আপনি স্টিভ জবসকে চেনেন নিশ্চয়ই। বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গকেও নিশ্চয়ই চেনেন। প্রযুক্তির দুনিয়ার এসব রথী-মহারথীর নাম হেন মানুষ নেই জানেন না। প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত বা অসম্পৃক্ত আপনি যা-ই হোন না কেন, প্রতিনিয়তই আপনি ফেসবুক, অ্যাপল বা মাইক্রোসফটের মতো জনপ্রিয় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সেবা নিচ্ছেন বা পণ্য ব্যবহার করছেন। কিন্তু যারা এখন এই আর্টিকেলটি পড়ছেন, তাদের বেশিরভাগই যে মানুষটিকে চেনেন না অথচ যাঁর সৃষ্ট প্রযুক্তি দুনিয়ায় এনেছে বিপ্লব তিনি লিনাস টোরভাল্ডস, লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের স্রষ্টা। তাঁর সৃষ্টি নিয়ে কেবলমাত্র ব্যবসা করলেন না বলে, তাঁর কোম্পানির শেয়ার নিয়ে শিরোনাম হচ্ছে না বলে, দুনিয়া জুড়ে অন্য এক দাসত্বের গল্প লিখলেন না বলে সারা দুনিয়ার কাছে ব্রাত্য হয়েই থেকে গেলেন তিনি ।
কেন এ কথা বলা হচ্ছে যে লিনাস টোরভাল্ডস প্রযুক্তির দুনিয়ায় বড়সড় বিপ্লব এনেছেন? সে কথা দিয়েই শুরু করা যাক। দুনিয়াজুড়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ যে প্রযুক্তি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন তা হলো স্মার্টফোন, এবং সিংহভাগ স্মার্টফোন যে অপারেটিং সিস্টেমে চলে তার নাম অ্যান্ড্রয়েড। গুগলের হাত ধরে বাজারে এসেছিল মূল লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের একটি পরিবর্তিত ভার্সন এই অ্যান্ড্রয়েড। অর্থাৎ আমরা যে অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করছি সেগুলো মূলত লিনাস টোরভাল্ডসের তৈরি লিনাক্সের একটি পরিবর্তিত ভার্সনেই চলছে। বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেম যেমন উইন্ডোজের মতোই লিনাক্সও একটি অপারেটিং সিস্টেম। সারা দুনিয়ার সিংহভাগ সার্ভার লিনাক্সের উপর নির্ভরশীল৷ সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আর হ্যাকারদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম লিনাক্স। এর পরেও কি এটা বলা যাবে না যে প্রযুক্তির দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়েছেন লিনাস টোরভাল্ডস?
১৯৬৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর, ফিনল্যাণ্ডের হেলসিনকিতে জন্ম নেন লিনাস। পুরো নাম লিনাস বেনেডিক্ট টোরভাল্ডস, তবে সবাই তাঁকে লিনাস টোরভাল্ডস নামেই চেনে। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী লিনাস পলিংয়ের নাম ধার করে তাঁর নাম রাখার হয় ‘লিনাস’। সাংবাদিক পরিবারে জন্ম হয় লিনাসের- বাবা নিলস টোরভাল্ডস এবং মা অ্যানা টোরভাল্ডস দুজনই ছিলেন সাংবাদিক, এমনকি দাদা অলে টোরভাল্ডস তো ছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক। লিনাসের বয়স যখন খুব কম, তখন তাঁর বাবা-মায়ের সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে এবং লিনাস তাঁর মায়ের সাথে থাকতে শুরু করেন।
লিনাসের নানা লিও ছিলেন হেলসিনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুষদের প্রফেসর। ছোট্ট লিনাসের উপর নানার প্রভাব ছিল অনেক। পদার্থবিদ্যা আর গণিতের উপর ভালো দখল ছিল তাঁর। সত্তরের দশকের মাঝের দিকে লিও প্রথম ব্যক্তিগত কম্পিউটার কিনেন, যা ছিল Commodore Vic 20। এই প্রথম লিনাসের কম্পিউটারের সাথে পরিচয়। লিওর কম্পিউটার ব্যবহার করতে করতে লিনাসের এ জগতটাকে ভালো লাগতে শুরু করে। এরপর প্রোগ্রামিং করতে শুরু করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র দশ। তিনি অ্যাসেম্বলি ল্যাংগুয়েজে প্রোগ্রামিং করতে থাকেন। একসময় প্রোগ্রামিং, গণিত আর পদার্থবিদ্যাই হয়ে ওঠে লিনাস টোরভাল্ডসের ধ্যান-জ্ঞান। খেলাধুলা এবং বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে বাবার আগ্রহ লিনাসকে স্পর্শও করলো না। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন তিনি।
১৯৮৮ সালে হেলসিনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তি হলেন লিনাস। কিন্তু হঠাৎ করেই মাথায় কী চাপলো কে জানে! কিছুদিন পর চলে গেলেন ফিনিশ সেনাবাহিনীর এগারো মাসব্যাপী প্রশিক্ষণে। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল। সেনাবাহিনীতে থাকাকালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদও পেয়েছিলেন। এরপর ১৯৯০ সালে আবার ফিরে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, শুরু করেন লেখাপড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা শুরু করতে গিয়ে লিনাস প্রথম ব্যক্তিগত কম্পিউটারের মালিক হন। কিন্তু তাঁর কম্পিউটারে ব্যবহৃত অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে একদম সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি পছন্দ করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহার করা ইউনিক্স (UNIX) অপারেটিং সিস্টেম। আর নিজের কম্পিউটারে তাঁকে ব্যবহার করতে হতো মাইক্রোসফট কর্পোরেশনের ডিস্ক অপারেটিং সিস্টেম (MS-DOS)। তাই লিনাস ভেবে বসলেন তাঁর নিজের ব্যবহারের জন্য তিনি একটি ইউনিক্স ( UNIX-like) অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করবেন।
মাসের পর মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের পর একটি নতুন অপারেটিং সিস্টেমের জন্ম হলো। লিনাস তাঁর নামের সাথে মিল রেখে অপারেটিং সিস্টেমের নামকরণ করলেন লিনাক্স। তখন তাঁর বয়স মাত্র একুশ বছর। ১৯৯১ সালে লিনাস ইন্টারনেটে একটি মেসেজ পোস্ট করার মধ্য দিয়ে অন্যান্য কম্পিউটার ব্যবহারকারীদেরকে তাঁর এই নতুন অপারেটিং সিস্টেম সম্পর্কে অবহিত করলেন। তিনি এই অপারেটিং সিস্টেম সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে তো দিলেনই, পাশাপাশি অপারেটিং সিস্টেমের সোর্স কোডও উন্মুক্ত করে দিলেন। এতে করে লিনাসের পাশাপাশি অন্যান্য সফটওয়্যার ডেভেলপাররাও লিনাক্সকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করতে পারলেন। ১৯৯৪ সালে মূল লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম ‘লিনাক্স কার্নেলে’র ভার্সন ১.০ উন্মুক্ত করা হলো। ওপেন সোর্স হওয়ায় অর্থাৎ সোর্স কোড উন্মুক্ত হওয়ায় কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে দক্ষ যেকোনো ব্যক্তি এর পরিবর্ধন বা সংশোধন করতে পারেন। এ সুবিধার জন্যই আজ মূল লিনাক্স কার্নেলের সোর্স কোড ব্যবহার করে এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে লিনাক্সের আরো অসংখ্য ডিস্ট্রিবিউশন। প্রত্যেকটি ডিস্ট্রিবিউশন একেকটি স্বতন্ত্র অপারেটিং সিস্টেম। এই পৃথিবীতে লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের ঠিক ক’টি ডিস্ট্রিবিউশন আছে তার সঠিক সংখ্যা বলাটা বোধহয় সম্ভব নয়। তবে এর মধ্যে উবুন্টু, ফেডোরা, লিনাক্স মিন্ট, কালি লিনাক্স ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন দেশ লিনাক্স কার্নেল ব্যবহার করে নিজেদের জন্য নতুন অপারেটিং সিস্টেমও তৈরি করছে ।
সি প্রোগ্রামিংয়ের জনক ডেনিস রিচি, তাঁর বন্ধু কেন থম্পসন ও তাঁদের দল বেল ল্যাবরেটরিতে তৈরি করেছিলেন ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেম। কিন্তু এই ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করার জন্য ব্যবহারকারীকে সেটা কিনতে হতো। ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেমের মতোই একটি অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করে সেটিকে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন লিনাস টোরভাল্ডস। অ্যাপলের ম্যাক অপারেটিং সিস্টেমও কিন্তু ডেনিস রিচিদের ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেমের উপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছে।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে লিনাক্সের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এসময় নেটস্ক্যাপ, ওরাকল, ইনটেল, কোরেল ইত্যাদি কোম্পানি লিনাক্সের সাথে কাজ করতে এগিয়ে আসে। সেসময় লিনাক্স ব্যবহার করতে হতো টার্মিনালে কমাণ্ড লাইন লিখে লিখে। সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য কোনো গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস ছিল না। কেবল কম্পিউটারে দক্ষরাই ব্যবহার করতে পারতেন। নতুন শতাব্দীতে এসে লিনাক্সের সাথে গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস যুক্ত করা হয়। যার ফলে লিনাক্স ব্যবহার করার জন্য কম্পিউটারে দক্ষ হয়ে উঠতে হয় না। যেকোনো সাধারণ কম্পিউটার ব্যবহারকারীই স্বচ্ছন্দে লিনাক্স ব্যবহার করতে পারেন।
১৯৯৭ সালে লিনাস মাইক্রোপ্রসেসর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সমেটা কর্পোরেশনের সাথে যুক্ত হয়ে ছয় বছর সেখানে কাজ করেন। ২০০৫ সালে তিনি ভার্সন কন্ট্রোল সিস্টেম ‘গিট’ তৈরি করলেন, যা দুনিয়ার সমস্ত সফটওয়্যার ডেভেলপারদের একসাথে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। সফটওয়্যার ডেভেলপাররা এই প্ল্যাটফর্মে অনেকজন একসাথে একই প্রজেক্টে কাজ করতে পারেন। গিট এই দুনিয়ার সফটওয়্যার ডেভেলপেন্টের জগতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সফটওয়্যার ডেভেলপমেণ্ট নিয়ে কাজ করছেন অথচ গিট ব্যবহার করছেন না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর।
লিনাস টোরভাল্ডস উদ্যোক্তা নন, তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার– নিজেকে নিয়ে বলতে গিয়ে লিনাস এ কথা বলেছিলেন। তিনি এমন একজন মানুষ যিনি পুরোপুরি অন্তর্মুখী, মানুষের সাথে মুখোমুখি কথা বলার চেয়ে ইমেইলেই কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তিনি সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কথা ভেবে লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করেননি, তিনি শুধুমাত্র নিজের ব্যবহারের জন্য একটি নতুন অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করতে চেয়েছিলেন। আবার এই অপারেটিং সিস্টেমের ব্যবস্থাপনার জন্য তৈরি করেছিলেন গিট। অথচ দুটোই এখন পৃথিবীর সম্পদ হয়ে গেছে । লিনাক্স বা গিট এখন আর লিনাক্স টোরভাল্ডস নামের একজন ফিনিশ ইঞ্জিনিয়ারের ব্যক্তিগত ব্যবহারের সম্পত্তি নয়– সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ ডেভেলাপর প্রতিদিন আরো সমৃদ্ধ করে তুলছেন এ দুটো প্ল্যাটফর্মকে।
টেডে (TED) সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি স্বপ্নদর্শী মানুষ কি না সে প্রশ্নের উত্তরে লিনাস বলেছিলেন ,
“যারা আকাশের তারা দেখে সেখানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে আমি তাদের দলের কেউ না, আমি পড়ে যাওয়ার আগেই পথের গর্ত মেরামত করার লোক।”
সে পথের গর্ত এখন আর তিনি একা মেরামত করছেন না, প্রযুক্তির দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন তাঁর সাথে কাজ করে চলেছে তাঁর তৈরি প্ল্যাটফর্মে ।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘প্রযুক্তি’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/