিতিক হিসেব করে থাকে। এর অর্থ হলো- আমরা যত বেশি ট্রানজিস্টর মিলে একটি চিপ তৈরি করবো, তা তত বেশি জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে পারবে। বর্তমানে একটি চিপে বিলিয়নের বেশি ট্রানজিস্টর থাকতে পারে, এবং এই ট্রানজিস্টরগুলো বলে দিচ্ছে ইলেক্ট্রন বা বিদ্যুৎকে কোন পথে যেতে হবে এবং কোন পথটি তার জন্য বন্ধ।
একটি কম্পিউটার চিপের ট্রানজিস্টরগুলোকে ঢাকা শহরের বড় দালানগুলোর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ধরে নেয়া যাক, ঢাকা শহরের একটি এলাকায় একটি দালান থেকে আরেক দালানের মাঝে ১৪ ন্যানোমিটারের দূরত্ব আছে, যার ফলে দালানের মানুষগুলো ঝাপ দিয়ে এক দালানের ছাদ থেকে আরেক দালানের ছাদে যেতে পারছে না। কিন্তু এই দূরত্ব যতই কমবে ততই যেতে পারার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে, এবং একপর্যায়ে কমতে কমতে তা সম্ভব হবে। বাস্তবে দু’দালানের মাঝে এমন সম্পর্ক প্রেমের সূত্রপাত ঘটিয়ে দিতে পারলেও ইলেক্ট্রনিক চিপে যদি এমনটা ঘটে তাহলে পুরো ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। এ অবস্থাকে বলে কোয়ান্টাম টানেলিং, এবং এখানেই কোয়ান্টাম চিপের ধারণা আসে। কোয়ান্টাম জগতে পদার্থবিদ্যা আলাদাভাবে কাজ করে এবং আমাদের গতানুগতিক চিপগুলো তার অর্থ হারিয়ে ফেলে।
শুরুতে বিটের কথা বলা হয়েছিল। আমরা ইলেক্ট্রনিক চিপ দিয়ে যে কাজই করি না কেন তা ০, ১-এ রুপান্তরিত হয়ে যায় এবং প্রতিটি ট্রানজিস্টর একটি মান নিয়ে চলে। কোয়ান্টাম জগতে রয়েছে কিউবিটস (Qubits), এটিও সাধারণের মতো ০ ও ১ এই দুটি মান নিয়ে চলতে পারে। তবে সাধারণের মতো ইলেক্ট্রনের প্রবাহ দিয়ে এর মান নির্ধারণ বা পরিবর্তন হয় না, ইলেক্ট্রনের স্পিন বা ফোটন (আলোর কণা) দিয়ে এর মান নির্ধারণ হয়।
ইলেকট্রনের স্পিন কিংবা ফোটনের ব্যবহার কোয়ান্টাম চিপে একটি বিশেষত্বের জন্ম দেয়, সেটি হচ্ছে কোয়ান্টাম সুপার পজিসন, যার কারণেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার সবার থেকে নিজেকে আলাদা করেছে।
কোয়ান্টাম সুপারপজিশনের মাহাত্ম্য
কোয়ান্টাম জগতের ‘বিট’ অর্থাৎ ‘কিউবিট’ ভিন্নভাবে কাজ করে। আগেই বলা হয়েছে, সাধারণ একটি চিপে ট্রানজিস্টর একই সময়ে শুধু একটি মান নিয়ে চলতে পারে, কিন্তু কোয়ান্টাম চিপ একই সময়ে দুটি মান নিয়েই চলতে পারে। একেই বলে সুপারপজিশন।
একটি পাঁচ টাকার কয়েন টসের কথা চিন্তা করা যাক। কয়েনটি টস করা হলে হয় আমরা পাবো শাপলা, নাহয় যমুনা সেতু। কিন্তু কয়েনটি যতক্ষণ শূন্যে ঘুরতে থাকবে এটি দুটো মানই হতে পারে যতক্ষণ না এটি থামানো হবে, এবং আমরা দেখবো ততক্ষণ এটি একটি অনিশ্চয়তা এবং সম্ভাবনার মাঝে থাকবে।
এটিই কোয়ান্টাম সুপারপজিশন এবং এর কারণেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার এতটা শক্তিশালী। ধারণাটি আরও পরিস্কার করার জন্য একটা গোলকধাঁধার সাহায্য নেয়া যাক।
ধরা যাক, একটি সাধারণ কম্পিউটারকে গোলকধাঁধায় ঢুকিয়ে বলা হলো বের হওয়ার পথ বের করতে। তো এটি কী করবে? আপনার-আমার মতো সব রাস্তায় গিয়ে দেখতে থাকবে কোনটি বের হওয়ার পথ। কিন্ত কোয়ান্টাম কম্পিউটার সব রাস্তায় একসাথেই ঢুকতে পারবে। সম্ভাবনা এর কাছে নিছক খেলার মতো।
কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট: অসমাধিত বিস্ময়
কিউবিট আরও একটি জিনিস করতে পারে, সেটি হচ্ছে কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট। কয়েন টসের বিষয়টিই ধরা যাক, টস করার পর যদি শাপলা ওঠে তাহলে তো আমরা বুঝবোই যে বিপরীত পাশে যমুনা সেতু আছে। ব্রিফকেসে করে আপনার একজোড়া মোজার একটি যদি লন্ডনে বন্ধুর কাছে পাঠান এবং আরেকটি অ্যান্টার্কটিকায়, এবং আপনার বন্ধু খুলে দেখে সেখানে ডান পায়ের মোজা রয়েছে, তাহলে তো আরেকটি ব্রিফকেস না খুলেই জানা গেলো বাম পায়ের মোজাটি অ্যান্টার্কটিকায় রয়েছে। কোয়ান্টাম জগতে দুটি বিট একটি রহস্যময় পদ্ধতিতে একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে।
যদি দুটো ইলেক্ট্রন কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্টের দ্বারা যুক্ত থাকে এবং একটির ঘূর্ণন যদি ঘড়ির কাটার দিকে হয়, অপরটির ঘূর্ণন অবশ্যই বিপরীতে হবে। এখন যদি বাহ্যিক বল প্রয়োগে জোর করে একটির ঘূর্ণন উল্টিয়ে দেয়া যায় এবং অপরটি যদি চাঁদেও থাকে তাহলেও সেটির ঘূর্ণন প্রথমটির বিপরীত হবে। অর্থাৎ একটির মান জানতে পারলে আমরা না দেখেই অপরটির মান বের করতে পারবো। এভাবে কোয়ান্টাম সুপারপজিশন এবং এন্ট্যাঙ্গলমেন্টের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার।
কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট কীভাবে কাজ করে বিজ্ঞানীরা এখনও সেটির উত্তর খুঁজছেন। কিন্ত কোয়ান্টাম জগতের মূল বিস্ময় হচ্ছে এটি সম্ভবনা নিয়ে কাজ করতে পারে এবং সুপারপজিশনে থাকতে পারে। কোয়ান্টাম চিপ তৈরি হয় কোয়ান্টাম গেট দিয়ে।
আমাদের বর্তমান লজিক গেটে আমরা দুটি মান ইনপুট করলে এটি হিসেব করে একটি মান দেবে, কোয়ান্টাম গেট একটি সম্ভাবনা নিয়ে সেটি হিসেব করে আরেকটি সম্ভাবনাই প্রদান করবে, যা সুপারপজিশনে থাকবে। যখনই আমরা আউটপুট চাইবো তখনই এটি সঠিক উত্তরটি দিয়ে দেবে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কাজ কী?
কোয়ান্টাম কম্পিউটার মানে যেকোনো কাজ খুব দ্রুত কিংবা সাশ্রয়ীভাবে হবে তা নয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটার আমাদের সেসব করতে সাহায্য করবে যেগুলো আমরা কোনোদিন ভাবিইনি করা সম্ভব। যেসব কাজ সুপার কম্পিউটারও করতে পারে না তা কোয়ান্টাম কম্পিউটার পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতিতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিশাল ভূমিকা পালন করবে। ইতোমধ্যেই গুগল কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সাহায্যে তাদের সফটওয়্যার এবং চালকহীন গাড়ির উন্নয়ন সাধন করছে। গুগলে সার্চ করলে সেকেন্ডেরও কম সময়ে এত ফলাফল আমরা কীভাবে পাই?
একটি সাধারণ কম্পিউটারের কিছু সমাধান করতে যত সময় লাগবে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে ঐ সময়ের স্কয়ার-রুট (√) পরিমাণ সময় প্রয়োজন হবে। এছাড়া নির্ভুল রাসায়নিক বিক্রিয়া সংগঠন এবং সম্ভাবনায় কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ব্যবহার রয়েছে। বর্তমানের সুপার কম্পিউটার দিয়ে সাধারণ রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোর পরীক্ষা করা হয়, কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার জটিল সব সমীকরণের সমাধান নিমেষেই করতে পারবে। এতে আমরা শুধু সাশ্রয়ী রাসায়নিক পণ্যই না, অনেক জটিল রোগের ওষুধও সহজেই পেতে পারি।
আমাদের বর্তমান সুপার কম্পিউটারগুলো যে কাজ করতে সবচেয়ে বেশি সময় নেয়, কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেটিই সবচেয়ে সহজভাবে করে, তা হলো ভবিষ্যত সম্ভাবনা নির্ণয় করা। এর মাঝে রয়েছে অর্থনৈতিক বাজার, আবহাওয়া বার্তা, পদার্থবিজ্ঞানের জটিল সব সমীকরণ সমাধানসহ আরও সব চাঞ্চল্যকর বিষয়।
তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ডাটা এনক্রিপশন পদ্ধতিকে নিমিষেই ভেঙে দিতে পারে যা একইসাথে একটি নেতিবাচক এবং ইতিবাচক দিক। আজকের জগতে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সুরক্ষার জন্য ডাটা এনক্রিপশন ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। এতে প্রতিটি এনক্রিপশনে একটি পাবলিক কী ও প্রাইভেট কী তৈরি হয় এবং এই পাবলিক কী ফাইলটির এনক্রিপসন চেনার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, কিন্তু এটি দিয়েও ফাইলটি ডিক্রিপশন করার জন্য প্রাইভেট কী বের করা সম্ভব।
সাধারণ কম্পিউটারে এটি করতে বছরের পর বছর লেগে যাবে, কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটারের লাগবে কয়েক মিনিট! এখন এটি যেমন আমাদের বর্তমান আইটি ব্যবস্থায় ধস নামিয়ে দিতে পারে, তেমনই কোয়ান্টাম কম্পিউটার দ্বারা তৈরি এনক্রিপশন কী কেউই ভাঙতে পারবে না, কোয়ান্টাম কম্পিউটারও না!
কবে আমাদের হাতে আসবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার?
এর উত্তর “না, হয়তো কখনোই না“। দশকের পর দশক ধরে কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, কিন্তু এত ধীরগতিতে এর কাজ এগোনোর কারণ হলো বাহ্যিক পরিবেশের প্রতি এরা খুবই স্পর্শকাতর। সুপারপজিশনে রাখতে হলে একে হিমাংকের নিচে এবং যাবতীয় ইলেক্ট্রনিক বাধা থেকে মুক্ত রাখতে হয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটার তো গেম খেলার জন্য তৈরি নয়। বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়িক ও গবেষণায়ই এর মূল ক্ষেত্র। তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পূর্ণ ক্ষমতা অর্জনের জন্য আরও সময় প্রয়োজন।
বর্তমানে সবচেয়ে ক্ষমতাধর কোয়ান্টাম কম্পিউটারে কিউবিট সংখ্যা ৫৩, যা গুগলের। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে গুগলের প্রকাশিত একটি পেপারে তারা বলেছে- তারা এটি দিয়ে এমন এক সমস্যার সমাধান করেছে যা বর্তমানের সেরা সুপার কম্পিউটার দিয়ে সমাধান করতে ১০,০০০ বছর লাগতো।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার আমাদের অভাবনীয় সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। যদিও এর পেছনে আরও অনেক বছর সময় দিতে হবে এবং বিজ্ঞানীরা এখনও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতের এই প্রযুক্তি যে আমাদের মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা দিতে সক্ষম তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।